নবম-দশম শ্রেণি – পদার্থবিজ্ঞান – পঞ্চম অধ্যায়: পদার্থের অবস্থা ও চাপ

1,794 views

This entry is part 6 of 7 in the series এসএসসি পদার্থবিজ্ঞান

তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা বল সম্পর্কে জেনেছি। আমরা জেনেছি বল প্রয়োগের ফলে বস্তুতে ত্বরণ সৃষ্টি হয়। কিন্তু বল প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া সবসময় কিন্তু একইরকম হয় না। সহজ উদাহরণ, হাত দিয়ে একটা বেলুনকে ধাক্কা দিলে সেটা শুধু তার জায়গা থেকে সরে যাবে, কিন্তু সমান বল প্রয়োগ করে একটা সুঁচ দিয়ে আঘাত করলে সেটা ছিদ্র হয়ে ফেটে যাবে। এই পার্থক্যের কারণ বুঝতে যে কনসেপ্টগুলো দরকার হবে, তা আলোচনা হবে এই অধ্যায়ে।

ঘনত্ব (Density)

ঘনত্ব হলো প্রতি একক আয়তনে ভর। একে গ্রিক বর্ণ ρ (rho বা রো) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। কোন বস্তুর আয়তন V এবং ভর m হলে একক আয়তনে ভর, অর্থাৎ ঘনত্ব-

এখান থেকে, ρ ঘনত্বের V আয়তনে একটি বস্তুর ভর m = ρV দ্বারা বের করা যাবে। বস্তুটির ওজন হবে W = mg = ρVg। ঘনত্বের সাথে ভর ও ওজনের সম্পর্ক সমানুপাতিক, অর্থাৎ একই আয়তনের বেশি ঘনত্বের বস্তুর ভর ও ওজন বেশি হবে।

ঘনত্বের SI একক kgm-3। CGS পদ্ধতির এককটিও অনেকক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, gcm-3, যেটাকে gm/cc এভাবেও লেখা হয়। cc মানে হলো কিউবিক সেন্টিমিটার বা cm3

আয়তনের জন্য আমরা প্রায়সই একক হিসেবে লিটার ব্যবহার করি। 1 L বলতে বোঝায় 1 dm3 আয়তন। এবং 4°C এই পরিমাণ বিশুদ্ধ পানির ভর 1 kg ধরা হয়। অর্থাৎ 1 L পানির ভর 1 kg। এই মিলে যাওয়াটা কাকতালীয় কিছু না, এককগুলোকে এভাবেই নির্ধারণ করা হয়েছে।

যাইহোক, তাহলে বিশুদ্ধ পানির ঘনত্ব ρw = 1 kgL-1 = 1 kgdm-3 = 1000 kgm3 = 1 gcm-3। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। বিশুদ্ধ পানির ক্ষেত্রে 1 L পানি আর 1 kg পানি একই পরিমাণ বোঝাবে। তবে অন্যকিছু, যেমন সয়াবিন তেলের কথা যদি বলি, সয়াবিন তেলের ঘনত্ব কিন্তু প্রায় 0.9 kgL-1 এর মত, যেকারণে ৫ লিটার তেলের বোতলে থাকা তেলের ভর হয় 4.5 কেজি।

প্রসঙ্গত, তাপমাত্রা, চাপ ও বিশুদ্ধতাভেদে পানির ঘনত্ব পরিবর্তন হতে পারে। ইন্টেরেস্টিং ব্যাপারটা হলো 4°C তাপমাত্রায় পানির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এখান থেকে তাপমাত্রা বাড়ালেও ঘনত্ব কমবে, তাপমাত্রা কমালেও ঘনত্ব কম হবে। অবশ্য তরল পানির জন্য তাপমাত্রার তারতম্যে ঘনত্বের পার্থক্য খুব বেশি হয় না। বরফে পরিণত হলে পানির ঘনত্বের প্রায় ১২ ভাগের ১১ ভাগ, ঘনত্ব কম হওয়াতে বরফ পানিতে ভাসে।

চাপ (Pressure)

চাপ হলো একক ক্ষেত্রফলে কোন তলের ওপর লম্বভাবে প্রযুক্ত বল। চাপকে P দ্বারা প্রকাশ করা হয়। মনে করো A ক্ষেত্রফলে F বল লম্বভাবে প্রযুক্ত হচ্ছে। তাহলে চাপ, P = F/A

যেমন ধরা যাক 5 m2 ক্ষেত্রফলসম্পন্ন একটি পৃষ্ঠের ওপর 25 N বল লম্বভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। তাহলে 1 m2 ক্ষেত্রফলে প্রযুক্ত বল হলো 5 N। অর্থাৎ, এখানে চাপ হলো 5 N/m2। N/m2-কে প্যাসকেল বলা হয় এবং Pa প্রতীকে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ, SI পদ্ধতিতে চাপের একক প্যাসকেল (Pa)। 1 m2 ক্ষেত্রফলে 1 N বল প্রযুক্ত হলে চাপ 1 Pa। চাপের মাত্রা ML-1T-2

বল একটা ভেক্টর রাশি হলেও চাপ একটা স্কেলার রাশি। একটা পৃষ্ঠের সাথে বল বিভিন্ন কোণে প্রযুক্ত হতে পারে। কিন্তু চাপের জন্য শর্ত দিয়ে দেয়া হয়েছে বলের যে অংশটুকু লম্বভাবে প্রযুক্ত হচ্ছে। তাই চাপ প্রকাশে শুধু মান বলা-ই যথেষ্ট, দিক বলার দরকার নেই।

সত্যি বলতে ওপরের ব্যাখ্যাটা অসম্পূর্ণ- কেননা টেকনিকালি চাপের একটা দিক চিন্তা করা হচ্ছে, পৃষ্ঠের সাথে লম্বভাবে। তবে চাপ ভেক্টর রাশির নিয়মকানুন মেনে চলে না। আর চাপের ধারণা শুধু কঠিন বস্তুর জন্য নয়, তরল ও বায়বীয় পদার্থের ক্ষেত্রে বরং আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, যেখানে তারা সবদিক থেকে চাপ প্রয়োগ করে, নির্দিষ্ট কোন দিক নয়।

ρ ঘনত্বের একটি বস্তুর উচ্চতা h, ক্ষেত্রফল A এবং ওজন W হলে, তার দ্বারা প্রযুক্ত চাপ-

তাহলে, P = hρg

এখান থেকে দেখা যাচ্ছে নির্দিষ্ট ঘনত্বের কোন বস্তু কতৃক প্রযুক্ত চাপ তার ক্ষেত্রফলের ওপর নির্ভর করে না।

চাপের অন্যান্য একক

CGS পদ্ধতিতে চাপের একক ব্যারি (Ba)। এখানে বলের একক dyn এবং দৈর্ঘ্যের একক cm, তাই ব্যারি নির্দেশ করে dyn/cm2। 1 cm2 ক্ষেত্রফলে 1 dyn বল প্রযুক্ত হলে চাপ 1 Ba। 1 Ba = 0.1 Pa

চাপের আরেকটি প্রচলিত একক হলো বার (bar)100000 Pa = 100 kPa = 1 bar

বায়ুমল্ডলীয় চাপ (atmospheric pressure) চাপের আরেকটি জনপ্রিয় একক, একে atm লেখা হয়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল যে চাপ প্রয়োগ করে। সমুদ্র সমতলে 15°C তাপমাত্রায় গড় বায়ুমন্ডলীয় চাপ 101325 Pa, যাকে আদর্শ বায়ুমন্ডলীয় চাপ ধরা হয়, এর পরিমাণকে 1 atm বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ, 1 atm = 101325 Pa

পারদ উচ্চতা চাপের পরিমাণ প্রকাশের আরেকটি পদ্ধতি, এটা বোঝার জন্য বাতাসের চাপের ধারণা ও টরিসেলির পরীক্ষার সাথে পরিচিত হতে হবে।

বাতাসের চাপ

বাতাসের চাপ 101325 Pa বা প্রতি বর্গমিটারে বাতাস 101325 N বল প্রয়োগ করে। কনটেক্সটে আনার জন্য, এটা বড় আকারের একটি হাতির ওজনের মত। এই মারাত্মক পরিমাণ চাপ আমরা অনুভব করিনা কেননা বাতাসের চাপ সবদিকে প্রযুক্ত হয়, শুধু নিচের দিকে না। আমাদের দেহের অভ্যন্তরেও বাতাস আছে, সে বাতাসও বাইরের দিকে চাপ প্রয়োগ করছে। দেহের বাইরে-ভেতরে চাপের কোন পার্থক্য নেই। চাপকে আমরা কেন স্কেলার রাশি বলছি, এটি তার একটি উদাহরণ।

বাতাসের সব দিক থেকে চাপ দেয়ার বিষয়টি তোমাদের বই বেশ সুন্দরভাবে বোঝানো হয়েছে। ছবির মত একটা পাতলা অ্যালুমিনিয়াম বা টিনের পাত দিয়ে তৈরি কৌটা থেকে কোনভাবে পাম্প করে বায়ুশূন্য করে নেয়া হলে তা চ্যাপ্টা হয়ে যায় না, বরং সব দিক থেকে দুমড়ে মুচড়ে যায়। ভেতরে যখন বাতাস ছিলো, তখন ভেতর থেকে বাতাসের চাপ আর বাইরে থেকে চাপ সমতায় ছিলো।

আরেকটা প্রশ্ন এখানে আসতে পারে, বাইরের বিস্তৃত বায়ুমন্ডলের তুলনায় ভেতরে তো নগন্য বায়ু ছিলো। তাহলে সমতা তৈরি হলো কীভাবে? এখানে চাপ বায়ুর আয়তনের ওপর নির্ভর করছে না, বরং ঘনত্বের ওপর নির্ভর করছে। কেননা এই চাপ মূলত বাতাসের কণাগুলোর ছুটোছুটির জন্য সৃষ্টি হয়। 25 m3 আয়তনের পাত্রে 25 kg গ্যাস রাখা হলে তাদের প্রযুক্ত চাপ, আর 5 m3 আয়তনের পাত্রে 5 kg গ্যাসের চাপ সমান হবে। কিন্তু, পাত্রের আয়তন অপরিবর্তিত রেখে গ্যাসের আয়তন পরিবর্তন করলে প্রযুক্ত চাপে তারতম্য ঘটবে।

টরিসেলির পরীক্ষা

একটা সময় পর্যন্ত বাতাস বা গ্যাসীয় বস্তুর চাপকে মানুষ উপেক্ষণীয় মনে করত। বাতাসের চাপের ফলে শূন্যস্থান সৃষ্টি দেখাতে বিজ্ঞানী ইভানগেলিস্তা টরিসেলি এই পরীক্ষাটা করেছিলেন। পরীক্ষাটা এরকম-

প্রথমে এক মুখ বন্ধ একটি নলকে পারদ (মার্কারি, Hg) দ্বারা পূর্ণ করতে হবে।

পারদ ভরা একটি পাত্রে নলটি উল্টো করে স্থাপন করতে হবে।

পারদ স্তম্ভের উচ্চতা নামতে থাকবে। তবে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছালে এটা থেমে যাবে। সাধারণ বায়ুমন্ডলীয় চাপে এই উচ্চতা সবসময়ই হবে 76 cm বা 760 mm

বাস্তবিকভাবে মহাবিশ্বে কখনোই পারফেক্ট শূন্যস্থান সম্ভব নয়। তাহলে পারদ স্তম্ভের ওপরে যে শূন্যস্থান তৈরি হলো- সেখানে আসলে কি আছে? প্রথমে তোমার মনে হতে পারে বাতাস, কিন্তু ওখানে অবশ্যই বাতাস যেতে পারবে না, যেহেতু পারদপূর্ণ অবস্থায় পারদের মধ্যে নলটি ডুবানো ছিলো। মূলত এই শূন্যস্থানটিতে পারদের বাষ্প রয়েছে।

এখন নলের ওপরে যেহেতু কোন ছিদ্র নেই, তাই ওপর থেকে বায়ুমন্ডলের চাপ পারদ স্তম্ভে প্রযুক্ত হচ্ছে না। কিন্তু পারদ স্তম্ভ নিজে একটা চাপ প্রয়োগ করছে। আবার পাত্রে যে পারদ আছে তার ওপর বায়ুমন্ডল একটা চাপ প্রয়োগ করছে। এই দুটো চাপ সমতা সৃষ্টি করছে যখন পারদ স্তম্ভ 76 cm উচ্চতায় পৌঁছাচ্ছে। যদি বায়ুর চাপ বেশি হত, তাহলে সমতা তৈরিতে পারদ স্তম্ভের উচ্চতা আরো অধিক হত। একইভাবে বায়ুর চাপ কম হলে পারদ স্তম্ভের উচ্চতাও কম হত।

পারদের বদলে পানি বা অন্য কোন তরল ব্যবহার করেও এই পরীক্ষা করা সম্ভব, তবে উচ্চতা ভিন্ন হবে। পানি ব্যবহার করা হলে স্তম্ভের উচ্চতা হত 10.3 m। পারদের ঘনত্ব বেশি বলে চাপ পরিমাপ করাতে পারদ ব্যবহার সুবিধাজনক।

আরেকটা মজার বিষয়, আমরা যে স্ট্র দিয়ে জুস খেতে পারি, এটাও কিন্তু বায়ুচাপের কারণে সম্ভব হয়। আমরা যখন স্ট্রতে চুমুক দিই, তখন মূলত আমরা জুসে ঊর্ধ্বমুখী বল প্রয়োগ করি না, বরং একটা শূন্যস্থান সৃষ্টি করি, ফলে জুসের ওপর বাতাসের চাপের কারণে স্ট্র হয়ে তা ওপরে উঠে আসে। যদি জুসের ঘনত্ব পানির অনুরূপ হত, আর স্ট্র-র দৈর্ঘ্য 10.3 m থেকে বেশি হত, তবে যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, চুমুক দিয়ে কোনভাবেই 10.3 m থেকে ওপরে ওঠানো যেত না। পারদের মত ঘনত্ব হলে 76 cm থেকে ওপরে উঠতো না।

এখন, পারদের উচ্চতা চাপের একটা পরিমাপক, কিন্তু এটা নিজে একটা উচ্চতা, চাপ নয়। এটা থেকে চাপ কীভাবে বের করা যায়? এজন্য আমাদের 76 cm পারদের প্রযুক্ত চাপ নির্ণয় করতে হবে। P = hρg থেকে এটা পাওয়া যাবে। পারদের ঘনত্ব 0°C তাপমাত্রায় 13595 kg/m3। অর্থাৎ 76 cm পারদ উচ্চতা নির্দেশ করে বাতাসের চাপ, P = 0.76 m × 13595 kg/m3 × 9.8 ms-2 = 101255.56 Pa ≈ 101325 Pa।

পারদ উচ্চতা দিয়ে চাপের পরিমাপ বোঝাতে mmHg বা cmHg একক লেখা হয়। একে মিলিমিটার মার্কারি বা সেন্টিমিটার মার্কারি এভাবে পড়া হয়। 1 atm = 101325 Pa = 76 cmHg = 760 mmHg

চিন্তা কর: টরিসেলির পরীক্ষায় নলের ক্ষেত্রফল কেন বিবেচনার প্রয়োজন হয় না?

উত্তর পেতে পেজটি রিলোড কর।

ব্যারোমিটার, বাতাসের চাপ ও আবহাওয়া

ব্যারোমিটার হলো বাতাসের চাপ পরিমাপের যন্ত্র। টরিসেলির পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ব্যারোমিটার দিয়ে বাতাসের চাপ পরিমাপ করা হয়। বাতাসের চাপের আদর্শ মান 76 cmHg, তবে সবসময় এটি আদর্শ মানে থাকে না।

মাধ্যাকর্ষণের কারণে পৃথিবীপৃষ্ঠের কাছাকাছি বায়ুর ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। ওপরের দিকে বাতাসের ঘনত্ব কমতে থাকে, অর্থাৎ বাতাসের চাপও কমতে থাকে।

পৃথিবীপৃষ্ঠে বিভিন্ন কারণে বায়ুমন্ডলের চাপের তারতম্য ঘটে। তাপমাত্রা বেশি হলে তা বাতাসের প্রসারণ ঘটায়, অর্থাৎ আয়তন বেড়ে যায়। ফলে বাতাসের ঘনত্ব কমে যায়।

বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বাতাসের ঘনত্ব হ্রাস পায়। কেননা বাতাসের অধিকাংশ হলো নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন, যাদের আণবিক ভর যথাক্রমে 28 ও 32। অন্যদিকে জলীয় বাষ্প তথা পানির অণুর আণবিক ভর 18। তাই অধিকতর জলীয় বাষ্প থাকলে বাতাসের ঘনত্ব কম হয়।

ব্যারোমিটারে উচ্চচাপ থাকলে তা নির্দেশ করে বাতাসের ঘনত্ব বেশি, তথা জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম। অর্থাৎ বাতাস শুকনো এবং আবহাওয়া ভালো। অন্যদিকে চাপ বেশি থাকলে তা জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি নির্দেশ করে। চাপ বেশি কমে গেলে বোঝা যায় ঝড়-বৃষ্টি শুরু হতে যাচ্ছে।

সমুদ্র অঞ্চলে নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে সমতা সৃষ্টিতে আশেপাশের উচ্চতর বায়ুচাপ থাকা অঞ্চল থেকে বায়ু আসতে থাকে। এতে ঘূর্ণির সৃষ্টি হতে পারে, যা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এভাবে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বায়ুচাপের ভূমিকা।

গাণিতিক প্রশ্ন

প্রশ্ন ১

ছবিতে 1.8 gcm-3 ঘনত্বের একটি ব্লক দুটি অবস্থানে দেখানো হয়েছে। মাপগুলো cm এককে রয়েছে। কোন অবস্থানে ব্লকটি ভূমিতে কত চাপ প্রয়োগ করবে? ভূমিতে প্রযুক্ত বলের কোন পরিবর্তন হবে কি?

উত্তর পেতে পেজটি রিলোড কর।

প্রশ্ন ২

হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ 0.84 fm। নিউট্রন ও প্রোটন উভয়ের ভর 1.67 × 10−27 kg। হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের ঘনত্ব কত?

উত্তর:

fm অর্থ ফেমটোমিটার, 1 fm = 10-15 m। প্রথম অধ্যায়ে এককের উপসর্গগুলো দেখে নিতে পারো।

হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে একটি নিউট্রন রয়েছে। তাই নিউক্লিয়াসের ভর, m = একটি নিউট্রনের ভর = 1.67 × 10−27 kg

নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ, r = 0.84 fm = 0.84 × 10-15 m
নিউক্লিয়াসের আয়তন, V = ⁴⁄₃ × π × r3 = 7.45 × 10-45 m3

তাহলে, হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের ঘনত্ব, ρ = 1.67 × 10−27 kg / 7.45 × 10-45 m3 = 2.24 × 1017 kgm-3

প্লবতা (Buoyancy) ও আর্কিমিডিসের সূত্র

আর্কিমিডিসের বিখ্যাত গল্পটা আমরা সবাই জানি, এর কতটুকু সত্য আর কতটুকু রং চড়ানো তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকলেও গল্পটা আকর্ষণীয় এটুকু ঠিক। গল্প অনুযায়ী আর্কিমিডিস চৌবাচ্চায় গোসলে নেমে সেই অবস্থাতেই ইউরেকা বল দৌড়ে গিয়েছিলেন, যখন তিনি না গলিয়ে রাজা হিয়েরোর নতুন মুকুটের খাদ বের করার পথ বের করতে পেরেছিলেন।

আর্কিমিডিস খেয়াল করলেন চৌবাচ্চায় নামার পর কিছু পরিমাণ পানি অপসারিত হচ্ছে। অর্থাৎ একটা পাত্রের পুরোটা পানিতে পূর্ণ থাকলে তাতে কিছু ডুবালে কিছু পানি পাত্রের বাইরে অপসারণ হবে, সেরকম। তার সাথে আর্কিমিডিস দেখলেন তার সাথে নিজের ওজনও কম অনুভূত হচ্ছে। যারা সাঁতার কাটতে অভ্যস্থ, তারা জানো যে পানিতে ডুব দিলে ওজন কম অনুভূত হয়।

ভাবুক মানুষটি এখান থেকে একটা জিনিস বুঝে গেলেন, (যদি না বস্তুটি দ্রবীভূত হয়) পানিতে কোন কিছু নিমজ্জিত করলে বস্তুটি কিছু পানি অপসারণ করে। এই অপসারিত পানির আয়তন হবে বস্তুটির আয়তনের সমান। নিমজ্জিত বস্তু কতৃক যতটুকু পানি অপসারিত হয়, বস্তুটি সে পানির ওজনের সমপরিমাণ ওজন কম অনুভব করে। অর্থাৎ, বস্তুর হারানো ওজন = অপসারিত পানির ওজন

হারানো ওজন কথাটা পুরোপুরি ঠিক না অবশ্য, ওজন বলতে মূলত মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবজনিত বল বোঝানো হয়, ওটা ঠিকই থাকে। তবে নিমজ্জিত অবস্থায় তার সাথে প্লবতা নামের আরেকটা বলও ক্রিয়া করে, যেকারণে সম্পূর্ণ ওজন অনুভব না করে ওজন ও প্লবতা বল দুটোর লদ্ধি বল তখন বস্তুটা অনুভব করে।

প্লবতা: প্রবাহী পদার্থে আংশিক বা সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করলে এদের ওপর একটি ঊর্ধ্বমুখী লদ্ধি বল কাজ করে, এই বলটিকে প্লবতা বলে।

প্লবতা একটি বল। তাই একে F বা FB প্রতীক ব্যবহার করে প্রকাশ করা যেতে পারে (B নির্দেশ করে Buoyancy)।

প্রবাহী বলতে পানি বা বায়বীয় পদার্থ বা এমন কিছু বোঝায় যা প্রবাহিত হতে পারে। প্লবতার মান অপসারিত পানির ওজনের সমান এবং দিক ঊর্ধ্বমুখী দিকে। বস্তুর ওজন যেহেতু নিচের দিকে কাজ করে, আর প্লবতা ওপরের দিকে, তাই বস্তুর আপাত ওজন কম মনে হয়।

আর্কিমিডিসের সূত্র: প্রবাহীতে নিমজ্জিত বস্তু কিছু ওজন হারায় বলে মনে হয়। এই হারানো ওজন বস্তু কতৃক অপসারিত পানির ওজনের সমান হয়।

এখন তাহলে কীভাবে এটা ব্যবহার করে স্বর্ণের মুকুটের খাদ বের করা যেতে পারে? স্বর্ণের ঘনত্ব উচ্চ, যদি স্বর্ণের সাথে মুকুটে খাদ থাকে, তবে এর আয়তন সমান ওজনের স্বর্ণের আয়তন থেকে বেশি হবে। খাদ আছে কিনা পরিমাপ করতে মুকুটের ওজনের সমান ওজনের খাদহীন স্বর্ণ নিতে হবে। এরপর মুকুট কতৃক অপসারিত পানির ওজন, আর খাদহীন স্বর্ণ কতৃক অপসারিত পানির ওজন যদি সমান হয়, তাহলে বোঝা যাবে মুকুটে খাদ নেই। কিন্তু যদি মুকুটের অপসারিত পানির ওজন বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে এতে খাদ আছে।

কোন বস্তুর V আয়তন তরলে নিমজ্জিত থাকলে V আয়তনের পানি অপসারিত হবে। V আয়তনের তরলের ওজন = ρVg (যেখানে ρ তরলের ঘনত্ব)। এটিই প্লবতার পরিমাণ। অর্থাৎ, F = ρVg

এখন প্লবতা কীভাবে কাজ করে? ওপরের ছবিতে একটা সিলিন্ডার রয়েছে, যার প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল A এবং উচ্চতা h। প্রথমে মনে করিয়ে দিচ্ছি বায়বীয় বা তরল পদার্থ নির্দিষ্ট কোনদিকে চাপ প্রয়োগ করে না, সবদিকে চাপ প্রয়োগ করে। ওপরের পৃষ্ঠে পানি যেমন নিচের দিকে চাপ প্রয়োগ করবে, তেমনি নিচের পৃষ্ঠে পানি ওপরের দিকে চাপ প্রয়োগ করবে।

আমরা আগেই দেখিয়েছি ρ ঘনত্বের বস্তুর উচ্চতা h হলে তার প্রযুক্ত চাপ, P = hρg
সিলিন্ডারের ওপরের পৃষ্ঠ পর্যন্ত পানির গভীরতা h1, তাহলে ওপরের পৃষ্ঠে প্রযুক্ত চাপ, P1 = h1ρg
একইভাবে সিলিন্ডারের নিচের পৃষ্ঠ পর্যন্ত পানির গভীরতা h2 এবং নিচের পৃষ্ঠে প্রযুক্ত চাপ, P2 = h2ρg।

ওপরের পৃষ্ঠে ক্রিয়ারত বল, F1 = Ah1ρg (নিচের দিকে)
নিচের পৃষ্ঠে ক্রিয়ারত বল, F2 = Ah2ρg (ওপরের দিকে)
লদ্ধি বল = প্লবতা = FB = A(h2 – h1)ρg = Ahρg = ρVg (ওপরের দিকে)

নিমজ্জিত বস্তুর আপাত ওজন, W’ = W – ρVg
মনে রাখতে হবে, এখানে ρ হলো প্রবাহীর ঘনত্ব, নিমজ্জিত বস্তুর নয়।

বস্তুর ভেসে থাকা ও ডুবে যাওয়া

বস্তুর ওজন নিচের দিকে ক্রিয়া করে, আর প্লবতা ওপরের দিকে। ওজন যদি প্লবতা বল থেকে বেশি হয়, তাহলে বস্তু ডুবে যাবে। প্লবতা ও ওজন সমতায় থাকলে বস্তু ভেসে থাকবে। বস্তুর যে পরিমাণ অংশ নিমজ্জিত হলে সম্পূর্ণ বস্তুর ওজন ও নিমজ্জিত অংশের দ্বারা অপসারিত পানির ওজন সমান হবে, বস্তুটি সে পরিমাণ নিমজ্জিত হলে প্লবতা ও ওজন সমতা তৈরি করবে। একারণে ভেসে থাকা বস্তুর কিছু অংশ নিমজ্জিত থাকে।

পানির থেকে অধিক ঘনত্বের কোন বস্তু পানিতে ডুবে যাবে, আর কম ঘনত্বের বস্তু ভেসে থাকবে। মানুষের গড় ঘনত্ব প্রায় 985 kgm-3। মানুষকে সাঁতার শিখতে হয়, কেননা দেহের সব স্থানে ঘনত্ব সমান না। পানিতে নিরাপদ থাকার জন্য বিশেষ করে মাথাকে ভাসিয়ে রাখার জন্য কৌশল রপ্ত করতে হয়। যখন আমরা শ্বাস গ্রহণ করি, অর্থাৎ ফুসফুসকে বাতাস দ্বারা পূর্ণ করি, তখন আমাদের ঘনত্ব কম হয়। কিন্তু যখন কেউ আতঙ্কিত থাকে, তখন সে পানিতে শ্বাস নিতেতে পারে, তখন বাতাসের পরিবর্তে পানি দ্বারা ফুসফুস পূর্ণ হবে এবং ঘনত্ব বেড়ে যাবে। সমুদ্রের পানির ঘনত্ব বেশি হওয়াতে সমুদ্রে ভেসে থাকা তুলনামূলক সহজ।

লোহার টুকরো যদিও পানিতে ডুবে যায়, লোহার তৈরি নৌযান সাথে অনেক মানুষ নিয়েও ঠিকই ভেসে থাকে। কারণ নৌযানের বড় অংশজুড়ে থাকে বাতাস, যার ফলে সামগ্রিক ঘনত্ব কমে যায়। আবার নৌযানটি ছিদ্র হয়ে গেলে তাতে যখন বাতাসের পরিবর্তে পানি প্রবেশ করতে থাকে, তখন তা ডুবে যেতে শুরু করে।

গাণিতিক প্রশ্ন: একটি কাঠের টুকরোর এবং ঘনত্ব 500 kgm-3। কাঠের টুকরোটি কোন নির্দিষ্ট তরলে দুই-তৃতীয়াংশ নিমজ্জিত অবস্থায় ভেসে থাকে। তরলের ঘনত্ব কত?

উত্তর: ধরা যাক কাঠের টুকরোর আয়তন V ও ঘনত্ব ρ এবং প্রবাহীর ঘনত্ব ρ’। ভেসে থাকতে হলে টুকরোটিকে ওজনের সমপরিমাণ ওজনের প্রবাহীকে অপসারণ করতে হবে।
অর্থাৎ কাঠের টুকরোটির ওজন = দুই-তৃতীয়াংশ আয়তনের প্রবাহীর ওজন
বা, ρVg = ⅔ ρ’Vg
বা, ρ = ⅔ ρ’
বা, ρ’ = ³⁄₂ ρ = ³⁄₂ × 500 kgm-3 = 750 kgm-3

প্যাসকেলের সূত্র (বল বৃদ্ধিকরণ নীতি)

প্যাসকেলের সূত্র: একটা আবদ্ধ পাত্রে তরল বা বায়বীয় পদার্থে বাইরে থেকে চাপ দেওয়া হলে সেই চাপ সমানভাবে সঞ্চালিত হয়ে পাত্রের সংলগ্ন গায়ে লম্বভাবে কাজ করবে।

সূত্রটা প্রথমে বোঝা যাক। ওপরের ছবিতে একটা আবদ্ধ পাত্রে তিনটি সিলিন্ডারের মত রয়েছে, যার মধ্যে একটি করে ওঠানামাক্ষম পিস্টন (কালো হাতলের মত অংশটি) আছে। পাত্রটি তরল দ্বারা পূর্ণ। এখন যদি ওপরের পিস্টনে P চাপ প্রয়োগ করা হয়, পাত্রের গায়ে সর্বত্র এই পরিমাণ চাপ লম্বভাবে প্রযুক্ত হবে। অর্থাৎ অন্য পিস্টনদুটিতেও প্রযুক্ত চাপ P হবে।

এটার একটা চমৎকার দিক আছে। পিস্টনগুলোর প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল সমান না হলেও চাপ সমান প্রযুক্ত হবে। তাই চাপ সমান হলেও যে পিস্টনের ক্ষেত্রফল যত বেশি হবে, সেখানে প্রযুক্ত বল তত বেশি হবে (যেহেতু P = FA)। অর্থাৎ, ছোট ক্ষেত্রফলের পিস্টনে অল্প বল প্রয়োগ করলে বড় পিস্টনে অধিকতর বল প্রযুক্ত হবে।

ওপরের ছবিতে বামদিকের পিস্টনে F1 বল প্রয়োগ করা হয়েছে, এর ক্ষেত্রফল A1 হলে প্রযুক্ত চাপ, P = F1/A1। এখন ডানদিকের পিস্টনেও P চাপ প্রযুক্ত হবে। ধরা যাক এই পিস্টনের ক্ষেত্রফল A2। তাহলে ডানদিকের পিস্টনে প্রযুক্ত বল, F2 = PA2 = (F1/A1) x A2 = (A2/A1) x F1

যদি A1 থেকে A2-এর মান বেশি হয়, তাহলে আমরা কম বল প্রয়োগ করে ফলাফলে বেশি বল পাচ্ছি। এভাবে ক্ষুদ্র বল প্রয়োগ করে অধিক বল পাওয়া যায় বলে একে বল বৃদ্ধিকরণ নীতি বলে। কল কারখানা, বিমান নিয়ন্ত্রণে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর।

প্রথমে মনে হতে পারে এর ফলে শক্তির সংরক্ষণশীলতা লঙ্ঘন হচ্ছে। আসলে না, অন্য পিস্টনে বল বেশি প্রয়োগ হলেও শক্তি সমানই থাকবে। কেননা, W = Fs, ছবিটা দেখে একটু চিন্তা করলেই বুঝবে বামদিকের পিস্টনে যতটা সরণ ঘটবে, ডানদিকের পিস্টনে তার থেকে সরণ কম হবে- তাই শক্তির প্রয়োগ বেশি হবে না।

বিকৃতি, পীড়ন ও স্থিতিস্থাপকতা

বিকৃতি (Deformation)

বিকৃতি: বাইরে থেকে বল প্রয়োগে বস্তুর একক মাত্রায় যে পরিবর্তন ঘটে, তাকে বিকৃতি বলে।

একক মাত্রা বলতে দৈর্ঘ্য, কৌণিক মাত্রা বা আয়তন হতে পারে, যার ওপর নির্ভর করে বিকৃতি তিন প্রকার- দৈর্ঘ্য বিকৃতি, কৃন্তন বিকৃতি ও আয়তন বিকৃতি।

অনুদৈর্ঘ্য বিকৃতি: দৈর্ঘ্য বরাবর বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর একক দৈর্ঘ্যের জন্য দৈর্ঘ্য পরিবর্তনকে অনুদৈর্ঘ্য বিকৃতি বলে। L0 দৈর্ঘ্যের বস্তুর ওপর বল প্রয়োগে l পরিমাণ আয়তন পরিবর্তন হয়ে নতুন আয়তন L হলে,

এখানে ‘~’ চিহ্নটি পার্থক্য বোঝানোর জন্য, অর্থাৎ L ও L0 এর মধ্যে বড়টি থেকে ছোটটির বিয়োগফল।

কৃন্তন বিকৃতি: তলের স্পর্শক বরাবর বল প্রয়োগের ফলে আয়তন ঠিক থেকে আকার পরিবর্তন হলে একক মাত্রার আকার পরিবর্তনকে কৃন্তন বিকৃতি বলে। যেমন, একটা বইকে এক ধার থেকে ধাক্কা দিলে এটা কৌণিকভাবে বিচ্যুত হয়ে সামান্তরিকের মত আকার ধারণ করবে, এটাই কৃন্তন বিকৃতি।

ছবিতে বস্তুটি তলের স্পর্শক বরাবর বল প্রয়োগের θ কোণে বিচ্যুত হয়েছে।

আয়তন বিকৃতি: সবদিক থেকে বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর একক আয়তনের জন্য আয়তন পরিবর্তনকে অনুদৈর্ঘ্য বিকৃতি বলে।

V0 আয়তনের বস্তুর ওপর বল প্রয়োগে v পরিমাণ আয়তন পরিবর্তন হয়ে নতুন আয়তন V হলে,

সমজাতীয় রাশির অনুপাত হওয়াতে বিকৃতির কোন একক নেই

পীড়ন (Stress)

পীড়ন: বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করে বস্তুতে বিকৃতি ঘটালে স্থিতিস্থাপকতার কারণে বিকৃত বস্তুর অভ্যন্তরে প্রতিরোধকারী বলের উদ্ভব হয়। এক্ষেত্রে একক ক্ষেত্রফলে লম্বভাবে উৎপন্ন বলকে পীড়ন বলে। পীড়নের কারণে বিকৃত বস্তু থেকে বল সরিয়ে নিলে তা পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বিকৃতির ধরণের ওপর নির্ভর করে পীড়ন অনুদৈর্ঘ্য পীড়ন, কৃন্তন পীড়ন ও আয়তন পীড়ন হতে পারে।

নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী প্রযুক্ত বল ও প্রতিরোধকারী বল সমান হবে। অর্থাৎ, বস্তুতে প্রযুক্ত চাপের মানকেই পীড়নের মান বিবেচনা করা যায়। বস্তুতে পীড়ন প্রয়োগ করা কথাটা বললে চাপ প্রয়োগ করা-ই বোঝায়।

তবে ধারণাগত দিক থেকে চাপ ও পীড়নের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্থক্য আছে। সর্বপ্রথম- চাপ বাহ্যিকভাবে প্রযুক্ত বল, আর পীড়ন হলো অভ্যন্তরীত উৎপন্ন বল। চাপ সবসময় সংকোচনকারী হয়ে থাকে, পীড়ন সংকোচন বা সম্প্রসারণকারী হতে পারে। চাপ প্রবাহী পদার্থের ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে পীড়নের ধারণা কঠিন পদার্থে সর্বাধিক প্রাসঙ্গিক। পীড়ন কোন একদিকে কাজ করে, চাপ সবদিকে কাজ করে।

শেষের পয়েন্টের পর তোমার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, পীড়ন তাহলে স্কেলার রাশি নাকি ভেক্টর? পীড়ন সাধারণ স্কেলার বা ভেক্টর রাশি থেকে ভিন্নতর, একে ত্রিমাত্রিক টেনসর রাশি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটা নিয়ে আপাতত চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

গাণিতিক প্রকাশে চাপ ও পীড়ন একইরকম। যদি A প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফলের বস্তুতে F বল প্রয়োগে বিকৃতি প্রতিরোধে একই পরিমাণ বল তৈরি হয়, তাহলে,

চাপের অনুরূপভাবে পীড়নের একক প্যাসকেল (Pa) এবং মাত্রা ML-1T-2

টেনশন বা টান বল: পদার্থবিজ্ঞানে টেনশন একটি বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে। সুতা বা তার বা দড়িজাতীয় কিছুকে প্রসারণের ক্ষেত্রে উৎপন্ন প্রতিরোধকারী বলকে টেনশন বলে। যাকে T প্রতীকে প্রকাশ করা হয়।

তাই অনুদৈর্ঘ্য পীড়নের ক্ষেত্রে F-এর পরিবর্তে T লেখা যায়। অনুদৈর্ঘ্য পীড়ন = T/A

প্রসঙ্গত, পীড়নকে গ্রীক বর্ণ σ (সিগমা) ও বিকৃতিকে গ্রীক বর্ণ ε (এপসাইলন) দ্বারা প্রকাশ করা হয় অনেক সময়। তবে নবম-দশম শ্রেণিতে প্রতীক ব্যবহার না করে কথায় লেখা হয়ে থাকে।

স্থিতিস্থাপকতা (Elasticity)

বল প্রয়োগের ফলে একটা বস্তুর স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটে। যেমন একটা রাবারকে টানলে তা প্রসারিত হয়, যেটা একটা বিকৃতি। আবার রাবারটা ছেড়ে দিলে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এই ব্যাপারটা পদার্থের যে ধর্মের কারণে হয়, তা-ই স্থিতিস্থাপকতা।

স্থিতিস্থাপকতা: বল প্রয়োগের ফলে বিকৃত বস্তু থেকে বল সরিয়ে নিলে তার আদি অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সক্ষমতার ধর্মকে স্থিতিস্থাপকতা বলে।

স্থিতিস্থাপকতার একটা সীমা আছে, যা অতিক্রম করলে বস্তুর বিকৃতি স্থায়ী হয়ে যায়, এটা নিজে থেকে আর আগের অবস্থায় ফিরতে পারে না। একটি স্টিলের স্কেলকে একটু বাঁকালে সেটা আবার সোজা হয়ে যাবে, কিন্তু বেশি বাঁকালে সেটা একবারেই বাঁকা হয়ে যাবে।

স্থিতিস্থাপক সীমা: যে সীমা পর্যন্ত পীড়নের পরও বস্তুর সম্পূর্ণরূপে আদি অবস্থানে ফিরে আসার সক্ষমতা বজায় থাকে, তাকে স্থিতিস্থাপক সীমা বলে। সীমার অধিক পীড়ন প্রয়োগ করলে বস্তু স্থায়ীভাবে বিকৃত হয়।

অসহ পীড়ন: স্থিতিস্থাপক সীমা ছাড়িয়ে আরো বেশি পীড়ন প্রয়োগ করলে এক পর্যায়ে বস্তু ভেঙে যায় বা ছিঁড়ে যায়। যে পরিমাণ পীড়ন প্রয়োগে এরূপ ঘটে, তাকে অসহ পীড়ন বলে।

স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি (Elastic Fatigue): বিকৃতি স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে থাকলেও বস্তুর পীড়ন ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকলে এর স্থিতিস্থাপক ধর্মের অবনতি ঘটে। ফলে একটা পর্যায়ে পূর্বের স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে বিকৃতি ঘটলেও তার কিছুটা স্থায়ী থেকে যায়। পদার্থের এই ধর্মকে স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি বলে।

যেমন একটা রাবার যদি বারবার সংকোচন প্রসারণ করতে থাকা হয়, একসময় রাবারের স্বাভাবিক আকৃতি থেকে এটা স্থায়ী প্রসারণ লাভ করে। এটা স্থিতিস্থাপক ক্লান্তির কারণে। শুধু মানুষই ক্লান্ত হয় না, পদার্থও হয়।

পূর্ণ দৃঢ় বস্তু হলো যে বস্তুকে কোন পরিমাণ বল প্রয়োগ করেই বিকৃত করা যায় না। যে বস্তু যেকোন পরিমাণ বল প্রয়োগের পর সরিয়ে নিলে পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরতে পারে, তাকে পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তু বলে। এবং যে বস্তু যেকোন পরিমাণ বিকৃত করলে বল অপসারণের পরও বিকৃতি সম্পূর্ণ বজায় রাখে, তাকে পূর্ণ নমনীয় বা প্লাস্টিক বস্তু বলে। বাস্তবে কোন বস্তুই এর কোনটি শতভাগ নয়।

হুকের সূত্র

হুকের সূত্র: স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে পীড়ন ও বিকৃতি সমানুপাতিক।

বিকৃতির বিপরীতে পীড়ন তৈরি হয়। তাই বিকৃতি বেশি হলে সমানুপাতিক হারে পীড়ন বেশি হবে, কম হলে সমানুপাতিক হারে কম। এটাই হুকের সূত্র। অর্থাৎ, পীড়ন ∝ বিকৃতি বা পীড়ন = ধ্রুবক × বিকৃতি। অর্থাৎ,

পীড়ন ও বিকৃতির অনুপাত এই ধ্রুবকটিকে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক বলা হয়।

ইয়াং এর গুণাঙ্ক (Young’s Modulus)

দৈর্ঘ্য পীড়ন ও দৈর্ঘ্য বিকৃতির ক্ষেত্রে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ককে ইয়াং এর গুণাঙ্ক বলে। নামটা বিজ্ঞানী থমাস ইয়াংয়ের নাম থেকে এসেছে। একে Y দ্বারা প্রকাশ করা হয়। A ক্ষেত্রফলে T টেনশন প্রযুক্ত হওয়াতে L0 আদি দৈর্ঘ্যের বস্তুতে l পরিমাণ দৈর্ঘ্য প্রসারণ ঘটলে,

বিকৃতির একক না থাকাতে ইয়াং এর গুণাঙ্কের একক পীড়নের এককের অনুরূপ- Pa বা Nm-2

আয়তনীয় গুণাঙ্ক বা বাল্ক গুণাঙ্ক (Bulk Modulus)

আয়তনীয় গুণাঙ্ক-কে B দ্বারা প্রকাশ করা হয়। একটা V0 আয়তনের বস্তুর পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল A। এতে সবদিক থেকে পৃষ্ঠতলের সাথে লম্বভাবে F বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। এতে বস্তুটি v পরিমাণ সংকুচিত হলো। আমরা ধরে নিচ্ছি বস্তুর প্রতিরোধকারী বল প্রযুক্ত বলের সমান। তাহলে আয়তনীয় গুণাঙ্ক,

বস্তুর প্রতিরোধকারী বল প্রযুক্ত বলের সমান হওয়াতে পীড়ন প্রযুক্ত চাপ, P-এর সমান হবে। তাহলে,

পদার্থের অবস্থা

পদার্থের অণুকে বিশ্লেষণ করলে পরমাণু ও পরমাণুকে বিশ্লেষণ করলে আরো সূক্ষ্মতর কণা পাওয়া যায়। কিন্তু অণু (মৌলিক পদার্থের ক্ষেত্রে পরমাণু) পর্যন্ত পদার্থের সব গুণাগুণ বজায় থাকে, এর অধিক বিশ্লেষণ করলে তার গুণাগুণ বদলে যায়। যেমন, পানির অণুতে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে, যাদের বৈশিষ্ট্য পানি থেকে ভিন্নতর। একারণে অণুকে পদার্থের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা ক্ষুদ্রতম একক মনে করা যায়।

পদার্থের অণুগুলোর মধ্যে এক ধরণের আকর্ষণ বল কাজ করে, যাকে আন্তঃআণবিক বল বলা হয়। পদার্থের বিভিন্ন অবস্থা অর্জনে আন্তঃআণবিক বল বিশেষভাবে দায়ী।

একই পদার্থ ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন অবস্থায় থাকতে পারে। সাধারণত পদার্থের তিনটি মৌলিক অবস্থার সাথে আমরা পরিচিত- কঠিন, তরল ও গ্যাস। পদার্থের চতুর্থ আরেকটি মৌলিক অবস্থা রয়েছে- প্লাজমা। এর বাইরেও অন্তর্বর্তী কিছু দশা ও বিশেষ শর্তসাপেক্ষে আরো কিছু অবস্থা পদার্থ অর্জন করতে পারে (দেখতে পারো: State of matter)।

পদার্থের আণবিক গতিতত্ত্ব

পদার্থের আণবিক গতিতত্ত্বের মূল কথা হলো পদার্থের অণুগুলো গতিশীল অবস্থায় আছে। কঠিন পদার্থের ক্ষেত্রে অণুগুলো খুবই ঘন-সন্নিবিষ্ট অবস্থায় থাকে, আন্তঃআণবিক বল অত্যন্ত শক্তিশালী হয়- তখন অণুগুলো স্থানচ্যুত হতে পারে না, কিন্তু নিজ স্থানে অল্প বিস্তারে কাঁপতে থাকে। তরল পদার্থের ক্ষেত্রে অণুগুলোর দূরত্ব তুলনামূলক বেশি হয়, তবে এরপরও এতটা আকর্ষণ বল থাকে যে এটার আয়তন নির্দিষ্ট থাকে, কিন্তু সঞ্চারণশীল হওয়াতে আকার আর নির্দিষ্ট থাকে না। গ্যাসের ক্ষেত্রে অণুগুলোর মধ্যে অনেক দূরত্ব থাকে, তাই আন্তঃআণবিক আকর্ষণ না থাকার মত হয়, ফলে তারা সর্বত্র ছুটে বেড়াতে পারে এবং আবদ্ধ পাত্রের পুরোটা দখল করতে পারে।

তরল ও গ্যাসের অণুগুলো এলোমেলো ছুটে বেড়াতে থাকায় নিজেদের মধ্যে ও পাত্রের দেয়ালের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আমরা দেখেছি তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ সবদিকে চাপ প্রয়োগ করে, এটা এই আণবিক গতির কারণে হয়। গ্যাসের অণুগুলো পাত্রের দেয়ালে একটি ভরবেগে এসে আঘাত করে, এবং বিপরীত দিকে, অর্থাৎ অন্য ভরবেগে ফিরে যায়, ফলে পাত্রের দেয়ালে বল প্রযুক্ত হয়। এভাবে অসংখ্য অণু পাত্রের দেয়ালে ক্রমাগত বল প্রয়োগ করতে থাকে এবং এর সম্মিলিত প্রভাবেই গ্যাসের চাপ সৃষ্টি হয়।

তাপমাত্রা বাড়ানো অণুগুলোর কম্পন বা ছুটোছুটি বাড়তে থাকে। কঠিন পদার্থের অণুুগুলোর মধ্যে দূরত্ব তখন বৃদ্ধি পেতে থাকে, পরস্পর আকর্ষণ কমতে থাকে এবং তাপ বাড়াতে থাকলে একসময় তরল অবস্থা প্রাপ্ত হয়। এরপর তাপ আরো বাড়াতে থাকলে অণুগুলো আরো দূরত্বে চলে যেতে থাকে এবং একসময় নির্দিষ্ট আয়তন ধরে রাখার মত আকর্ষণ আর থাকে না, ফলে তা গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হয়।

পদার্থের প্লাজমা অবস্থা

প্রচন্ড তাপ অথবা শক্তিশালী বিদ্যুৎ ক্ষেত্র প্রয়োগে গ্যাসের অণুগুলো আয়নিত হয়ে ধনাত্মক আয়ন ও ইলেকট্রনের একটি মিশ্রণ তৈরি হয়, পদার্থের এই অবস্থাকে প্লাজমা বলে। প্লাজমার ধর্মের সাথে গ্যাসের কিছু মিল রয়েছে, তবে পার্থক্যও আছে। প্লাজমার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো অণুগুলো এখানে আয়নিত অবস্থায় থাকে। প্লাজমা তড়িৎ পরিবাহী ও তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্র উৎপন্ন করে এবং তাড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্রে সবলভাবে প্রতিক্রিয়াশীল।

সূর্য ও নক্ষত্রগুলোতে পদার্থগুলো প্লাজমা অবস্থায় থাকে। বজ্রপাতের সময় দৃশ্যমান আলোও প্লাজমা পদার্থ। টিউব লাইট আর নিয়ন বাতির মাঝেও থাকে প্লাজমা। প্লাজমার ব্যবহার করে হালকা নিউক্লিয়াসকে একত্র করে ফিউশন পদ্ধতিতে শক্তি উৎপাদনের চেষ্টা করা হচ্ছে।


এখন আমরা অনুশীলনীর প্রশ্নগুলো দেখবো। তার আগে সংক্ষেপে আরেকবার প্রয়োজনীয় গাণিতিক সূত্রগুলো একত্র করা যাক। সূত্রগুলো একসাথে বেশ লম্বা একটা তালিকা মনে হতে পারে- কিন্তু ঘনত্ব, চাপ, প্লবতা, স্থিতিস্থাপকতা, বলবৃদ্ধিকরণ নীতি এরকম খুব সহজ কিছু তাত্ত্বিক ধারণা পরিষ্কার থাকলে প্রতিটি সূত্র খুব সহজে নিয়ে আসা যাবে। পদার্থবিজ্ঞান কিন্তু শুধু সূত্র বসিয়ে অঙ্ক করার বিষয় নয়, উপলদ্ধি করার বিষয়।

অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তর

সাধারণ প্রশ্ন

1. বরফের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের প্রায় ১২ ভাগের ১১ ভাগ। তাই বরফ গলে যাওয়া অর্থ ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া। ঘনত্ব বেড়ে গেলে আয়তন কম দখল করবে। তাহলে পানির উচ্চতা কমে যাবে। ঠিক?
ভুল! বরফের সম্পূর্ণটা কিন্তু পানিতে নিমজ্জিত থাকবে না। যেহেতু বরফের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের ১২ ভাগের ১১ ভাগ, তাই আসলে ১২ ভাগের ১১ ভাগ বরফ-ই পানিতে নিমজ্জিত থাকবে। সম্পূর্ণ বরফ গলে যাওয়ার পর তা আগের বরফের আয়তনের ১২ ভাগের ১১ ভাগে পরিণত হবে, কিন্তু যেহেতু এতটা আয়তন-ই আগে পানিতে নিমজ্জিত ছিলো, তাই পানির উচ্চতা সমান থাকবে।

2. জাহাজের আকার বিশাল বলা হয়েছে, বালতির আকার যেহেতু বলা হয়নি, প্রশ্নের মতই সাহিত্যিকভাবে উত্তর দেয়া যায়, বালতির আকার নদী নয়তো সাগরের সমান হতে হবে। প্রশ্নের সাথে সম্ভবত এই উত্তরটাই বেশি যায় বলে মনে হচ্ছে। তবে যাইহোক, এটা সম্ভব- এমনকি এজন্য বালতিকেও বিশাল হওয়ার প্রয়োজন নেই।

প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে একটা বস্তু কখন ভেসে থাকে। পানি থেকে কম ঘনত্বের কোন বস্তু তার ওজনের সম-ওজনের পানির যতটুকু আয়তন, ততটুকু আয়তন পরিমাণ নিমজ্জিত অবস্থায় ভেসে থাকে। আরেকটু সহজভাবে বললে, বস্তুর ঘনত্ব পানির যত অংশ, বস্তুটার তত অংশ পানিতে নিমজ্জিত রাখতে পারলে এটা ভেসে থাকবে।

ধরা যাক আমাদের জাহাজের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের দুই-তৃতীয়াংশ। আলোচনার সুবিধার্থে মনে করছি এই ঘনত্ব উচ্চতা বরাবর সুষম। তাহলে এই জাহাজের পানিতে দুই-তৃতীয়াংশ পরিমাণ নিমজ্জিত করলে তা ভেসে থাকতে পারবে।

এখন কয়েক বালতি পানি দিয়ে কীভাবে একটা জাহাজের দুই-তৃতীয়াংশ নিমজ্জিত রাখা যাবে? এজন্য জাহাজের আকৃতি থেকে খুব সামান্য গ্যাপ রেখে একটা গর্ত খুঁড়তে হবে। এরপর সেখানে জাহাজ রাখার পর যে গ্যাপটুকু থাকবে সেটুকু পানিতে পূর্ণ করলেই তার মধ্যে জাহাজ ভেসে থাকতে পারবে। ছবিতে দেখানো হলো। (সহায়তা)

3. আরেকটা ক্রিটিকাল প্রশ্ন। স্বাভাবিকভাব পাথরের ঘনত্ব পানি থেকে অনেক বেশি। নৌকাটা যেহেতু ডুবে যায়নি সেহেতু পাথর থাকা অবস্থায় নৌকার সামগ্রিক ঘনত্ব পানি থেকে কম। অর্থাৎ নৌকা তার ওজনের সমপরিমাণ পানি অপসারণ করে ভেসে থাকবে। পাথরের জন্য পাথরের ওজনের সমপরিমাণ পানি অপসারিত হবে।

পাথরটি যখন ফেলে দেয়া হলো, তখন পাথরটা ডুবে গেলে তার আয়তনের সমপরিমাণ পানি অপসারণ করবে। প্রশ্নটা হলো পাথরের ওজনের সমপরিমাণ ওজনের পানির আয়তন বেশি নাকি পাথরের আয়তন বেশি? যেহেতু পাথরের ঘনত্ব পানি থেকে বেশি, তাই অবশ্যই পাথরের সমপরিমাণ ওজনের পানির আয়তন পাথরের আয়তন থেকে বেশি হবে।

অর্থাৎ, নৌকায় থাকা অবস্থায় পাথরের জন্য অপসারিত পানির পরিমাণ ফেলে দেয়ার পর অপসারিত পানির পরিমাণ থেকে বেশি ছিলো। পানি যত বেশি অপসারণ করবে, পানির উচ্চতা তত বেশি হবে। তাই পাথর ফেলে দেয়ার পর যেহেতু পানি অপসারণ কম হচ্ছে, এজন্য পানির উচ্চতা কমে যাবে। (সহায়তা)

4. পেরেকের বিছানায় শুয়ে থাকার পেছনে আধ্মাত্মিকতা নয়, মূলত রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান- সাথে সতর্কতারও প্রয়োজন আছে। খাড়া অবস্থায় থাকা একটি পেরেকে পা পড়লে দেহের সম্পূর্ণ বা বড় অংশের ওজন তার ওপর পড়ে, এবং পেরেকের সুঁচালো অগ্রভাগের কারণে তা পায়ে ঢুকে যেয়ে বড়রকম আহত করতে পারে। তবে পেরেকের বিছানায় ঘন সন্নিবিষ্টভাবে অনেক পেরেক থাকায় তাদের সামগ্রিক ক্ষেত্রফল বেশি হয় এবং এর ওপর যথাযথভাবে শুলে দেহের ওজন পুরো ক্ষেত্রফলে ছড়িয়ে পড়ায় চাপ কম হয়, তাই পেরেক আহত করতে পারে না। তবে যদি সুষম বিন্যাস না হয়ে কোন পেরেকের উপরে বেশি চাপ পড়ে, বা পেরেকগুলো উঁচু-নিচু থাকলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।

5. চাপ ক্ষেত্রফলের ওপর নির্ভর করে না। নলের ভেতর পারদ স্তম্ভের উচ্চতা-ই এখানে বিবেচ্য বিষয়। কাজেই নল আঁকাবাঁকা হলেও সমস্যা নেই।

6. চাপ হলো একক ক্ষেত্রফলে লম্বভাবে প্রযুক্ত বল। এদের সম্পর্ক, F = PA সমীকরণের মাধ্যমে দেখানো যায়।

7, 8, 9, 10 এর উত্তর তাত্ত্বিক অংশের আলোচনার মধ্যে সরাসরি এসেছে।

গাণিতিক প্রশ্ন

বাতাস একটা প্রবাহী। সোনাকে এক্ষেত্রে আমরা বাতাসে নিমজ্জিত চিন্তা করতে পারি। এখানে বাতাসের কারণে একটা ঊর্ধ্বমুখী বল বা প্লবতা কাজ করবে। বাতাসের ঘনত্ব অনেক কম বলে সাধারণত এই প্লবতা আমরা উপেক্ষা করি, কিন্তু এই প্রশ্নের ক্ষেত্রে এটা নিয়েই কাজ কাজ করতে হবে।

তবে আরেকটা ‘কিন্তু’ আছে। ভর কী ধরণের নিক্তিতে মাপা হয়েছে তা প্রশ্নে বলা হয়নি। যদি দাঁড়িপাল্লা-বাটখারার সাহায্যে মাপা হয়, তবে বাটখারার প্রকৃত ভর, বাটখারা ও স্বর্ণের আয়তনের ভিত্তিতে উভয়ের ওপর প্রযোজ্য প্লবতা বিবেচনা করতে হবে।

অন্যদিকে যদি স্প্রিং নিক্তি জাতীয় কিছু ব্যবহার হয়, তবে সেখানে মূলত ওজনের পরিমাপ থেকে ভর নির্ণীত হয়। এক্ষেত্রে মাপকৃত ভর ও প্রকৃত ভর ভিন্ন হবে। ধরে নিচ্ছি এখানে স্প্রিং নিক্তি ব্যবহার হয়েছে।

স্বর্ণের আপাত ভর, m’ = 1 kg = 1000 g
স্বর্ণের ঘনত্ব, ρg = 0.0012 gm/cm3
বাতাসের ঘনত্ব, ρa = 19.30 gm/cm3
স্বর্ণের প্রকৃত ভর m হলে স্বর্ণের আয়তন, V = m / ρ

আমরা জানি,
W’ = W – FB
বা, m’g = mg – ρVg
বা, m’ = m – ρV
বা, m’ = m – ρa (m / ρg)
বা, m’ = m (1 – ρa / ρg)
বা,
বা,
বা, m = 1000.0622 g = 1.0000622 kg

প্রশ্নে কিছু বলা না থাকলে আমরা সাধারণভাবে বায়ুমন্ডলীয় চাপ তথা 1 atm বা 101325 Pa চাপ বিবেচনা করব। কেরোসিনের ঘনত্ব, ρ = 0.8 gm/cm3 = 800 kg/m3

আমরা জানি,
P = hρg
বা, 101325 Pa = h × 800 kg/m3 × 9.8 ms-2
বা, h = 12.924 m

অর্থাৎ, কেরোসিন ব্যবহার করলে স্তম্ভের উচ্চতা হবে 12.924 m।

খাঁটি সোনা ও সোনার মুকুটের প্রকৃত ওজন সমান। কিন্তু পানিতে ডোবানোর পর খাঁটি সোনা অপেক্ষা মুকুটের আপাত ওজন কম। অর্থাৎ এর ওপর অধিক প্লবতা কাজ করছে, যা নির্দেশ করছে এর আয়তন বেশি। কাজেই এতে খাদ মেশানো আছে।

70 kg মানুষের ওজন, W = 70 kg * 9.8 ms-2 = 686 N

ওজন একটা বল যা নিচের দিকে কাজ করে। ওপরের দিকে এর থেকে অধিক বল প্রয়োগ করলে মানুষটিকে ওপরে ওঠানো যাবে। বড় পিস্টনে F2 = 686 N বল পাওয়ার জন্য ছোট পিস্টনে প্রযোজ্য বল,

F2 = (A2 / A1) × F1
বা, 686 N = (1 m2 / 0.0001 m2) × F1
বা, F1 = 0.0686 N

তাহলে ছোট পিস্টনে 0.0686 N থেকে বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে।

বেশ অদ্ভুত না? ছোট পিস্টনের তুলনায় বড় পিস্টনে আমরা 10000 গুণ বল পাচ্ছি! এখানে একটা ব্যাপার কিন্তু আছে, ছোট পিস্টন আমি যতটা নিচে নামাবো, বড় পিস্টন তার শুধু 10000 ভাগের 1 ভাগ ওপরে উঠবে। তাই ছোট পিস্টনে কৃত কাজ আর বড় পিস্টনে প্রাপ্ত কাজ সমান হবে, শক্তির সংরক্ষণশীলতা লঙ্ঘন হবে না।

প্রযোজ্য টেনশন, T = 10 kg * 9.8 ms-2 = 98 N
দৈর্ঘ্য পরিবর্তন, l = 0.501 m – 0.5 m = 0.01 m

ইয়াং এর মডুলাস,

বা, Y = (98 N × 0.5 m) / (0.01 m2 × 0.01 m) = 490000 Pa

সৃজনশীল প্রশ্ন

ছবিতে দেখা যাচ্ছে বস্তুটি পানিতে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত অবস্থায় ভেসে আছে। পানিতে নিমজ্জিত বস্তুর ওপর ঊর্ধ্বমুখী বল বা প্লবতা কাজ করে বলে পানি অপেক্ষা কম ঘনত্বের বস্তু ভেসে থাকতে পারে। ভেসে থাকতে হলে একে ততটা নিমজ্জিত থাকতে হয় যতটা নিমজ্জিত হলে সম্পূর্ণ বস্তুর ওজন ও নিমজ্জিত অংশের দ্বারা অপসারিত পানির ওজন সমান হয়। সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে ভেসে থাকা অর্থ বস্তুর ওজন ও সমআয়তনের পানির ওজন সমান। এখান থেকে বস্তুর ঘনত্বও আমরা পেয়ে যাবো- অর্থাৎ এর ঘনত্ব পানির ঘনত্বের সমান হবে- 1000 kgm-3

তাপমাত্রা বাড়ানোর সাথে তাপমাত্রা বাড়ানোর সাথে অণুগুলোর কম্পন বাড়তে থাকে এবং তাদের পরস্পর দূরত্ব বাড়তে থাকে, ফলে পদার্থের প্রসারণ ঘটে। পানির তাপমাত্রা 4°C থেকে বৃদ্ধি করতে থাকলে পানির আয়তন বৃদ্ধি পাবে, অর্থাৎ ঘনত্ব কমতে থাকবে। কঠিন পদার্থের প্রসারণ অপেক্ষা তরলের প্রসারণ সচারচর বেশি। এখন যেহেতু বস্তুর ঘনত্ব পানির ঘনত্বের সমান, অর্থাৎ বলা যায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি করলে পানির ঘনত্ব অধিকতর কমে যাওয়াতে বস্তুর ঘনত্ব পানির ঘনত্ব থেকে বেশি হয়ে যাবে, তাই বস্তুটি ডুবে যাবে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে করতে 100°C-এ পৌঁঁছে গেলে পানির অণুগুলোর দূরত্ব এতটা বেড়ে যাবে যে তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট আয়তন ধরে রাখার মত আকর্ষণ থাকবে না। ফলে পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে উড়ে যাবে।

[পানির ঘনত্ব ঋণাত্মক বা 0°C তাপমাত্রার পরিবর্তে 4°C তাপমাত্রায় সর্বাধিক হয় কেননা এর সাথে পানির অণুর আণবিক গঠন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাব রয়েছে]

‘খ’ নং প্রশ্নের বিবৃতি একটু কনফিউজিং। বরং পীড়ন হলো বাঁধাদানকারী বল, যা বিকৃতির ফলে বস্তুর অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয় এবং পীড়নের কারণে বল সরিয়ে নিলে বিকৃত বস্তু পূর্বাবস্থায় ফিরে আসার প্রবণতা দেখায়। যাইহোক, প্রযুক্ত বল আর পীড়ন যেহেতু মানের দিক থেকে সমান, তাই প্রযুক্ত বলকে পীড়ন হিসেবে চিন্তা করে পীড়ন ও বিকৃতির সমানুপাতিক সম্পর্ক থেকে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যেতে পারে।

‘গ’ প্রশ্নে আসি। বস্তুর ওজন এখানে পীড়ন হিসেবে প্রযুক্ত হচ্ছে, তাই পীড়ন ভরের সমানুপাতিক হবে। টেবিল থেকে দেখা যাচ্ছে 3 kg পর্যন্ত ভর যুক্ত করলে বস্তু সম্পূর্ণরূপে আগের অবস্থায় ফিরতে পারে। তাই 2.7 kg ভর যুক্ত করাতে প্রযুক্ত বল স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে হবে।

যেহেতু স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে পীড়ন ও বিকৃতি সমানুপাতিক, তাই 0.4 kg থেকে 3 kg এর মধ্যে যেকোন একটি ভরের জন্য বিকৃতির সাথে তুলনা করে 2.7 kg ভরের জন্য বিকৃতি বের করা যাবে, অনেকটা সরল অঙ্কের মত।

3 kg ভরের জন্য- পীড়ন = 3 kg * 9.8 ms-2 = 29.4 N এবং বিকৃতি = (25 m – 10 m) / 10 m = 1.5
2.7 kg ভরের জন্য- পীড়ন = 2.7 kg * 9.8 ms-2 = 26.46 N এবং তাহলে, বিকৃতি = (26.46/29.4) * 1.5 = 1.35

‘ঘ’ প্রশ্নে আসা যাক। সংযুক্ত ভরের সাথে সমানুপাতিক হারে বিকৃতি ঘটছে। এই বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে ‘ঘ’ প্রশ্নের জন্য সহজেই একটা ব্যালেন্স বা ভর মাপার যন্ত্র তৈরি করা যাবে, যেটা 3 kg পর্যন্ত ভর মাপার উপযুক্ত হবে। পেরেক থেকে 10 cm নিচে 0 ভরের দাগ দিতে হবে। তারপর টেবিল অনুযায়ী বিভিন্ন ভরের জন্য দাগ দেয়া যেতে পারে। 12 cm নিচে 0.4 kg, 15 cm নিচে 1 kg এরকম।

অথবা আরেকটু নিয়মিতভাবে দাগগুলো দিতে চাইলে সহজেই আমরা বের করতে পারি মূলত প্রতি 3 kg পর্যন্ত প্রতি 0.1 kg ভরের জন্য সুতার দৈর্ঘ্য 0.5 cm করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই প্রতি 10 cm এর পর প্রতি 0.5 cm 0.1 kg করে ভর বৃদ্ধি করে দাগগুলো দেয়া যেতে পারে। এটুকু বুঝলে নকশা আঁকতে কোন সমস্যা হবে না আশা করি!


পদার্থবিজ্ঞান প্রকৃতির রহস্যকে উদঘাটন ও প্রকৃতির নিয়মকে জানা ও প্রয়োগের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাটাও আসলে ধাপে ধাপে হয়েছে। মানুষ কোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করে একভাবে হয়ত সেটাকে ব্যাখ্যা করেছে, তারপর যখন তা নিয়ে নতুন কোন সমস্যার মুখোমুখী হয়েছে, তখন নতুনভাবে চিন্তার অবকাশ পেয়েছে।

দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম অধ্যায় পর্যন্ত আমরা ক্লাসিকাল বলবিদ্যার ধারণাগুলোর ভিত্তিতে শিখেছি। আমরা যা পড়ছি, তা অনেকসময়ই কিছুটা সরলীকৃত, অনেকসময়ই এর প্রয়োগক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতা আছে। ক্লাসিকাল বলবিদ্যার সীমাবদ্ধতা ছিলো বলেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্ম হয়েছে। তবে দৈনন্দিন আমরা যে ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হই, নিউটনীয় বলবিদ্যার নীতিগুলো তার প্রায় সবই ব্যাখ্যা করতে পারে। এই ধারণাটুকু অনেক জায়গাতে সরাসরি প্রয়োগযোগ্য, আর তার সাথে আরো উচ্চতর পড়াশোনা করতে চাইলে এই বিষয়গুলোই তার ভিত্তিপ্রস্থর গড়ে দিবে।

সহায়তা

  • নবম-দশম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তক
  • HSC পদার্থবিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তক – বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও লেকচার পাবলিকেশন্স
  • Quora
  • Wikipedia
  • https://blog.prepscholar.com/
  • https://banglate.co
  • এবং আরো…
Series Navigation<< নবম-দশম শ্রেণি – পদার্থবিজ্ঞান – চতুর্থ অধ্যায়: কাজ, ক্ষমতা ও শক্তিনবম-দশম শ্রেণি – পদার্থবিজ্ঞান – ষষ্ঠ অধ্যায়: বস্তুর ওপর তাপের প্রভাব (প্রথম অংশ) >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *