নবম-দশম শ্রেণি – পদার্থবিজ্ঞান – ষষ্ঠ অধ্যায়: বস্তুর ওপর তাপের প্রভাব (প্রথম অংশ)

This entry is part 7 of 7 in the series এসএসসি পদার্থবিজ্ঞান

পদার্থবিজ্ঞানের শাখাগুলোর মধ্যে তাপগতিবিদ্যা অন্যতম। ‘বস্তুর ওপর তাপের প্রভাব’ অধ্যায়টিকে আমরা তাপগতিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। যদিও তাপগতিবিদ্যার মূল আলোচনায় এসএসসি পর্যায়ে সেভাবে যাওয়া হবে না, তাপ ও তাপমাত্রা সংক্রান্ত কিছু প্রাথমিক ধারণা নিয়ে কথা হবে এখানে।

আগের চারটি অধ্যায়ের আলোচনা মূলত বলবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তবে তাপগতিবিদ্যা সংক্রান্ত খুব প্রয়োজনীয় কিছু ধারণা কিন্তু আমরা সেখানে নিজেদের অজান্তেই পেয়েছি, যেমন- গতি, শক্তি, কাজ এই ধারণাগুলো এখানে দরকার হবে। বিশেষ করে আগের অধ্যায়ের পদার্থের আণবিক গতিতত্ত্ব অংশটুকু আরেকবার দেখে নিতে পারো, বেশ প্রাসঙ্গিক এখানে।

তাপ, তাপশক্তি ও তাপমাত্রা

অভ্যন্তরীণ শক্তি: পদার্থের কণাগুলোর গতি ও এদের মধ্যকার বিভিন্ন বলের কারণে একটা বস্তুতে কিছু শক্তি নিহিত থাকে, যাকে পদার্থের অভ্যন্তরীণ শক্তি বলে।

অভ্যন্তরীণ শক্তির একটা অংশ হলো তাপশক্তি, যে শক্তির কারণে আমরা তাপ অনুভব করি। আসলে এই তাপশক্তি আলাদা কিছু নয়, একটা বস্তুর কণাগুলোর সম্মিলিত গতিশক্তি-ই তাপশক্তি, অর্থাৎ গতিশক্তির কারণেই আমরা তাপ অনুভব করি।

তাপ আর তাপশক্তি কথাদুটো প্রায় একই অর্থে ব্যবহার হয়। তবে এদের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে। তাপ হলো এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে যেটুকু তাপশক্তি স্থানান্তরিত হয়।

যখন একটা বস্তু আমরা স্পর্শ করি, তখন যদি আমাদের দেহ থেকে সেখানে তাপশক্তি স্থানান্তরিত হয়, তবে আমরা শীতল অনুভব করি- আর যদি বস্তু থেকে আমাদের দেহে তাপশক্তি স্থানান্তরিত হয়, তখন তখন গরম অনুভব করি।

তাপশক্তির সঞ্চালন তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। দুটো বস্তু যখন পরস্পরের সংস্পর্শে রাখা হয়, তখন বস্তুদুটো একই তাপমাত্রার হলে তাদের মধ্যে তাপশক্তির কোন আদান-প্রদান হবে না। অন্যদিকে ভিন্ন তাপমাত্রার হলে বেশি তাপমাত্রার বস্তু থেকে কম তাপমাত্রার বস্তুতে তাপ স্থানান্তর হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সমান তাপমাত্রায় উপনীত হচ্ছে।

তাপমাত্রাকে তাহলে বলা যায়, তাপমাত্রা হলো বস্তুর তাপীয় অবস্থা যা নির্ধারণ করে সংস্পর্শে থাকা দুটো বস্তুর মধ্যে তাপের আদান-প্রদান কীরূপ হবে।

তাপশক্তি পরিমাপের জন্য আমরা তাপমাত্রার ধারণা ব্যবহার করি। তবে তাপমাত্রা আর তাপশক্তি পুরোপুরি এক জিনিস নয়। তাপশক্তি বস্তুর ভরের ওপর নির্ভর করে, একই তাপমাত্রার দুটো বস্তুর মধ্যে যার ভর বেশি, তার মোট তাপশক্তি বেশি হবে।

একারণে অধিক তাপশক্তির বস্তু থেকে কম তাপশক্তির বস্তুতে তাপের স্থানান্তর ঘটতে পারে, যদি তাদের তাপমাত্রা ভিন্ন হয়।

আরেকবার একনজরে দেখে নেয়া যাক-

তাপশক্তি: কোন বস্তুর কণাগুলোর সম্মিলিত গতিশক্তি।
তাপ: এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে সঞ্চালিত তাপশক্তি।
তাপমাত্রা: বস্তুর তাপীয় অবস্থা যা নির্ধারণ করে সংস্পর্শে থাকা দুটো বস্তুর মধ্যে তাপের আদান-প্রদান কীরূপ হবে।

পদার্থের তাপমাত্রিক ধর্ম

কিছু পদার্থের ক্ষেত্রে এমন কিছু ধর্ম দেখা যায়, যেগুলো তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে নিয়মিতভাবে পরিবর্তন হয় এবং সহজে ও সূক্ষ্মভাবে তা পরিমাপ করা যায়। যেমন জ্বর মাপার জন্য ব্যবহৃত থার্মোমিটারে থাকা পারদের কথা চিন্তা করতে পারি। তাপমাত্রা বৃদ্ধি করলে পারদের নিয়মিত হারে প্রসারণ হয় এবং সে অনুযায়ী থার্মোমিটারের গায়ে কাটা দাগের সাথে মিলিয়ে আমরা জ্বর মাপতে পারি।

তাপমাত্রিক ধর্ম: পদার্থের যে ধর্ম ব্যবহার করে তাপমাত্রা পরিমাপ করা যায়।

তাপমাত্রিক ধর্মের বৈশিষ্ট্য হলো তাপমাত্রার সাথে পরিবর্তন নিয়মিতভাবে হয়, এবং তা সহজে ও সূক্ষভাবে পরিমাপ করা যায়।

তাপমাত্রিক পদার্থ: যে পদার্থের তাপমাত্রিক ধর্ম ব্যবহার করে তাপমাত্রা পরিমাপ করা যায়।

থার্মোমিটার: যে যন্ত্র ব্যবহার করে তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়।

পারদ থার্মোমিটারের ক্ষেত্রে পারদ হলো তাপমাত্রিক পদার্থ এবং আয়তন প্রসারণ হলো তাপমাত্রিক ধর্ম। অন্যান্য থার্মোমিটার ভিন্ন তাপমাত্রিক পদার্থ বা তাপমাত্রিক ধর্ম ব্যবহার করে কাজ করে।

বিভিন্ন পদার্থের তাপমাত্রিক ধর্ম ভিন্ন পরিসরে তাপমাত্রা পরিমাপে ব্যবহারযোগ্য হয়ে থাকে। যেমন পারদের হিমাঙ্ক ও স্ফূটনাঙ্ক যথাক্রমে -39°C ও 356°C। তো -39°C থেকে কম তাপমাত্রা বা 356°C থেকে বেশি তাপমাত্রা পারদের আয়তন ব্যবহার করে মাপা যায় না।

বিভিন্ন ধাতুর রোধ তাপমাত্রিক ধর্ম হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। ইন্ডাস্ট্রিতে থার্মোকাপল তাপমাত্রা পরিমাপে জনপ্রিয়, কেননা এটা ব্যবহার করে-200°C থেকে 1000°C পর্যন্ত বিস্তৃত সীমায় তাপমাত্রা পরিমাপ করা যায়। থার্মোকাপল দুটো ভিন্ন ধাতুর সমন্বয়ে তৈরি হয়, যেমন তামা এবং কনস্টান্টেন। তাপমাত্রার পরিবর্তনে দুটো ভিন্ন ধাতুর সংযোগস্থলে একটা ই.এম.এফ তৈরি হয়, যা থেকে তাপমাত্রা মাপা যায়। ই.এম.এফ হলো Electromotive Force বা তড়িচ্চালক শক্তি, কোন বৈদ্যুতিক উৎস থেকে উৎপন্ন ভোল্টেজ।

তাপমাত্রা: কঠিন কিছু কথা

এখানে কিছু কঠিন কথা আনা হবে, যেটা বোঝা, সত্যি বলতে একটু কঠিন। তোমাকে একটু মনযোগের সাথে বোঝার চেষ্টা করতে হবে, তাহলে ইন শা আল্লাহ বুঝতে পারবে।

তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য বিভিন্ন স্কেল রয়েছে। যেমন জ্বর আমরা সাধারণত ফারেনহাইট স্কেলে পরিমাপ করি, কিন্তু আবহাওয়ার ক্ষেত্রে তাপমাত্রা পরিমাপে বাংলাদেশে সেলসিয়াস বেশি জনপ্রিয়। আরেকটি স্কেল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কেলভিন স্কেল। কেলভিন হলো তাপমাত্রা পরিমাপের আন্তর্জাতিক একক।

তাপমাত্রা পরিমাপের স্কেল দুরকম হতে পারে- আপেক্ষিক স্কেল ও পরম স্কেল। সেলসিয়াস ও ফারেনহাইট আপেক্ষিক স্কেল- কিন্তু কেলভিন পরম স্কেল।

আপেক্ষিক স্কেল

আপেক্ষিক স্কেল তৈরিতে তাপমাত্রার দুটো স্থির বিন্দু বা স্থিরাঙ্ক নির্ধারণ করে নিতে হয়, যার একটি নিম্ন স্থির বিন্দু বা নিম্ন স্থিরাঙ্ক, অন্যটা ঊর্ধ্ব স্থির বিন্দু বা ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক। নিম্ন স্থিরাঙ্ক হিসেবে পানির হিমাঙ্ক আর ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক হিসেবে পানির স্ফূটনাঙ্ক নেয়া হয়। এরপর এদের মাঝের তাপমাত্রাকে কিছু সংখ্যক ভাগে ভাগ করা হয়।

বিন্দু কথাটা পরবর্তী আলোচনায় অনেকবার এসেছে। তো এখানে বিন্দু বলতে সিম্পলি বোঝাচ্ছি কোন নির্দিষ্ট তাপমাত্রা। যেমন সেলসিয়াস স্কেলে 36.89°C আর ফারেনহাইট স্কেলে 98.4°F একই তাপমাত্রা নির্দেশ করে, তো এরকম একই তাপমাত্রা বোঝাতে আমরা বিন্দু টার্মটা ব্যবহার করেছি।

যেমন সেলসিয়াস স্কেলের ক্ষেত্রে সাধারণ বায়ুমন্ডলীয় চাপে পানি যে তাপমাত্রায় বরফ হয় সেটাকে নিম্ন স্থিরাঙ্ক আর যে তাপমাত্রায় ফুটতে শুরু করে সেটাকে ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক ধরে নেয়া হয়, আর মাঝের তাপমাত্রাকে ১০০ ভাগে ভাগ করা হয়। এরপর নিম্ন স্থিরাঙ্ককে আমরা বলি 0°C আর ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ককে 100°C, আর প্রতিটি ভাগকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হিসেবে চিন্তা করি।

শুধু সেলসিয়াস না বলে যে আমরা ডিগ্রি সেলসিয়াস বলি, এটার কারণও এখানে আছে। যেহেতু আমরা একটা তাপমাত্রার পরিসরকে কিছু ভাগে ভাগ করছি, প্রতিটা ভাগকে আমরা ডিগ্রি দিয়ে চিহ্নিত করি।

ফারেনহাইট স্কেলের ব্যপারটাও একইরকম, এখানেও পানির গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক যথাক্রমে নিম্ন স্থিরাঙ্ক ও ঊর্ধ স্থিরাঙ্ক। কিন্তুু নিম্ন স্থিরাঙ্কের তাপমাত্রাকে 32°F আর ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্কের তাপমাত্রাকে 212°F নেয়া হয় আর মাঝের তাপমাত্রাকে 180 ডিগ্রিতে ভাগ করা হয়।

পরম স্কেল

কেলভিন স্কেলের গল্পটা একটু ভিন্ন। এখানে শুধু একটা স্থির বিন্দু নেয়া হয়, পানির ত্রৈধ বিন্দু। কেলভিন স্কেলের সংজ্ঞা এভাবে দেয়া যায়, পানির ত্রৈধ বিন্দুর তাপমাত্রার 273.16 ভাগের একভাগ হলো 1 কেলভিন। ছোট্ট এই সংজ্ঞাটা কিন্তু অনেকগুলো কথা বহন করে।

প্রথমে পানির ত্রৈধ বিন্দু ব্যাপারটা বোঝা যাক। স্বাভাবিকভাবে, 1 atm বা এক বায়ুমন্ডলীয় চাপে বরফ আর জলীয় বাষ্প একই তাপমাত্রায় থাকতে পারে না। কিন্তু পারিপার্শ্বিক চাপ যদি অনেক কমানো হয়, তখন পানির স্ফূটনাঙ্ক অনেক কমে যায়, অন্যদিকে গলনাঙ্ক সামান্য বাড়তে থাকে। এমনকি 0.0060373 atm চাপে এসে পানির স্ফূটনাঙ্ক আর গলনাঙ্ক দুটোই এক হয়ে যায়। অর্থাৎ এই চাপে পানি একই তাপমাত্রায় বরফ, বাষ্প ও তরল পানি সব অবস্থায় থাকতে পারে। এটাকেই আমরা বলি পানির ত্রৈধ বিন্দু। পানির ত্রৈধ বিন্দুর দৃশ্যটা খুব ইন্টেরেস্টিং, এটা নিয়ে আরো জানতে পারবে এখান থেকে।

এখন আপেক্ষিক স্কেলগুলোতে আমরা দুটো স্থির বিন্দুর কথা বলেছিলাম, কিন্তু এখানে শুধু একটা বিন্দুর কথা বলছি। সমস্যাটা ধরতে পারছো? সেলসিয়াস স্কেল বা ফারেনহাইট স্কেলে আমরা দুটো তাপমাত্রাকে স্থির রেখে মাঝের তাপমাত্রাগুলোকে ভাগ করেছিলাম, কিন্তু শুধু একটা স্থির তাপমাত্রাকে অর্থবোধকভাবে ভাগ করা সম্ভব কীভাবে?

এখন (যখন লিখছি) নভেম্বর মাস শেষের দিকে, শীত পড়ছে ধীরে ধীরে। শীত বলে কিন্তু আলাদা কিছু নেই, তাপের অনুপস্থিতিই শীত- যেমন আলোর অনুপস্থিতিই আঁধার। তাহলে শীতের একটা সীমা আছে, যদি তাপ একদমই না থাকে, তাহলে যে তাপমাত্রা হবে, তার থেকে কম তাপমাত্রা সম্ভব না, ঠিক? এই তাপমাত্রাকে আমরা বলি পরম শূন্য তাপমাত্রা।

কেলভিন স্কেলে পরম শূন্য তাপমাত্রাকেই শূন্য ধরা হয়। পানির ত্রৈধ বিন্দুর যেই তাপমাত্রা, সেটার 273.16 ভাগের এক ভাগ তাপমাত্রাকে 1 K ধরা হয়। এভাবে পানির ত্রৈধ বিন্দুর তাপমাত্রা পাওয়া যায় 273.16 K।

কেলভিন স্কেলের বিশেষত্ব হলো এখানে 0 K মানে সত্যিকার অর্থেই তাপের অনুপস্থিতি। 2 K তাপমাত্রা মানে 1 K এর দ্বিগুণ তাপমাত্রা। এজন্য কেলভিন স্কেলে পরিমাপকৃত তাপমাত্রার সাথে ‘ডিগ্রি’ ব্যবহার হয় না। কিন্তু সেলসিয়াস বা ফারেনহাইট স্কেলের বেলায় এর কোনটাই সত্য নয়।

তাপমাত্রার যোগ-বিয়োগ

এই অংশটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বলেছি সেলসিয়াস স্কেলে পানির স্ফূটনাঙ্ক 0°C ও ফারেনহাইট স্কেলে 32°F, রাইট? তাহলে বলা যায় 0°C = 32°F। এই পর্যন্ত সমস্যা নেই, কিন্তু যদি আমি বলি 0°C + 0°C = 32°F + 32°F = 64°F তাহলে কী হবে? নিশ্চয়ই একটা সমস্যা আছে এখানে, কারণ 0°C + 0°C = 0°C হওয়ার কথা, মানে 32°F, তাই না?

বুঝতে হবে যে তাপমাত্রার যোগ-বিয়োগের ব্যাপারটা এরকম না। বিশেষ করে মনে রাখতে হবে সেলসিয়াস স্কেল ও ফারেনহাইট স্কেল আসলে দুটি আপেক্ষিক স্কেল। সেলসিয়াস স্কেলে 0°C মানে আসলে তাপমাত্রাহীনতা নয়, কিংবা 32°F থেকে 64°F দ্বিগুণ তাপমাত্রা নয়।

তাপমাত্রার যোগ-বিয়োগ বীজগণিতের মত হবে না। আমরা কী অর্থে নিচ্ছি তার ওপর নির্ভর করবে। তাপমাত্রা যোগ-বিয়োগ করার একটা লজিকাল উপায় হলো কেলভিন স্কেলে কনভার্ট করে নেয়া, কারণ এটা পরম স্কেল। যেমন 0°C মানে 273.15K, 0°C+0°C হলো 546.32K বা 273.15°C বা 546.31°F।

আবার কখনো কখনো আমরা যোগ বিয়োগ বলতে তাপমাত্রার হ্রাস বৃদ্ধি বোঝাই। যেমন 1°C বৃদ্ধি মানে আগে যে মান ছিলো তার থেকে 1 বৃদ্ধি পাবে। এই অর্থে নিলে 0°C + 0°C = 0°C বলা যাবে। এটা আসলে তাপমাত্রার পার্থক্যকে যোগ করা। যেমন 21°C আর 22°C এর পার্থক্য যতটুকু, 10°C আর 11°C এর পার্থক্যও ততটুকু, তো 1°C বৃদ্ধি মানে এই পার্থক্যের পরিমাণটুকু যোগ করা।

একটু পর যখন গাণিতিক সম্পর্ক দেখবো, তখন দেখা যাবে 1°C বৃদ্ধি আর 1 K বৃদ্ধি দুটো সমান, কিন্তু ফারেনহাইট স্কেলের ক্ষেত্রে তা 1.8°F বৃদ্ধির সমতূল্য।

আরো জানতে পারবে এখানে

বিভিন্ন স্কেলের সম্পর্ক

একটা সহজ কথা এখানে মনে রাখতে হবে, তাপমাত্রার যেকোন স্কেলে ভিন্ন ভিন্ন দুটো বিন্দুর তাপমাত্রার অনুপাত সমান। সাধারণত আমরা নিম্ন স্থির বিন্দু (হিমাঙ্ক), ঊর্ধ্ব স্থির বিন্দু (স্ফূটনাঙ্ক) এবং আরেকটা বিন্দুকে চলক হিসেবে নিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করি।

পানির হিমাঙ্কের তাপমাত্রা সেলসিয়াস স্কেলে 0°C, ফারেনহাইট স্কেলে 32°F এবং কেলভিন স্কেলে 273.15 K। অন্যদিকে পানির স্ফূটনাঙ্কের তাপমাত্রা স্কেলগুলোতে যথাক্রমে 100°C, 212°F ও 373.15 K। শুধু এটুকু তথ্য থেকেই আমরা স্কেলগুলোর সম্পর্ক বের করতে পারবো এবং এদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবো।

ছবিতে আমরা তিনটা থার্মোমিটার দেখতে পাচ্ছি, তিনটা একইরকম, কিন্তু ভিন্ন স্কেলে দাগ কাটা আছে। সব স্কেলে গলনাঙ্ক আর স্ফূটনাঙ্কের তাপমাত্রা একই বরাবর থাকবে। কিন্তু বর্তমানে থার্মোমিটার তিনটি পাঠ দিচ্ছে যথাক্রমে TC, TK ও TF, যেগুলোর মান আমাদের কাছে অজানা, তবে এরা একই বরাবর আছে, অর্থাৎ, একই তাপমাত্রা নির্দেশ করে।

এখানে 100°C থেকে 0°C পর্যন্ত আর 212°F থেকে 32°F পর্যন্ত তাপমাত্রার ব্যবধান একই। তাহলে লেখা যায় 100°C – 0°C = 212°F – 32°F। একইভাবে, TC – 0°C = TF – 32°F। যদি আমি এদের অনুপাত নিই,

এখান থেকে পাবো,,

এখানে না বুঝলে সহজ, বুঝতে গেলে কঠিন এরকম ব্যাপার আছে কিছু। যেমন সমীকরণে °C বা °F আপেক্ষিক এককের তারতম্য নিয়ে কোন মাথা ঘামানো হয়নি, সাধারণ বীজগণিতের নিয়মে করা হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ এখানে তাপমাত্রার পার্থক্যের অনুপাত নিয়ে কাজ করা হয়েছে। যদি শুধু পার্থক্য কিংবা শুধু অনুুপাত নেয়া হত, তাহলে কিন্তু এমনটা করা যেত না।

যদি আমি কোন তাপমাত্রাকে সেলসিয়াস থেকে ফারেনহাইট স্কেলে নিতে চাই, খুব সহজেই পারবো। যেমন 4°C-কে ফারেনহাইট স্কেলে রূপান্তর করতে চাইলে সমীকরণে TC = 4 নিয়ে TF এর মান বের করতে হবে,

অর্থাৎ, 4°C ফারেনহাইট স্কেলে 39.2°F।

একটু আগে যেভাবে ফারেনহাইট আর সেলসিয়াস স্কেলের সম্পর্ক স্থাপন করেছি, একাধিক যেকোন তাপমাত্রার স্কেলের মধ্যে সম্পর্ক একইভাবে বের করা যাবে। যেমন সেলসিয়াস স্কেল, ফারেনহাইট স্কেল ও কেলভিন স্কেলের সম্পর্ক-

সেলসিয়াস আর কেলভিন স্কেলের সম্পর্কটা যদি এখান থেকে আলাদা করে আনি, আমরা সিমপ্লি পাবো, TC = TK – 273.15। অর্থাৎ, কেলভিন স্কেলের তাপমাত্রার মান থেকে 273.15 বিয়োগ করলে সেলসিয়াস স্কেলে তাপমাত্রা পাওয়া যাবে।

প্রশ্ন: সেলসিয়াস স্কেলে পানির ত্রৈধ বিন্দুর তাপমাত্রা কত?
সমাধান:
TC = TK – 273.15 = 273.16 – 273.15 = 0.01
অর্থাৎ, TC = 0.01°C

প্রশ্ন: কোন তাপমাত্রায় সেলসিয়াস স্কেল ও কেলভিন স্কেলে একই তাপমাত্রা পাওয়া যাবে?
উত্তর: একই তাপমাত্রা পাওয়া গেলে, TC = TK
এখন,
TC = TK – 273.15
বা, TK = TK – 273.15
বা, TK – TK = 273.15
যা সম্ভব না।
অর্থাৎ, কখনোই সেলসিয়াস স্কেল একই তাপমাত্রা দিবে না। (দেয়ার কারণও নেই, সবসময়ই তাপমাত্রার মানে 273.15 পার্থক্য থাকবে)

প্রশ্ন: কোন তাপমাত্রায় ফারেনহাইট স্কেল ও কেলভিন স্কেলে একই তাপমাত্রা পাওয়া যাবে?
উত্তর: একই তাপমাত্রা পাওয়া গেলে, TF = TK
এখন,
(TF-32)/9 = (TK – 273.15)/5
বা, (TK-32)/9 = (TK – 273.15)/5
বা, TK = 574.5875 K
অর্থাৎ, 574.5875 K বা 574.5875°F তাপমাত্রায় ফারেনহাইট স্কেল ও কেলভিন স্কেলে একই তাপমাত্রা পাওয়া যাবে।

প্রশ্ন: কোন একটি থার্মোমিটারে নিম্ন স্থিরাঙ্কের তাপমাত্রা 1°C ও ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্কের তাপমাত্রা 95°C প্রদর্শন করে। এখানে কোন তাপমাত্রা সঠিকভাবে প্রদর্শিত হবে?
উত্তর: তো এই থার্মোমিটার সেলসিয়াস স্কেলে ভুল মান দেখাচ্ছে। আমরা জানতে চাই কোন তাপমাত্রায় এটা সঠিক মান দেখাবে।
যদি ধরে নিই সেটা T তাপমাত্রা, তাহলে লিখতে পারি,

বা, T = 16.67 °C

প্রশ্ন: শুরুতে সেলসিয়াস স্কেলে নিম্ন স্থিরাঙ্ক 100°C ও ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক 0°C নেয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে যদিও এটা পরিবর্তিত হয়। বর্তমান প্রচলিত সেলসিয়াস স্কেলে 135°C শুরুর স্কেল অনুযায়ী কত হত?
উত্তর:

বা, 135 – 0 = – (T – 100)
বা, T = -35°C

প্রশ্ন: শুরুতে সেলসিয়াস স্কেলে নিম্ন স্থিরাঙ্ক 100°C ও ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক 0°C নেয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে যদিও এটা পরিবর্তিত হয়। বর্তমান প্রচলিত সেলসিয়াস স্কেলে 135°C শুরুর স্কেল অনুযায়ী কত হত?
উত্তর:

বা, 135 – 0 = – (T – 100)
বা, T = 235°C

প্রশ্ন: সেলসিয়াস স্কেলে 1 ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়ালে কেলভিন স্কেলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি কত হবে?
উত্তর:
নিম্ন স্থিরাঙ্ক ও ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্কের মানের পার্থক্য-
সেলসিয়াস স্কেলে (100-0) = 100
কেলভিন স্কেলে (273.15-173,15) = 100
তাহলে সেলসিয়াস স্কেলে 100°C তাপমাত্রার তারতম্য কেলভিন স্কেলে 100K তাপমাত্রার তারতম্যের সমান। অর্থাৎ 1°C তাপমাত্রা বাড়ালে কেলভিন স্কেলে তাপমাত্রা 1K বাড়বে।

যদি আরেকটু ভেঙে দেখতে চাই,
মনে করি, আগের তাপমাত্রা x°C এবং পরিবর্তিত তাপমাত্রা (x+1)°C
x°C কেলভিন স্কেলে (x+273) K
(x+1)°C কেলভিন স্কেলে (x+274) K
তাহলে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি 1 K

প্রশ্ন: কেলভিন স্কেলে 1 K তাপমাত্রা বাড়ালে ফারেনহাইট স্কেলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি কত হবে?
উত্তর:
নিম্ন স্থিরাঙ্ক ও ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্কের মানের পার্থক্য-
কেলভিন স্কেলে (273.15-173,15) = 100
ফারেনহাইট স্কেলে (212-32) = 180
তাহলে কেলভিন স্কেলে 100 K তাপমাত্রার তারতম্য ফারেনহাইট স্কেলে 180°F তাপমাত্রার তারতম্যের সমান।
অর্থাৎ 1 K তাপমাত্রা বাড়ালে ফারেনহাইট স্কেলে তাপমাত্রা (180/100)°F = (9/5)°F = 1.8°F বাড়বে।

আগের মতই কোন একটাকে ধরে নিয়ে বৃদ্ধির আগের ও পরের তাপমাত্রা উভয়টিকে ফারেনহাইট স্কেলে রূপান্তর করে দেখতে পারো। একইভাবে, সেলসিয়াস স্কেলে 1°C তাপমাত্রা বাড়লেও ফারেনহাইট স্কেলে তাপমাত্রা 1.8°F বাড়বে।

প্রশ্ন: র‌্যাঙ্কিন স্কেল তাপমাত্রা পরিমাপের একটি পরম স্কেল, যেখানে 1 Ra তাপমাত্রা বৃদ্ধি 1°F তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমান। র‌্যাঙ্কিন স্কেলে পানির হিমাঙ্ক ও স্ফূটনাঙ্ক নির্ণয় কর এবং সেলসিয়াস স্কেলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন কর।

উত্তর: এই প্রশ্নটা একটু মাথা খাটানোর জন্য দেয়া। নিশ্চিত করছি, পরীক্ষায় এধরণের প্রশ্ন আসবে না।

তো, আমরা যখন বললাম পরম স্কেল, তার মানে এখানে পরম শূন্য তাপমাত্রাকে 0 Ra নেয়া হবে।

যেহেতু র‌্যাঙ্কিন স্কেলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ফারেনহাইট স্কেলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমতূল্য, তাই কেলভিন স্কেলে 1 K তাপমাত্রা বাড়লে র‌্যাঙ্কিন স্কেলে 1.8 Ra তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে।

কেলভিন স্কেলে পানির হিমাঙ্ক 273.15 Ka। তাহলে র‌্যাঙ্কিন স্কেলে হিমাঙ্ক হবে (273.15 * 1.8) = 491.67 Ra

একইভাবে কেলভিন স্কেলের সাথে তুলনা করে স্ফূটনাঙ্ক বের করতে পারবো, যেটা হবে 671.67 Ra

সেলসিয়াস স্কেলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কাজটা নাহয় তোমার জন্য থাকলো!

প্রাকটিস প্রবলেম:
1. ফারেনহাইট স্কেলে মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা 98.4°F। কেলভিন স্কেল ও সেলসিয়াস স্কেলে তাপমাত্রা কত হবে?
2. কোন তাপমাত্রায় সেলসিয়াস স্কেলের তাপমাত্রা কেলভিন স্কেলে তাপমাত্রার দ্বিগুণ হবে?
3. তাপমাত্রাগুলো সেলসিয়াস স্কেলে রূপান্তর কর: -40°F, 94°F, 574.59 K
4. তাপমাত্রাগুলো ফারেনহাইট স্কেলে রূপান্তর কর: 135°C, 25°C

সোর্স ও সহায়তা

Stack Exchange

Quora

Series Navigation<< নবম-দশম শ্রেণি – পদার্থবিজ্ঞান – পঞ্চম অধ্যায়: পদার্থের অবস্থা ও চাপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *