গিম্প: ফ্রি ফটো এডিটিং ও গ্রাফিক্স ডিজাইন সফটওয়্যার

গিম্প হলো একটা ফটো ম্যানিপুলেশন সফটওয়্যার। এটা দিয়ে গ্রাফিক্স ডিজাইন, ফটো এডিটিং এধরণের কাজগুলো করা যায়, কাজের দিক দিয়ে অনেকটা ফটোশপের মত। এটা GPL লাইসেন্সের অধীনে প্রকাশিত একটি ফ্রি ও ওপেন সোর্স সফটওয়্যার।

GIMP এর পূর্ণরূপ হলো GNU Image Manipulation Program, তবে এর উচ্চারণ গিম্প করা হয়, জিআইএমপি এরকম নয়। উল্লেখ্য, GNU বা গ্নু হলো মুক্ত সফটওয়্যারের একটি সংগঠন, লিনাক্সের পথচলাও হয়েছে গ্নু-র সাথে।

তো যাই হোক, ফটোশপের সাথে সম্ভবত আমরা সকলেই পরিচিত। এডোবির ডেভেলোপ করা প্রচন্ড জনপ্রিয় এই ফটো এডিটরটির তিনটি বড় ধরণের সীমাবদ্ধতা আছে। প্রথমত, এটি খুব দামী একটি সফটওয়্যার, সাধারণ মানুষের আয়তার অনেকটা বাইরে বলা চলে। দ্বিতীয়ত, এটা ক্রস প্লাটফর্ম নয়, অর্থাৎ উইন্ডোজ ও ম্যাকে সমর্থিত হলেও লিনাক্সে সমর্থিত নয়। তৃতীয়ত, এটা চালাতে বেশ ভালো কনফিগারেশনের পিসি প্রয়োজন।

এখানে গিম্প একটা চমৎকার সমাধান। এটা ফ্রি, শুধু ফ্রি নয়, মুক্ত সফটওয়্যার, এর সোর্স কোডও উন্মুক্ত এবং পরিবর্তনযোগ্য। ক্রস প্লাটফর্ম, লিনাক্স, উইন্ডোজ ও ম্যাকসহ বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমে সমর্থিত। আর এটা লাইটওয়েট, মোটামুটি লো কনফিগারেশন পিসিতেও বেশ সুন্দরভাবে চলে।

আমি কোন গ্রাফিক্স ডিজাইনার নই, তবে ব্লগের বিভিন্ন থাম্বনেইল তৈরি ও এধরণের কিছু গ্রাফিক্স সংক্রান্ত কাজ করতে হয় কখনো কখনো। এখানে অবশ্যই মাসে $10, বছরে প্রায় ১০০০০ টাকা খরচ করে ফটোশপ চালানো অবশ্যই আমার জন্য যৌক্তিক সমাধান নয়। এমনকি ফটোশপ চালাতে হলে আমার হার্ডওয়্যার আপগ্রেড করতে হবে, আর ওএসও বদলাতে হবে।

তাই, গ্রাফিক্সের কাজে GIMP আমার নিত্যসঙ্গী। আসলে লিনাক্সে সুইচ করার আগে থেকেই উইন্ডোজেও এটা ব্যবহার করতাম। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলো GIMP নিয়মিত ব্যবহার করছি এবং এটা আমাকে হতাশ করেনি একদমই।

গিম্পে এটা স্টার্টআপে মাত্র ৫০ এম্বির মত র‍্যাম দখল করে, কাজের সময় অবশ্যই কিছুটা বেশি হবে। এই পোস্টের থাম্বনেইল বানানো শেষে চেক করলাম, ২১৩.৩ এম্বি র‍্যাম নিয়েছে, যেটা খুবই লাইটওয়েট, ফটোশপ ও এরকম অন্য গ্রাফিক্স ডিজাইনারগুলোর তুলনায়।

GIMP কিন্তু ফটোশপের কোন ক্লোন নয়! ইন্টারফেস এবং ব্যবহারবিধির দিক দিয়ে এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পাওয়া যাবে। তবে প্রয়োগক্ষেত্র অনেকটা অনুরূপ। অর্থাৎ, ইমেজ ম্যানিপুলেশন, গ্রাফিক্স ডিজাইন এরকম কাজগুলো করা যায় গিম্প দিয়ে।

এখানে আপনি বিভিন্ন লেয়ার নিয়ে কাজ করতে পারবেন, বিভিন্ন টুলস আছে, বিভিন্ন ধরণের ব্রাশ আছে এবং বিশেষ করে ড্রইংয়ের জন্য My Paint ব্রাশ ইন্টিগ্রেশন আছে। রয়েছে বিভিন্ন ফিল্টার, কালার এডজাস্টমেন্ট টুলস প্রভৃতি। এরপর বিভিন্ন এক্সটেনশন, প্লাগইনস-ও আছে GIMP-এর জন্য, অতিরিক্ত ব্রাশ ও অন্যান্য ফাংশনালিটি যুক্ত করে নেওয়ার সুযোগ আছে।

গিম্প নিয়মিত ডেভেলোপমেন্ট হচ্ছে এবং প্রতিটি ভার্সনে আরো চমৎকার হয়ে উঠছে। বর্তমানে GIMP 2.10.20 হলো গিম্পের লেটেস্ট রিলিজ এবং তারা কাজ করছে GIMP 3.0 নিয়ে, যেটি একটি হিউজ আপডেট হতে চলেছে অনেক পরিবর্তনসহ।

গিম্পের ইন্টারফেস বেশ পলিশড এবং কাস্টমাইজেবল। এখানে কয়েকটি থিম ও আইকন যুক্ত করে দেয়া আছে এবং কাস্টম থিম বা আইকন ব্যবহারের সুযোগ আছে। টুলবারগুলো পছন্দমত পজিশন করে নেয়া যায়।

গিম্পের টুলসংখ্যা তুলনামূলক কম। অনেক টুল মাল্টিফাংশনাল, অর্থাৎ একাধিক কাজ করতে পারে। যেমন, ফটোশপে দুটো টুল আছে, পলিনমাল ল্যাসো টুল আর ল্যাসো টুল। গিম্পে দুটো কাজই একটি টুল দিয়ে হয়, ফ্রি সিলেক্ট টুল।

বিভিন্ন ধরণের ট্রান্সফরমেশন টুল আছে গিম্পে। এর মধ্যে Unified Transform Tools মারাত্মক, এই একটা টুল দিয়ে মুভ, রিসাইজ, রোটেট, শিয়ার, পার্সপেক্টিভ সব করা যায়।

এভাবে কার্যপদ্ধতিতে ভিন্নতা থাকলেও ফটোশপের প্রায় সব টুলের অল্টারনেটিভ গিম্পে আছে। তবে এখানে কোন শেইপ টুল নেই। প্রথমদিকে ফটোশপ ছেড়ে গিম্পে এসে এটা নিয়ে অসুবিধায় পড়তাম, এখন আর সমস্যা হয় না।

সিলেক্ট টুল দিয়ে বৃত্ত, উপবৃত্ত, চতুর্ভুজ, বহুভুজ প্রভৃতি শেইপ তৈরি করা যায়, পেন্সিল বা পেইন্ট ব্রাশ টুলে লাইন বা বহুভুজ ধরণের শেইপ তৈরি করা যায়। আবার GFIG রেন্ডার ফিল্টারটিও বেশ কাজের এক্ষেত্রে।

এখানে ৫ ধরণের ব্রাশজাতীয় টুলস আছে। যাদের মধ্যে পেইন্টব্রাশ, পেনসিল ও এয়ারব্রাশ টুলতিনটি একই ব্রাশের জন্য ব্যবহার করা যায়, তবে আউটপুটে পার্থক্য রয়েছে, যা নিচের ছবিতে যথাক্রমে দেখানো হয়েছে।

এরপর ইঙ্ক টুল আছে। তবে ইন্টেরেস্টিং হলো মাইপেইন্ট ব্রাশ টুলটি। মাইপেইন্ট ড্রইংয়ের জন্য বিশেষায়িত আরেকটি ওপেন সোর্স সফটওয়্যার এবং গিম্পে তাদের ব্রাশগুলো ইন্টিগ্রেট করে দেয়া হয়েছে। এই ব্রাশগুলোর ডায়ানামিক ফিচার রয়েছে এবং ডিজিটাল ড্রইংয়ে সহায়ক।

গিম্পের বেশ কিছু টুলে অন ক্যানভাস এডিটিং সুবিধা আছে। বিশেষভাবে অন ক্যানভাস গ্র্যাডিয়েন্ট এডিটিং সুবিধা উল্লেখযোগ্য, অন্য কোন সফটওয়্যারে এই ব্যাপারটা চোখে পড়েনি। ফলে ক্যানভাসেই গ্র্যাডিয়েন্ট এডিট ও প্রিভিউ দেখা যায়।

তবে দুয়েকটি টুল আরেকটু ইম্প্রুভ হতে পারতো মনে হয়েছে। সিজর সিলেকশন টুল তার মধ্যে একটি। এটা অনেকটা ফটোশপের ম্যাগনেটিক ল্যাসো টুলের মত কাজ করে, অর্থাৎ, ইন্টেলিজেন্টলি এজ ডিটেক্ট করে সিলেক্ট করে। তবে একটু জুম করলেই বোঝা যায় সিলেকশন বেশ রাফলি হয়। কখনো কখনো কাজ চলে যায়, তবে পারফেক্ট না। ফরগ্রাউন্ড সিলেকশন টুল নিয়েও মোটামুটি একই বক্তব্য।

গ্রাফিক্স ডিজাইনার বিভিন্ন এডভান্সড ফাংশনালিটি এখানে দেওয়া আছে। চমৎকার বিভিন্ন ফিল্টার থাকছে, যেগুলো খুবই কাজে দেয়। এই ফিচারগুলো এক্সপ্লোর করতে চাইলে অবশ্য গিম্প ব্যবহার করে দেখতে হবে।

গিম্পের মত বিভিন্ন ওপেন সোর্স প্রজেক্ট রেগুলার ডেভেলোপারদের পাশাপাশি পৃথিবীব্যাপী বিভিন্নজনের কন্ট্রিবিউশনে গড়ে ওঠে। এটার সুবিধা আছে, আবার একটু সীমাবদ্ধতাও আছে, কমার্শিয়াল সফটওয়্যারগুলোর মত কমার্শিয়াল সাপোর্ট এখানে থাকে না। কমিউনিটি ও অনুদানের উপর এধরণের প্রজেক্টগুলো অনেকটা নির্ভর করে।

গিম্পের কিছু লিমিটেশন অবশ্যই আছে, তবে একটিরই উল্লেখ বিশেষভাবে করতে চাই, তা হলো এখানে CMYK কালার মোড সমর্থন নেই। তবে ভালো কথা হলো গিম্প খুব একটিভলি ডেভেলোপমেন্ট হচ্ছে, প্রতিটি রিলিজে চমৎকার বিভিন্ন ফিচার যুক্ত হচ্ছে এবং আরো পূর্ণতা পাচ্ছে। তাদের একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ আছে, যা এখানে রয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই CMYK কালার মোড নিয়ে কাজ করছে।

যাই হোক, সব মিলিয়ে গিম্প একটি চমৎকার গ্রাফিক্স এডিটর অবশ্যই। বিশেষ করে, যখন এটি সম্পূর্ণ ফ্রি, তখন অভিযোগের কোন সুযোগ আসলেই থাকে না। ব্যবহার করতে ইচ্ছুক? উইন্ডোজ বা ম্যাক ইউজাররা ডাউনলোড করে নিন নিচের লিঙ্ক থেকে।

আর লিনাক্স ইউজাররা সফটওয়্যার ম্যানেজারে ঢুঁ দিন। উবুন্টু ইউজাররা লেটেস্ট ভার্সনের জন্য এটা দেখুন। তাছাড়া Snap বা Flatpak অপশন তো আছেই!

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *