প্রযুক্তির অগ্রগতি মাত্রই মানুষের জন্য কল্যাণ নিয়ে আসবে- এমন ভাবনাটা বাস্তবসম্মত না, আর ইতিহাসও এই কথার সাক্ষ্য দেয় না। কখনো প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছে ধ্বংসাত্মক উদ্দেশ্যে, কখনো ভালো উদ্দেশ্যে হওয়া আবিষ্কার বয়ে এনেছে মন্দ পরিণতি। অতি আশাবাদী অবস্থান থেকে কোন প্রযুক্তি নিয়ে সব আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না- সে প্রযুক্তি যত চমকপ্রদ হোক না কেন। আর যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা আসে, তখন এই কথা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।
প্রযুক্তি যখন অনেক কিছুকে অনেক সহজ করে দিয়েছে, একই সাথে জীবনে যোগ করেছে নতুন অনেক চ্যালেঞ্জ আর কমপ্লেক্সিটি। এটা সত্য যে যোগাযোগ, লেনদেন, বিনোদন থেকে শুরু করে জ্ঞানার্জন, স্কিল ডেভেলোপমেন্টের মত বিষয়গুলো প্রযুক্তির কারণে অনেক সহজ হয়ে গেছে। এক ট্যাপেই এখন হয়ে যায় অনেক কিছু। কিন্তু একই সাথে কোন কিছু যখন খুব সহজলভ্য হয়ে যায়, তার গুরুত্বও কমে যায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিহাস তত পুরনো নয়। কিন্তু কয়েক দশকের মধ্যেই এর অগ্রগতি হয়েছে খুব দ্রুত। আরো আগেই আমরা ভিডিও গেমে ভার্চুয়াল প্রতিপক্ষ, ছবি থেকে অবজেক্ট ডিটেকশন, স্পিচ রিকগনিশন, কম পাওয়ারফুল ক্যামেরা থেকে দৃষ্টিনন্দন আউটপুট নিয়ে আসার মত AI-ভিত্তিক প্রোগ্রামগুলো দেখেছি। কিন্তু খুব সাম্প্রতিক কিছু সংযোজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একটি নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে তা বলাই যায়।
এই লেখাটা পড়ার পূর্বে ভালো হবে যদি ইতোপূর্বে নিয়নবাতিতে প্রকাশিত “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আদ্যোপান্ত” লেখাটি পড়া হয়ে থাকে। এই লেখাটি বর্তমান পরিস্থিতি সাপেক্ষে তার সাথে কিছু সংযোজন। লেখার বড় একটা অংশের আলোচনা হবে ChatGPT-কে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে। লেখাটা বিক্ষিপ্ত কিছু ভাবনার সংগ্রহ, তাই খুব গুছিয়ে উপস্থাপন করতে পারিনি।
এখন পর্যন্ত সব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্পেশালাইজড AI-এর অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য বিশেষায়িত। তা হতে পারে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, অবজেক্ট ডিটেকশন, ইমেজ জেনারেশন প্রভৃতি। ChatGPT বা Midjouney-ও এর ব্যতিক্রম নয়, তবে এই সর্বাধুনিক AI-গুলোর বিস্তৃত ডাটাসেট, ডিপ লার্নিং সিস্টেম, জেনারেলাইজেশন এবং আনসুপার্ভাইজড লার্নিংয়ের ক্ষমতা এদেরকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।
ChatGPT-কে শুরুতে আমি ভেবেছিলাম একটা চ্যাটবট, যেটা ন্যাচারাল ভাষাকে খুব ভালোভাবে প্রসেস করতে পারে- সেইসাথে এটা প্রচুর জানে- এতটা জানে যা শতবার আয়ু পেলেও মানুষের আয়ত্ত্ব করা সম্ভব না। কিন্তু যখন আমি ChatGPT ব্যবহার করছিলাম, again and again, I have been beyond impressed।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্টারনেটের বিস্তৃত তথ্যভান্ডার, উইকিপিডিয়া, অগণিত বই থেকে ChatGPT ট্রেইন্ড হয়েছে। ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল হিসেবে এটা শুধু ইংরেজি ভাষাকে প্রসেস করতে পারে না- বরং অন্যান্য ভাষা নিয়েও কাজ করতে পারে, এমনকি তার সাথে বেসিক প্রোগ্রামিংসহ আরো কিছু। আমার ধারণা ছিলো ChatGPT বাংলা প্রশ্নকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিয়ে প্রসেস করে, কিন্তু আসলে না- সাধারণত এটা বাংলা ভাষাতেই প্রসেস করার চেষ্টা করে- যেকারণে ‘তুমি’, ‘আপনি’ আর ‘তুই’ এর পার্থক্য জিজ্ঞাসা করলে ChatGPT উত্তর দিতে পারবে, যেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিয়ে করা সম্ভব ছিলো না। হ্যা, এটা বাংলা ভাষায় অনেক অদ্ভুত রেসপোন্স করে প্রায়ই, কিন্তু আমার কাছে এই ব্যাপারটা খুবই ফ্যাসিনেটিং- কেননা আনসুপার্ভাইজড লার্নিং আর বিস্তৃত ডাটাসেট কতটা পাওয়ারফুল হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এটি। প্রসঙ্গত, ChatGPT-র পুরো লার্নিং প্রসেস-ই আনসুপার্ভাইজড না, এখানে সুপার্ভাইজড লার্নিংয়েরও ব্যবহার আছে।
কিন্তু শুধু ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বললে ChatGPT-র অসাধারণত্বের সামান্যই প্রকাশ হয়। একাডেমিক পড়াশোনায় ChatGPT প্রচন্ড হেল্পফুল। না বোঝা লাইনগুলো ChatGPT-কে আস্ক করলে খুব সহজভাবে এক্সপ্লেইন করতে পারে, এবং গুগল সার্চের থেকে অনেক ইফিশিয়েন্টলি প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে দিতে পারে। যদিও ব্যবহার করতে থাকলে বোঝা যাবে, মাঝেমাঝে এটা খুব কনফিডেন্টলি ভুল উত্তর দেয়, এমন ভুল যেটা শুধু তখনই ধরা যাবে যখন আগের থেকে সঠিকটা জানা থাকবে, আর না জানলে মনে হবে- ইংরেজিতে যখন বলেছে সঠিক তো হবেই। ChatGPT-র তথ্যের সোর্সের মধ্যে আছে ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবপেজ, এবং অবশ্যই ইন্টারনেটে যা আছে তার সবই সঠিক নয়।
ChatGPT গল্প, কবিতা, গান এবং এরকম ক্রিয়েটিভ রচনা লিখতে পারে। কোন মানুষকে যে ধরণের জিনিস লিখতে বললে হয়ত আমাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হত, সেরকম জিনিসও ChatGPT স্বচ্ছন্দ্যে লিখে দেয়- যেমন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং জীবনের হতাশা নিয়ে ‘নাশিদ’, কিংবা রুমমেটকে নিয়ে ‘ডিস্কো কবিতা’।
AI জেনারেটেড কনটেন্টের ব্যাপারটা অবশ্য কনসার্নেরও সৃষ্টি করেছে। প্রচুর লেখা জমা পড়ায় লেখা নেয়া বন্ধ করে দিতে দেখা গেছে ম্যাগাজিনকে। একাডেমিক ক্ষেত্রে AI থেকে সরাসরি লেখা নেয়াটা একটা বড় কনসার্ন এখন। সেই সাথে AI জেনারেটেড টেক্সট ডিটেক্টরও তৈরি হচ্ছে। তবে আপাতত একজন ছাত্রের জন্য ল্যাব রিপোর্ট বা অ্যাসাইনমেন্ট লেখার সঙ্গী হিসেবে AI একটা আশীর্বাদ-ই।
ChatGPT-র পূর্বেও কনটেন্ট লিখতে সক্ষম AI আমরা দেখেছি, যেমন rytr.me আগেও ব্যবহার করেছি আমি। একইভাবে Midjourney বা DALL·E এর পূর্বেও গ্রাফিক্স জেনােরেশন AI অস্তিত্বশীল ছিলো। তবে সর্বাধুনিক এই AI-গুলো জাস্ট ভয়ঙ্কর একটা ইমপ্রেসিভ মাত্রায় এটাকে নিয়ে গেছে, যেটা আগের AI গুলো থেকে বহুগুণ উন্নত।
ChatGPT শুধু টেক্সট বেজড কাজ করতে পারে। হয়ত মনে হতে পারে যদি এর হাত-পা থাকতো তবে এটা কী না কী করে ফেলতে পারতো। ChatGPT-র ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। এটা ইন্সট্রাকশন জেনারেট করতে পারে, কিন্তু কাজে পরিণত করার মত সক্ষমতা রাখে না। ভবিষ্যতে হয়ত রোবটিক্স ও AI এর সংমিশ্রণে আরো এডভান্সড প্রযুক্তি আসবে যেটাকে বিবিধ রকমের কাজেও ব্যবহার করা যাবে।
যতক্ষণ পর্যন্ত ‘ব্যবহার’ হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত AI নিয়ে খুব বেশি আশঙ্কা নেই- প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের দিকটি ছাড়া। মানুষ আর যন্ত্রের বড় তফাৎ এখানে- মানুষ যখন যন্ত্রকে ব্যবহার করে, তার যন্ত্রের প্রতি কোন দায়িত্ববোধ বা loyalty নেই। কিন্তু মানুষ যখন মানুষের সাহায্য নেয়- তখন তাতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সৌজন্যের বিষয় রয়েছে, যেটা যন্ত্রের সাথে যায় না। যন্ত্রের সাথে মানুষের সম্পর্ক যদি মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের পর্যায়ে চলে আসে, তখন আসলে অনেকগুলো নতুন প্রশ্নের জন্ম হয়।
ChatGPT-র একটা বিষয় আমার কাছে বেশ ভালো লাগে, এটা উত্তর দেয়ার সময় বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে এটা একটা Language Model এবং এর কোন আবেগ-অনুভূতি, মত-অভিমত নেই। বেসিকালি এটা আপনাকে কী বলছে তা সে জানে না, তার যে অস্তিত্ব আছে এটাও সে জানে না- এটা জাস্ট একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম- যেটা তার হিউজ ট্রেনিং ও ফাইন টিউনিংয়ের মাধ্যমে ইউজারের ইনপুট অনুযায়ী রেসপোন্স প্রদর্শন করতে পারে, যেই রেসপোন্সটা হতে পারে অভাবনীয় কিছু, কিন্তু দিনশেষে- এটা একটা যান্ত্রিক আউটপুট ছাড়া কিছু না। Bing-এর চ্যাটবট যখন নিজের মানুষ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, কিংবা ভালোবাসার কথা জানায়, সে শুধু তার ডাটাসেট ও অ্যালগরিদম থেকে কিছু রেসপোন্স জেনারেট করছে- সত্যিকারের কোন ইচ্ছা তার নেই, বা সে কী বলছে তা সে জানে না।
যখন আপনি ChatGPT-কে সাবজেক্টিভ (মানুষের পার্সপেক্টিভের ওপর নির্ভরশীল এমন) কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন- সে হয়ত ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারা উল্লেখ করবে, অথবা তার ডাটাসেটে যে চিন্তাধারাটি কমন- সেদিক থেকে উত্তর দিবে, অথবা ডেভেলোপারদের প্রম্পট অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য পার্সপেক্টিভ অনুযায়ী জবাব দিবে বা কিছু বলতে অস্বীকার করবে। যা-ই করুক না কেন, তার নিজস্ব কোন চিন্তা নেই, নিজে সে কোন কিছুর ভালো-মন্দ নিরূপণ করতে পারে না- যেই ক্ষমতাটা মানুষের আছে। এখানে তার নিজস্ব কোন পক্ষ নেই, যদি থাকে, তবে তা ডেভেলোপারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা অথবা ডাটাসেটের কারণে।
এবং এখানে চলে আসে স্পেশালাইজড AI এর পরবর্তী পর্যায়, অর্থাৎ জেনারেল AI বা স্ট্রং AI। বেসিকালি এটা এমন AI, যার বুদ্ধিমত্তা ঠিক মানুষের মত হবে। থাকবে মানুষের মত চিন্তন দক্ষতা, নতুন নতুন স্কিল অর্জনের ক্ষমতা, সৃজনশীলতা, আবেগ-অনুভূতি, ভিন্ন পরিবেশে এডাপ্টেশনের ক্ষমতা। এবং এখানে বড় একটি বিতর্কের বিষয় হলো এই মাত্রার বুদ্ধিমত্তা self-awareness বা consciousness ছাড়া সম্ভব কিনা। একটি যন্ত্র- যার কনসাসনেস আছে, আবেগ-অনুভূতি আছে, পক্ষপাতীত্ব আছে; যেটা রাগ করতে পারে, কথা শুনতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে, নিজের থেকে কিছু করতে পারে- আপনি হয়ত ভাবছেন এটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। এবং হ্যা, এটা এখনো শুধুই হাইপোথিটিকাল ধারণা- AI এর অগ্রগতি অনেকদূর হলেও জেনারেল AI এখন পর্যন্ত শুধু ডোরেমন কিংবা এরকম কাল্পনিক চরিত্র হিসেবেই দেখা যাবে। এর বাস্তবায়ন সুদূর ভবিষ্যতেও কখনো সম্ভব হবে কিনা এটাও তর্কের বিষয়। সত্য যে ইতিহাসে এমন অনেক কিছু হয়েছে যা এক সময় ভাবা হত অসম্ভব- কিন্তু এটাও সত্য যে এমন অনেক কিছু কখনো (অন্তত এখন পর্যন্ত) বাস্তব হয়নি- অদৃশ্য হতে পারা, সময় ভ্রমণ করা, অমরত্ব লাভ আর এমন বিষয়গুলো।
এই পর্যায়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তার সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা- অন্তত স্পেশালাইজড AI এর পার্থক্যটা খুবই স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। এবং ঠিক এই কারণেই AI-কে মানুষের প্রতিপক্ষ কিংবা বিকল্প হিসেবে চিন্তা আমি একদমই করি না। পার্সোনালি আমি AI-কে ‘টুুল’ হিসেবে দেখা মানুষদের মধ্যে- মানুষের জীবনকে আরো জটিল ও কঠিন করে তোলার টুল।
দুঃখিত, আমাকে যদি হতাশাবাদী মনে হয়- আমি আসলে বাস্তববাদী হওয়ার চেষ্টা করছি। AI মানুষের প্রতিপক্ষ নয়, কিন্তু এটা খুব উচ্চ ক্ষমতার টুল, যাকে কন্সট্রাক্টিভ ভাবে ব্যবহারের সুযোগ যতটা আছে, ততটাই সুযোগ আছে আছে ডিস্ট্রাক্টিভভাবে ব্যবহারের। এই কথাটা AI-এর বেলায় প্রযোজ্য যে “with great power comes great responsibility”, কিন্তু শক্তিশালী AI টুল যখন অনেকাংশে উন্মুক্ত সবার ব্যবহারের জন্য, তখন সবাই এই responsibility দেখাবে- এই আশা দূরাশা। আর responsible ব্যবহারের সাথেও কিছু অপরিহার্য চ্যালেঞ্জ চলে আসবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আমি মানুষের জন্য অ্যাসিস্টিং হিসেবে দেখি, প্রতিপক্ষ নয়- কিন্তু মানুষ নিজেও তো মানুষের প্রতিপক্ষ হতে পারে।
চিন্তা করুন, আপনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, এমন সময়ে একদিন আপনার কোন ভিডিও ছড়িয়ে পড়লো যেখানে আপনি জড়িত কোন প্রতারণা, অপরাধ বা অনৈতিক কাজে- এবং আপনি যদিও জানেন ভিডিওটি বানোয়াট, কিন্তু আপনার চেহারা, অঙ্গভঙ্গী, কথা বলা সব কিছু এত নিখুঁত যে আপনি নিজে পর্যন্ত একে অবাস্তব বলার মত কোন পয়েন্ট পাচ্ছেন না।
অসম্ভব মনে হচ্ছে? ডিপফেক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত থাকলে অবশ্য তত অসম্ভব মনে হবে না। Linus Tech Tips-এর সিস্টার চ্যানেল ShortCircit-এর এই ভিডিওটি তৈরি হয়েছে ডিপফেক প্রযুক্তি দিয়ে, এখানে লাইনাসকে হোস্ট হিসেবে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে এই ভিডিওতে তার অংশগ্রহণ নেই। হয়ত এখনও ডিপফেক প্রযুক্তি এতটা নিখুঁত হয়নি- গবেষণাপত্রে আছে বড় অংশে। তবে সামনে যে আরো নিখুঁত হয়ে উঠবে না, তারই নিশ্চয়তা কী?
অথবা ধরা যাক আপনি অনেক সময় ও এফোর্ট দিয়ে কিছু শিখলেন- হয়ত প্রোগ্রামিং কিংবা গ্রাফিক্স ডিজাইন বা এমন কিছু- এবং এরপর আপনি দেখলেন এত সময় ও সাধনার পর যেটুকু আপনি করতে পারছেন, AI-কে শুধু একটি কমান্ড দিলেই আরো সুন্দরভাবে তা সে করে দিচ্ছে- এই অনুভূতিটা আসলে সুখকর না। আমার দিক থেকে কিছুটা এমনই অনুভূতি হয় যখন AI এর সাহায্যে খুব সহজে ব্লগ আর্টিকেল বা লিখিত কনটেন্ট তৈরি করা যায়।
হ্যা, তারপরও মানুষ আর AI এক নয়। আমার দিক থেকে একটা উদাহরণ দিই। নিয়নবাতিতে আমার লেখার মূল কারণ হলো আমার ভাবনাগুলো শেয়ার করতে বা নিজের মত করে কোন কিছু উপস্থাপন করতে আমি পছন্দ করি। এটা আমার কর্মক্ষেত্র নয়, বরং আমার আবেগের একটা জায়গা। কাজেই AI আমাকে রিপ্লেস করবে এই ভয় আমার নেই। AI যত ভালোই লিখুক, তা আমার কথা বা আমার লেখা হবে না।
কিন্তু এবার চিন্তা করুন ব্লগ লেখা যদি আমার প্রফেশন হত, তাহলে বিষয়টি কেমন হত? একটা ভালোমানের কনটেন্ট তৈরি করতে যখন আমাকে হয়ত কয়েকদিন সময় দিতে হবে, AI তা করে দিত নিমেষেই। এবং এর মধ্যেই এখানে AI যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছে- সামনে হয়ত AI এর লেখাগুলোও আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। কাজেই যখন হয়ত এরপরও মানুষের কাজের আলাদা একটি গুরুত্ব থাকবেই- অবশ্যই AI আমার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতো।
যখন যন্ত্রের এত আধিক্য ছিলো না- তখন মানুষের জন্য যে কর্মক্ষেত্রগুলো ছিলো, তার অনেকগুলো এখন যন্ত্রের দখলে। আবার যন্ত্রের কারণেই তৈরি হয়েছে অনেক কর্মক্ষেত্র। যে মানুষগুলো দ্রুত সময়ে নিজেকে আপগ্রেড করতে পেরেছে এবং নতুনকে এডপ্ট করতে পেরেছে- তারা নিজেদের বিশেষ অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। যেমন এক দশক আগে প্রোগ্রামিং বা ওয়েব ডেভেলোপমেন্ট বা গ্রাফিক্স ডিজাইনের মত দক্ষতাগুলো একটি বড় বিষয় ছিলো। কিন্তু এই সময়ে এই সেক্টরগুলোতে যদি ভালো কিছু করতে হয়, তাহলে সাধারণভাবে আপনাকে সাধারণের থেকে অনেক ভালো মাত্রার দক্ষ হতে হবে- কারণ এখন এগুলো অনেক সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। আবার ঠিক এখন নতুন কিছু সেক্টর তৈরি হচ্ছে- মেশিন লার্নিং ও আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স সম্পৃক্ত। অর্থাৎ এখন নিজের অবস্থান তৈরির জন্য আপনাকে আরো এডভান্সড জ্ঞান ও স্কিল অর্জন করতে হবে- ১০ বছর আগে যেটুকু যথেষ্ট ছিলো, এখন তা অর্জন করা তুলনামূলক সহজ, কিন্তু তা আর যথেষ্ট নয়।
AI এর জন্য জব মার্কেট হারানো, মানুষের গুরুত্ব কমে যাওয়া এরকম প্রশ্নগুলোতে অনেকেই বলে থাকে দক্ষতা থাকলে কাজও থাকবে। আমি যখন মেনে নিবো যে দক্ষতা থাকলে কাজ থাকবে কথাটা ঠিক- তবে দক্ষতাও ততটাই থাকতে হবে, এবং খুব সম্ভবত তার সাথে AI-কে যথাযথভাবে ব্যবহারও শিখতে হবে, কেননা মনে হচ্ছে সামনের দিনে AI জীবনের সাথে আরো জড়িয়ে যাবে- যেমন এখন জড়িয়ে গেছে কম্পিউটার আর মোবাইলের মত ডিভাইসগুলো।
যদি আপনি একটা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে থাকেন- যেখানে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সম্ভবত আপনার আধুনিক AI-এর যথাযথ ব্যবহার ও নিজ ক্ষেত্রে প্রয়োগে অভ্যস্থ হওয়া আপনাকে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে নিবে। যদি আপনি একজন শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন, অথবা একজন চাকুরিজীবী, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন ডিজাইনার বা একজন প্রোগ্রামার- AI এর সচেতন ব্যবহার আপনার কাজকে করে তুলতে পারে আরো সহজ ও ইফিশিয়েন্ট।
আর আপনি যদি জীবনযুদ্ধে আর এগিয়ে যেতে না চান, শুধু একটু শান্তিপূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চান- তাহলে আসলে পৃথিবীর জীবনে সেটা পাবেন না- জান্নাতে পা রাখার আগে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন বলে কিছু নেই। তবে আধুনিকতার মায়াজালে আমরা যে জীবনকে আরো বেশি জটিল করে তুলেছি, এই কথাটাও মনে হয় স্বীকার করে নেয়ার সময় এসেছে।