নবম-দশম শ্রেণি – পদার্থবিজ্ঞান – তৃতীয় অধ্যায়: বল

1,283 views

This entry is part 4 of 7 in the series এসএসসি পদার্থবিজ্ঞান

পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখাটি বল, শক্তি ও এদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে তাকে বলবিদ্যা বা বলবিজ্ঞান বা মেকানিক্স বলে। মেকানিক্সের অগ্রগতিতে মোটাদাগে দুটি পর্যায় দেখতে পাওয়া যায়, ক্লাসিকাল মেকানিক্স (চিরায়ত বলবিদ্যা) ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স। তোমাদের বইয়ে চারটি অধ্যায় মূলত বলবিদ্যার অন্তর্গত- ‘গতি’, ‘বল’, ‘কাজ, ক্ষমতা ও শক্তি’ এবং ‘পদার্থের অবস্থা ও চাপ’। এখানে আলোচনাগুলো ক্লাসিকাল মেকানিক্স ভিত্তিক। বিজ্ঞানী নিউটন এর ভিত রচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় একে নিউটনীয়ান মেকানিক্স বা নিউটনীয় বলবিদ্যা হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

১৬৮৭ সালে Principia Mathematica-বইয়ে নিউটন বস্তুর গতি ও এর ওপর ক্রিয়ারত বলের অন্তঃসম্পর্ক স্থাপন করে তিনটি সূত্র প্রদান করেন, যা পরিচিত হয়েছে নিউটনের গতিসূত্র (Newton’s laws of motion) হিসেবে। একই বইতে তিনি উপস্থাপন করেন তার মহাকর্ষ সূত্র। এই অধ্যায়ের আলোচনার অধিকাংশ নিউটনের সূত্রগুলো ভিত্তিক।

নিউটনের প্রথম সূত্র এবং জড়তার ধারণা

অনেক বছর আগে গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন সবকিছু একটা সময়ে এসে স্থির হয়ে যাবে যদি না ক্রমাগত তাদের ওপর কোন শক্তি (বল) প্রয়োগ হয়। ঠিক যেমনটা আমরা দেখি, একটা টেনিস বলকে গড়িয়ে দেয়া হলে সেটা আস্তে আস্তে একটা সময়ে থেমে যায়।

নিউটনের প্রথম সূত্র অবশ্য অন্য কথা বলছে। নিউটনের প্রথম সূত্র বলছে: বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির থাকবে এবং সমবেগে চলতে থাকা বস্তু সমবেগে চলতে থাকবে এই সূত্রটাকে জড়তার সূত্র বলা হয়, কেন একটু পরেই দেখবে। এটাকে এভাবে লেখা যায়, প্রযুক্ত বল, F = 0 হলে, শেষ বেগ v = আদি বেগ u।

বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির থাকে এটা তো আমরা সবসময়ই দেখি। কিন্তু গতিশীল বস্তুর বেলায়? হ্যা, গতিশীল বস্তুও চিরকাল সমবেগে চলতে থাকতো, যদি না তার ওপর কোন বল প্রয়োগ হত। তাহলে গড়িয়ে দেয়া টেনিস বল কেন সবসময় গড়াতে থাকে না? কারণ তার ওপর আসলে বল প্রযুক্ত হয়। ঘর্ষণ বল, বাতাসের বাধা, মধ্যাকর্ষণ অনেকরকম বল তার ওপর ক্রিয়া করে। এই বলগুলোর প্রভাবে টেনিস বল চিরকাল গতিশীল থাকতে পারে না।

তবে টেনিস বলটা সত্যিই চিরকাল গতিশীল থাকতো, যদি তার ওপর কোনরকম বল প্রযুক্ত না হত। কারণ এটা বস্তুর বৈশিষ্ট্য যে, বল প্রয়োগ না করলে সে তার গতীয় অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চায় না, অর্থাৎ স্থির বস্তু চিরকাল স্থির আর গতিশীল বস্তু সমবেগে গতিশীল থাকতে চায়। এই বৈশিষ্ট্যটাকে বলা হয় জড়তা। সহজ ভাষায় জড়তা হলো গতীয় অবস্থা বজায় রাখার প্রবণতা

জড়তা দুরকম। স্থিতি জড়তা ও গতি জড়তা। স্থির বস্তুর স্থির থাকতে চাওয়ার প্রবণতাকে স্থিতি জড়তা আর গতিশীল বস্তুর চিরকাল সমবেগে গতিশীল থাকতে চাওয়ার প্রবণতাকে গতি জড়তা বলে।

সমবেগ কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিন্তু সমদ্রুতি বলা হচ্ছে না। মানে কিনা বল প্রয়োগ না হলে গতিশীল বস্তু একই গতিতে এবং একই দিকে চলতে থাকবে। দিকের পরিবর্তন ঘটাতেও বল প্রয়োগ করা প্রয়োজন হবে।

দৈনন্দিন জীবনে জড়তার উদাহরণ অনেক আছে। যেমন স্থির বাস হঠাৎ চলতে শুরু করলে পেছনে ঝাঁকুনি অনুভব করা। এখানে যাত্রীর দেহের বাস সংলগ্ন অংশ হঠাৎ গতিশীল হয়, কিন্তু ওপরের অংশ স্থিতি জড়তার প্রভাবে স্থির থাকতে চায়। একারণে ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। একইভাবে গতিশীল বাস হঠাৎ ব্রেক কষলে গতি জড়তার কারণে যাত্রী সামনে হেলে পড়ে। ময়লা কাপড় ঝাড়লে স্থিতি জড়তার কারণে কাপড় সরে গেলেও ময়লা স্থির থাকতে চায়, ফলে ময়লা ঝরে পড়ে।

আমাদের মৌলিক রাশিগুলোর মধ্যে আমরা দেখেছিলাম পদার্থের পরিমাণ ও ভর দুটো আলাদা মৌলিক রাশি। এদের মধ্যে পার্থক্য কী? পদার্থের পরিমাণ হলো কোথাও উপস্থিত মৌলিক কণা, যেমন অণু, পরমাণু বা আয়নের সংখ্যা। আর ভরের সবচেয়ে পদার্থবিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞা হলো ভর হচ্ছে জড়তার পরিমাপক। মানে কিনা একটা বস্তুর যত বেশি জড়তা থাকবে তার ভর তত বেশি।

কথাটা একটু দুর্বোধ্য ঠেকছে কি? অনুরূপ দুটো পানির বোতল নিয়ে একটা খালি আরেকটা পানি-পূর্ণ করে দুটোতে ধাক্কা দেও, দেখবে খুব অল্প ধাক্কাতেই খালি বোতলটা পড়ে যাচ্ছে, যেখানে ভরা বোতলের বেলায় বেশি বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে। একইভাবে বোতলদুটো যদি গড়িয়ে দেও, দেখবে খালি বোতলটিকে থামানো সহজ অনুভব হচ্ছে। অর্থাৎ যার ভর যত বেশি, তার গতীয় অবস্থা বজায় রাখার প্রবণতা তথা জড়তা তত বেশি।

বল

নিউটনের প্রথম সূত্রকে একটু অন্যভাবে লিখে বলের সংজ্ঞা নিয়ে আসা যায়। বলের সংজ্ঞা অনেক সময় এভাবে দেয়া হয়: যে বাহ্যিক কারণ স্থির বস্তুকে গতিশীল করে বা করতে চায় অথবা গতিশীল বস্তুর গতির পরিবর্তন করে বা করতে চায় তাকে বল বলে। এর থেকে সহজভাবে লেখা যায়, যে বাহ্যিক কারণ বস্তুর বেগের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম, তাকে বল বলে। বেগের পরিবর্তন মানে কিন্তু ত্বরণ। তাহলে এভাবেও বলতে পারি, বল হলো যা কোন বস্তুতে ত্বরণ সৃষ্টি করতে পারে
বল ভেক্টর রাশি। এর প্রতীক F (ভেক্টর রূপে: F⃗)। একক N (নিউটন)। মাত্র MLT-2

মৌলিক বলের প্রকারভেদ

পৃথিবীতে যতরকমের বল আছে, তার সবকিছু ৪টা মাত্র বলের বিভিন্ন রকম প্রকাশ। অর্থাৎ, মৌলিক বল ৪ প্রকার- মহাকর্ষ বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল, তড়িৎ চৌম্বক বল ও সবল নিউক্লিয় বল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই ৪টা বলেরও মূল এক জায়গায়, এবং তারা একই সূত্রের অধীনে এগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন, এবং ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানী শেলডন গ্লাসো, আবদুস সালাম ও স্টিভেন ওয়াইনবার্গ তড়িৎ চৌম্বক বল ও দুর্বল নিউক্লিয় বলকে একীভূত করে ইলেকট্রোউইক ফোর্স হিসেবে একই সূত্রের অধীনে দেখিয়ে নোবেলবিজয়ী হয়েছেন।

১. মহাকর্ষ বল (Gravitation/Gravity):
> যেকোন দুটি বস্তুকণার মধ্যে আকর্ষণ বল যা তাদের ভরের কারণে কার্যকর হয়
> মৌলিক বলগুলোর মধ্যে দুর্বলতম
> ব্যপ্তি অসীম, অর্থাৎ তাত্ত্বিকভাবে যেকোন দুটি বস্তুকণা পরস্পরকে আকর্ষণ করবে তারা যতই দূরত্বে থাক না কেন। যদিও দূরত্বের সাথে আকর্ষণ বল কমতে থাকে, এবং একটা জায়গায় গিয়ে এতটা নগন্য হয়ে যায় যা না থাকার মত।
> মাধ্যাকর্ষণ বল: পৃথিবী সবকিছুকে তার কেন্দ্রের দিকে যে বলে আকর্ষণ করে
> মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে ওজন অনুভূত হয়

২. দুর্বল নিউক্লিয় বল (Weak Force):
> তেজষ্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে বিটা রশ্মি নির্গমনের জন্য দায়ী বল
> মহাকর্ষ বল থেকে শক্তিশালী
> তড়িৎ চৌম্বক বল থেকে প্রায় ট্রিলিয়ন গুণ দুর্বল
> ব্যপ্তি 10-18 m, অর্থাৎ এই অঞ্চলের বাইরে দুর্বল নিউক্লিয় বলের কোন প্রভাব নেই

৩. তড়িৎ চৌম্বক বল বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল (Electromagnetic Force):
> তড়িৎ বল ও চৌম্বক বল একই বলের ভিন্নরকম রূপ
> আকর্ষণ অথবা বিকর্ষণ করতে পারে (অন্য সব বল শুধু আকর্ষণধর্মী)
> ব্যপ্তি অসীম
> মহাকর্ষ বলের তুলনায় প্রায় 1036 গুণ শক্তিশালী

৪. সবল নিউক্লিয় বল (Strong Force/Strong Nuclear Force):
> সবচেয়ে শক্তিশালী মৌলিক বল
> পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনকে ধরে রাখে এই বল
> সবল নিউক্লিয় বল অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়াতে বড় নিউক্লিয়াসকে ভেঙে বা ছোট নিউক্লিয়াসকে জোড়া লাগিয়ে অনেক শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব। নিউক্লিয়ার বোমার শক্তিমত্তা ও সূর্যের আলোর তাপ এই বল থেকে আসে
> তড়িৎ চৌম্বক বল থেকে প্রায় একশ গুণ শক্তিশালী
> ব্যপ্তি 10-15 m

ভেক্টরের উপাংশের ধারণা

এটা ঠিক সরাসরি তোমাদের সিলেবাসের আলোচনা না, তবে এই ধারণাটা থাকলে অনেক কিছু বুঝতে সুবিধা হবে। ভেক্টরের উপাংশ বলতে সহজভাবে একাধিক দিকে ভাগ করলে কোন একটা দিকে ভেক্টরের কতটা অংশ কার্যকর হয়। ছবিতে ধরা যাক F⃗ একটা ভেক্টর, যেটা ভূমির সাথে θ (থিটা, একটা গ্রিক বর্ণ) কোণ করে OA বরাবর কার্যকর হচ্ছে। আমি যদি A বিন্দু থেকে ভূমির ওপর একটা লম্ব টানি, তাহলে এটা B বিন্দুতে ছেদ করছে। তাহলে আমরা বলতে পারবো F⃗ ভেক্টরের ভূমি বরাবর উপাংশ OB এবং উল্লম্ব বরাবর উপাংশ BA

গণিতে ত্রিকোণমিতিক সম্পর্কগুলো যদি এখনো না পড়া হয়ে থাকে, এখনকার মত এটুকু জেনে রাখো যে সমকোণী ত্রিভুজের ভূমি আর অতিভূজের অনুপাতকে ভূমিসংলগ্ন কোণের cos (কোসাইন) হিসেবে প্রকাশ করা যায়, একইভাবে লম্ব আর অতিভূজের অনুপাতকে sin (সাইন) হিসেবে প্রকাশ করা হয়। এখানে ভূমি OB, লম্ব BA, অতিভূজ OA বা F⃗ আর ভূমিসংলগ্ন কোণ θ।

তাহলে আমি বলতে পারি, OB/OA = cos 30° বা, OB = F⃗ cos θ। একইভাবে BA = F⃗ sin θ। অর্থাৎ, কোন দিকের সাথে θ কোণে থাকা কোন ভেক্টরের সে দিক বরাবর উপাংশ পেতে এর সাথে cos θ গুণ করতে হবে এবং সে দিকের সাথে লম্ব বরাবর উপাংশ পেতে sin θ গুণ করতে হবে।

লদ্ধি বলের ধারণা

একাধিক ভেক্টরের সম্মিলনে যে ভেক্টর পাওয়া যায়, তাকে লদ্ধি ভেক্টর বলে। ধর একটা বাক্সকে একজন সামনে থেকে ঠেলছে, আরেকজন পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে। তাহলে বাক্সটা কোনদিকে যাবে? যদি দুজন সমানভাবে বল প্রয়োগ করে, তাহলে দুজনের বল দু’দিকে হওয়াতে কাটাকাটি হয়ে বাক্সটা স্থির থাকবে। আর যদি কেউ যদি কারো প্রযুক্ত বল বেশি হয়, তবে সে যেদিকে ধাক্কা দিচ্ছে সেদিকে যাবে, তবে তার পুরো প্রযুক্ত বল ক্রিয়াশীল হবে না, কেননা কিছু অংশ অন্যজন নিষ্ক্রিয় করে দিবে। তো এভাবে সম্মিলিত ফলাফল যেটা হবে, সেটাকেই বলা হয় লদ্ধি।

সাম্যতা ও সাম্যতাবিহীন বল

একাধিক বল যদি পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় অর্থাৎ একাধিক বলের লদ্ধি যদি শূন্য হয়, তবে বলা যায় বলগুলো সাম্যাবস্থায় আছে, এখানে প্রযুক্ত বলগুলোকে সাম্য বল বলে। আর যদি বস্তুর ওপর প্রযুক্ত বলগুলো সাম্যাবস্থা সৃষ্টি না করে, তাহলে সেটাকে অসাম্য বল বলে

সুতোয় ঝুলিয়ে দেয়া একটা বস্তুর ওজন নিচের দিকে কাজ করে। কিন্তু সুতোর টান কাজ করে ওপরের দিকে। ওজন যতটা হয়, টান বল ঠিক ততটাই হয়, তাই বস্তুটা সাম্যাবস্থা লাভ করে। কিন্তু যদি সুতোটা কেটে দেয়া হয় বা বস্তুর ওজন এত বেশি হয় যে সুতো ততটা টান বল প্রয়োগের উপযুক্ত না হওয়াতে ছিঁড়ে যায়, তখন এই টান বল আর থাকে না। তাই শুধু ওজন একটা অসাম্য বল সৃষ্টি করে, তাই বস্তুটা নিচে পড়ে যায়।

যদি বস্তুটাকে টেনে কিছুটা একপাশে সরিয়ে আনা হয়, তাহলে টান বলের দিক ওজনের ঠিক বিপরীতে আর থাকে না। এমতাবস্থায় যতক্ষণ বস্তুটা ধরে রাখা হবে ততক্ষণ বস্তুটা সাম্যাবস্থায় থাকবে, কেননা আমরা যে ধরে রেখেছি, এতেও একটা বল প্রয়োগ করা হচ্ছে, তিনটি বল একসাথে সাম্যাবস্থা তৈরি করবে। কিন্তু এরপর ছেড়ে দিলে টান বল এখন আর ওজনের সাথে সাম্যাবস্থায় না থাকায় লদ্ধি বল তৈরি হবে, অর্থাৎ বস্তুটা দুলতে শুরু করবে।

এবার একটা ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার। ছবির মত একটা বইকে দড়িতে বেঁধে দুদিক থেকে টেনে রাখলে সাম্যাবস্থা তৈরি সম্ভব। তবে যত জোরেই টানা হোক না কেন দড়িটা সম্পূর্ণ সোজা হবে না। কেননা যদি ওজনকে নিষ্ক্রিয় করতে হয়, তাহলে প্রযুক্ত বলের অবশ্যই এর বিপরীত দিক অর্থাৎ ওপরের দিকে উপাংশ থাকতে হবে। দড়ি সম্পূর্ণ সোজা হলে ওপরের দিকের সাথে টান বলের কোণ হবে 90°, কিন্তু cos 90° এর মান শূন্য, অর্থাৎ সম্পূর্ণ সোজা হলে ওপরের দিকে টান বলের কোন উপাংশ থাকবে না, তাই ওজনকে নিষ্ক্রিয় করা যাবে না।

ভরবেগ (Momentum) এবং ভরবেগ ও শক্তির সংরক্ষণশীলতা

ভরবেগ হলো নাম যেমনটা বলছে, ভর ও বেগের গুণফল। এটাকে p দিয়ে প্রকাশ করা যায়। একক kg ms-1 এবং মাত্র MLT-1
ভরবেগ = ভর × বেগ বা, p = mv

ভরবেগের সংরক্ষণশীলতা সূত্র: বাইরের কোন কিছুর সাথে শক্তির আদান-প্রদান হচ্ছে না, এমন কিছু বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটলে সম্মিলিত ভরবেগের কোন পরিবর্তন হবে না।

অর্থাৎ, বাইরে থেকে কোন বল প্রয়োগ হচ্ছে না, বা এরাও বাইরের কারো ওপর বল প্রয়োগ করছে না এরকম দুটো বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষ হলে এদের এক-একটির বেগ পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু ভরবেগের যোগফল একই থাকবে। এমনকি যদি সংঘর্ষে বস্তুগুলো সংঘর্ষে কয়েক টুকরো হয়ে যায়, তবু সম্মিলিত ভরবেগ বদলাবে না।

দুটো বস্তুর সংঘর্ষের ক্ষেত্রে ভরবেগের সংরক্ষণশীলতা সূত্রের সমীকরণ: m1u1 + m2u2 = m1v1 + m2v2
(যেখানে m1, m2 বস্তুদুটোর ভর; u1 ও u2 সংঘর্ষের আগে বেগ এবং v1 ও v2 সংঘর্ষের পরে বেগ)

শক্তির সংরক্ষণশীলতা সূত্র: শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, শক্তি কেবল একরূপ থেকে অপর এক বা একাধিক রূপে পরিবর্তিত হতে পারে।
স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ: যে সংঘর্ষের আগে ও পরে দুটি বস্তুর মাঝে মোট গতিশক্তি একই থাকে তাকে স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ বলে
যদিও শক্তি সংরক্ষণশীল, তবে গতিশক্তি অন্য শক্তিতে বা অন্য শক্তি গতিশক্তিতে রূপান্তর হতে পারে। দুটো বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষে শক্তির স্থানান্তর, তাপশক্তি উৎপাদন, বিকৃতি ঘটানো প্রভৃতি কারণে সংঘর্ষ অস্থিতিস্থাপক হতে পারে।
স্থিতিস্থাপক বা অস্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ উভয় ক্ষেত্রে ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র রক্ষিত হবে। তবে গতিশক্তির সংরক্ষণ ঘটবে শুধুমাত্র স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষে।

শক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরের অধ্যায়ে রয়েছে। এই অধ্যায়ের জন্য এটুকু মেনে নেও যে m ভরের v বেগে গতিশীল বস্তুর গতিশক্তি = ½ mv2
তাহলে দুটো বস্তুর স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষে গতিশক্তির সংরক্ষণের সমীকরণ: ½ m1u12 + ½ m2u22 = ½ m1v12 + ½ m2v22
বা, m1u12 + m2u22 = m1v12 + m2v22

ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র ও শক্তির সংরক্ষণ সূত্রের সমীকরণ থেকে v1 ও v2 এর জন্য দুটি সমাধান পাওয়া যাবে। একটা হলো v1 = u1 ও v2 = u2, যেটা মূলত সংঘর্ষ হওয়ার আগপর্যন্ত প্রযোজ্য, অর্থাৎ, নিউটনের প্রথম সূত্রের অনুরূপ। অন্য সমাধানটি হলো:

দুটো বস্তুর মধ্যে স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষের পর বেগ এই সূত্র থেকে পাওয়া যায়। এখানে একটা মজার জিনিস দেখা যাবে। যদি বস্তু দুটোর ভর সমান হয়, তাহলে m1 = m2 বসিয়ে ওপরের সমীকরণদুটোকে সরলীকৃত করে পাওয়া যাবে v1 = u2 ও v2 = u1। মানে সমান ভরের দুটো বস্তুর মধ্যে ভরবেগ ও শক্তি সংরক্ষণশীল সংঘর্ষ হলে তাদের একটা পরের বেগ হবে অপরটার আগের বেগের সমান। দুটো কয়েন বা মারবেল দিয়ে এটা পরীক্ষা করে দেখতে পারো:

ভরবেগ ও শক্তির সংরক্ষণের ফলে ভারী গাড়ির সাথে হালকা গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে ভারী গাড়ির ওপর তত বেশি পড়ে না, যতটা পড়ে হালকা গাড়ির ওপর। রাস্তার নিরাপত্তা রক্ষার্থে ভারী গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্কতা প্রয়োজন।

সমস্যা: 1500 kg ভরের একটি গাড়ি ও 20000 kg ভরের একটি ট্রাকের ভরের একটি ট্রাকের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটলো। সংঘর্ষের পূর্বে উভয়ের বেগ ছিলো 20 ms-1। স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ ঘটলে উভয়ের শেষ বেগ কী হবে?

সমাধান:
স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষের পরবর্তী বেগের সূত্র মুখস্থ থাকলে সরাসরি এটা বের করতে পারবে। যদি মুখস্থ না থাকে, তাহলেও সমস্যা নেই, ভরবেগ ও শক্তির সংরক্ষণ সূত্র জানা-ই যথেষ্ট।

এখানে মুখোমুখি সংঘর্ষ বলে একটির দিক পজিটিভ ও অন্যটি নেগেটিভ চিন্তা করতে হবে। অর্থাৎ, গাড়ির বেগ uc = 20 ms-1 নিলে ট্রাকের বেগ ut = -20 ms-1 নিতে হবে।

স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষে ভরবেগ ও শক্তি উভয়টি সংরক্ষিত হবে।
ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র থেকে:
1500 × 20 + 20000 × (-20) = 1500 vc + 20000 vt
বা, … (i)

শক্তির সংরক্ষণ সূত্র থেকে:
1500 × 202 + 20000 × (-20)2 = 1500 vc2 + 20000 vt2

এটা ক্যালকুলেটর Mode > Equation > Simultaneous থেকে সমাধান করা যাবে। মডেলভেদে প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন হবে। অথবা দ্বিঘাত সমীকরণের সূত্র ব্যবহার করতে পারো। সমাধান হবে,
vc = -54.42 ms-1 অথবা 20 ms-1
(i)-থেকে এখন পাবো,
vt = -14.42 ms-1 অথবা -20 ms-1

খেয়াল কর, প্রতিটির জন্য পাওয়া দুটি করে সমাধানের একটি আসলে যার যার আগের বেগ-ই। সংঘর্ষের পর বেগ যেহেতু পরিবর্তন হবে, গ্রহণযোগ্য উত্তর হলো vc = -54.42 ms-1 এবং vt = -14.42 ms-1

এখানে আরেকটা জিনিস দেখো, ট্রাকের বেগ কিছুটা কমে আগের দিকেই সে যেতে থাকবে, তার ওপর প্রভাব কিন্তু তত বেশি পড়েনি, যতটা পড়েছে গাড়ির ওপর। বাস্তবে এমন সংঘর্ষে গাড়ির আরোহীদের ঝুঁকি ট্রাকের আরোহীদের তুলনায় অনেক বেশি।

সমস্যা: 5 kg ভরের বন্দুক থেকে 60 g ভরের বুলেট 600 ms-1 বেগে ছোঁড়া হলে বন্দুকের পশ্চাৎ বেগ কত? এই ঘটনাটি স্থিতিস্থাপক কিনা যাচাই কর।

দুটো ভরকে আমাদের একই এককে আনতে হবে, বুলেটের ভর kg এককে হবে 0.06 kg। যেহেতু আদিবেগের কোন উল্লেখ নেই, স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায় বন্দুক আর গুলি দুটোই স্থির ছিলো। তাহলে ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র থেকে,
5 × 0 + 0.06 × 0 = 5 × v1 + 0.06 × 600
∴ v1 = -7.2 ms-1

‘-‘ চিহ্ন এখানে নির্দেশ করছে গুলির বেগের বিপরীত দিক। যেহেতু বলাই হয়েছে পশ্চাৎ বেগ, তাই উত্তর হবে বন্দুকের পশ্চাৎ বেগ 7.2 ms-1

ঘটনাটি স্থিতিস্থাপক কিনা যাচাই করতে প্রাপ্ত মানগুলোর জন্য শক্তির সংরক্ষণ সূত্রের বামপক্ষ ও ডানপক্ষ সমান হয় কিনা বের করতে হবে। ট্রাই ইট ইউরসেল্ফ। এটুকু বলে রাখি এটা স্থিতিস্থাপক হবে না।

নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র

নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র: বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার তার উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং যেদিকে বল প্রয়োগ করা হয় ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকে ঘটে।

m ভরের কোন বস্তুর আদি বেগ u ও t সময় পর শেষ বেগ v হলে, t সময়ে ভরবেগের পরিবর্তন mv – mu বা m(v-u)। তাহলে ভরবেগের পরিবর্তনের হার =

এখন (v-u)/t মানে কিন্তু ত্বরণ। এখান থেকে লেখা যায় ভরবেগের পরিবর্তনের হার = ma।
তাহলে প্রযুক্ত বল এর সমানুপাতিক হবে, মানে F ∝ ma

সমানুপাতিক মানে হলো এক পক্ষের মান যতগুণ বৃদ্ধি বা হ্রাস পাবে, অন্যপক্ষও ঠিক ততগুণ বৃদ্ধি বা হ্রাস পাবে, অর্থাৎ এক পক্ষ ও আরেক পক্ষের অনুপাত ধ্রুব থাকবে, যাকে সমানুপাতিক চিহ্নের পরিবর্তে একটা সমানুপাতিক ধ্রুবক দিয়ে প্রকাশ করা যায়। তো আমরা একটা সমানুপাতিক ধ্রুবক k নিলে,
F = kma

এখন বলের একক নিউটনের সংজ্ঞা দেয়া হয় এমনভাবে যে m = 1 kg ভরের বস্তুতে a = 1 ms-2 ত্বরণ সৃষ্টি করতে যে বল প্রয়োজন তা-ই 1 N। এই মানগুলো F = kma-তে বসালে পাওয়া যাবে F = ma

এখান থেকে বলের একক = ভরের একক × ত্বরণের একক = kg ms-2
kg ms-2 কে-ই N দ্বারা প্রকাশ করা হয়। 1 kg ms-2 = 1 N

মনে আছে, বলেছিলাম বল কোন বস্তুতে ত্বরণ সৃষ্টি করতে পারে? দেখো, আমরা কিন্তু এখন সেটাই দেখছি। m ভরের বস্তুতে F বল প্রয়োগ করলে সৃষ্ট ত্বরণ হবে, a = F/m।

এখন তুমি প্রশ্ন করতে পারো, সূত্রে বেগের পরিবর্তন বা ত্বরণের সমানুপাতিক না বলে ভরবেগের পরিবর্তনের সমানুপাতিক বলা হলো না কেন? এর কারণ হলো কিছু সময়ে ভর পরিবর্তনশীল হতে পারে, যেমন একটা রকেট থেকে জ্বালানি নির্গত হলে জ্বালানিসহ রকেটের ভর পরিবর্তনশীল হবে। এক্ষেত্রেও বল প্রয়োগে বেগের পরিবর্তন হবে, তবে তা সুষম হবে না এবং তা নির্ণয়ে ভরবেগের ধারণা প্রয়োজন হবে। ভালো কথা হলো এসএসসিতে পরিবর্তনশীল ভর নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

সমস্যা: দুটো 50 kg ভরের স্থির গাড়ি পরস্পর থেকে 100 m দূরে মুখোমুখি অবস্থানে আছে। একই সময়ে একটি গাড়িতে 50 N ও অন্য গাড়িতে 100 N বল প্রয়োগ করা হলো। গাড়ি দুটোর মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বল প্রয়োগ করা হলো। স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ সংঘর্ষের পর এদের বেগ কত?

সমাধান
:
প্রথম গাড়িতে ত্বরণ, a1 = F1/m1 = 1 ms-2
দ্বিতীয় গাড়িতে ত্বরণ, a2 = F2/m2 = 2 ms-2

ধরা যাক t সময় পর সংঘর্ষ হলো। t সময়ে প্রথম গাড়ি s দূরত্ব গেলে দ্বিতীয় গাড়ি যাবে 100-s দূরত্ব।

তাহলে,
s = u1t + ½ a1t2 = ½ t2 … (i)
100 – s = u1t + ½ a1t2 = t2 …(ii)

(i) ও (ii) থেকে,
100 – ½ t2 = t2
বা, t = 8.165 s

t সময় পর গাড়িদুটোর বেগ,
v1 = u1 + a1t = 8.165 ms-1
v2 = u2 + a2t = 16.310 ms-1

আগেই দেখেছি সমান ভরের দুটো বস্তুর মধ্যে স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ হলে এদের বেগ বিনিময় হয়। তাহলে
সংঘর্ষের পর-
প্রথম বস্তুর বেগ, v1‘ = v2 = 16.310 ms-1
দ্বিতীয় বস্তুর বেগ, v2‘ = v1 = 8.165 ms-1

মহাকর্ষ বল

মৌলিক বলের চারটি প্রকারের মধ্যে মহাকর্ষ বলের কথা আমরা দেখেছি। মহাবিশ্বের ভরযুক্ত প্রতিটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে, এই আকর্ষণ বলটাই মহাকর্ষ বল। এই বিষয়েও নিউটনের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সূত্র আছে, যা নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র হিসেবে পরিচিত।
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র: দুটি বস্তুকণার মাঝে মহাকর্ষ বল বস্তুকণাদ্বয়ের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক ও তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক এবং এটি তাদের সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে। কথাটাকে গাণিতিকভাবে লিখলে:

G এখানে একটা সমানুপাতিক ধ্রুবক। এর মান: 6.67 × 10-11 Nm2kg-2। একটু কঠিন মনে হলেও এটা মনে রাখতে হবে। দূরত্ব r নিতে হবে এক বস্তুর কেন্দ্র থেকে অন্য বস্তুর কেন্দ্র পর্যন্ত।

মাধ্যাকর্ষণ বল

মাধ্যাকর্ষণ বল: পৃথিবী কোন বস্তুকে কেন্দ্রের দিকে যে বলে আকর্ষণ করে তাকে মাধ্যাকর্ষণ বল বা অভিকর্ষ বল বলে। বস্তুর ভর m এবং পৃথিবীর ভর M নিলে, বস্তুটা যদি পৃথিবীর পৃষ্ঠে বা খুব কাছাকাছি থাকে, তাহলে মধ্যবর্তী দূরত্ব বলা যায় পৃথিবীর ব্যাসার্ধের সমান, R। মহাকর্ষ সূত্র থেকে তাহলে লেখা যায়:

অভিকর্ষজ ত্বরণ g হলে F আকর্ষণ বলের জন্য m ভরের বস্তুর ক্ষেত্রে নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে আসবে
F = mg
তাহলে F এর মান বসিয়ে পাচ্ছি,

বা,
এখান থেকে G = 6.67*10-11 Nm2kg-1, পৃথিবীর ভর M = 5.98 × 1024 kg, পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R = 6.37 × 106 m বসালে পেয়ে যাবে, যা মোটামুটি g = 9.8 ms-2

এখানে দেখো, কোন স্থানে অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর মান একটা ধ্রুব সংখ্যা। g = GM/R2 থেকে দেখা যায় এটা শুধু পৃথিবীর ভর ও পৃথিবী থেকে বস্তুর দূরত্বের ওপর নির্ভরশীল। মানে মহাকর্ষ বল দুটো বস্তুর ভরের ওপর নির্ভর করে আমরা জানি, অথচ অভিকর্ষজ ত্বরণের মান বস্তুর ভরের ওপর নির্ভর করছে না, এটা একটু কনফিউজিং, না?

পৃথিবী কোন বস্তুকে যে বলে আকর্ষণ করে, ওই বস্তুও পৃথিবীকে ঠিক সেই বলে আকর্ষণ করবে (নিউটনের তৃতীয় সূত্রে আরো ধারণা পাবে)। তবে পৃথিবী আর বস্তুর ওজন যেহেতু ভিন্ন, তাই একই বলের কারণে পৃথিবী আর বস্তুতে ত্বরণ ভিন্ন হবে। কিন্তু অভিকর্ষজ ত্বরণ বললে আমরা বিবেচনা করি বস্তুর মধ্যে কত ত্বরণ সৃষ্টি হয়েছে, একারণেই আমরা F = mg নিয়েছিলাম।

বস্তুর কারণে পৃথিবীর ত্বরণ অভিকর্ষজ ত্বরণের হিসেবে বিবেচ্য নয়, তবে তুমি চাইলে এটা বের করতে পারো। যদি m ভরের বস্তুর আকর্ষণে পৃথিবীর ত্বরণ a হয়, তাহলে F = Ma নিয়ে ওপরের মত করেই বের করতে পারবে, যেটার মান সবশেষে আসতো a = Gm/R2। অবশ্য অনেক ভারি বস্তু না হলে এই মানটা খুব নগন্য হবে, আর অঙ্ক করার সময় আমাদের এটা নিয়ে কোন চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। তোমাদের বইয়ের ৮৪ পৃষ্ঠায় এটা নিয়ে বিস্তারিত আছে।

প্রসঙ্গত, স্থানভেদে g ভিন্ন হতে পারে, যেমন পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতায় বা পৃথিবীর মেরু ও বিষুব অঞ্চলে কেন্দ্র থেকে দূরত্ব ভিন্ন হয়। মেরু অঞ্চলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ সবচেয়ে কম বলে g এর মান সর্বোচ্চ, 9.83 ms-2, এবং ব্যসার্ধ বেশি বলে বিষুব অঞ্চলে g এর মান সর্বনিম্ন, 9.78 ms-2। অঙ্কে সাধারভাবে আমরা g = 9.8 ms-2 ব্যবহার করব।

সমস্যা: ছবির m ভরের বাক্সটি বামে 10 ms-2 ত্বরণ লাভ করলে m এর মান কত?

সমাধান:

প্রথমে বাক্সের ওপর ক্রিয়ারত বলের মান বের করতে হবে। কোন বস্তুর ওজন কিন্তু এক প্রকার বল।
10 kg ভরের বস্তু কতৃক প্রযুক্ত বল, W1 = m1g = 10 × 9.8 = 98 N (বামে)
5 kg ভরের বস্তু কতৃক প্রযুক্ত বল, W2 = m2g = 5 × 9.8 = 49 N (ডানে)
(ওজন/Weight এর জন্য প্রতীক W নেয়া হয়েছে। F নিলে কোন সমস্যা ছিলো, এরকম না।)

দুটো বল যেহেতু দু’দিকে কাজ করছে, লদ্ধি বল হবে বল দুটোর পার্থক্য এবং দিক হবে বড় বলটির দিকে।
লদ্ধি বল, F = W1 – W2 = 98 N – 49 N = 49 N (বামে)

বাক্সের ত্বরণ, a = 10 ms-2 (বামে)

আমরা জানি,
F = ma
বা, m = F/a = 49/10 = 4.9 kg বল

পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতায় মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ:
পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে r উচ্চতায় থাকা বস্তুর জন্য মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ g’ হবে-

অঙ্ক করার সময় প্রশ্নে ভিন্ন কিছু দেয়া না থাকলে আমরা M = 6 × 1024 kg, R = 6400 km = 6.4 × 106 m ও g = 9.8 ms-2 ব্যবহার করে থাকি।

সমস্যা: X গ্রহের পৃষ্ঠে অভিকর্ষজ ত্বরণ 10.5 ms-2। এর উপগ্রহ Y এর ব্যাসার্ধ X গ্রহের ব্যাসার্ধের এক-পঞ্চমাংশ এবং Y উপগ্রহের ভর X গ্রহের ভরের এক শতাংশ। Y উপগ্রহের পৃষ্ঠ থেকে এর ব্যাসার্ধের সমান উচ্চতায় থাকা 100 kg ভরের একটি বস্তুর ওপর ওপরের দিকে 20 N বল প্রয়োগ করা হলে এর লদ্ধি ত্বরণ কোনদিকে এবং কত হবে?

সমাধান
:

অঙ্কটা একদমই সহজ। প্রথমে X গ্রহের অভিকর্ষজ ত্বরণ থেকে Y উপগ্রহের পৃষ্ঠে অভিকর্ষজ ত্বরণ বের করতে হবে। এরপর Y উপগ্রহের ব্যাসার্ধের সমান উচ্চতায় অভিকর্ষজ ত্বরণ বের করতে হবে। সবশেষে বস্তুটির ওপর কার্যকর লদ্ধি ত্বরণ নির্ণয় করতে হবে।

X গ্রহের ভর M ও ব্যাসার্ধ R হলে, Y উপগ্রহের ভর M × 1% = M/100 এবং ব্যাসার্ধ R/5। তাহলে এদের অভিকর্ষজ ত্বরণের অনুপাত,



এখন Y উপগ্রহের ব্যসার্ধের সমান উচ্চতায়,

(যেখানে R/5, Y উপগ্রহের ব্যাসার্ধ)

এখন 100 kg ভরের বস্তুর ওপর-
20 N বল প্রয়োগের ওপরের দিকে সৃষ্ট ত্বরণ = F/m = 20/100 = 0.2 ms-2
নিচের দিকে অভিকর্ষজ ত্বরণ 0.65625 ms-2

∴ লদ্ধি ত্বরণ = 0.65625 ms-2 – 0.2 ms-2 = 0.45625 ms-2 (নিচের দিকে)

নিউটনের তৃতীয় সূত্র

নিউটনের তৃতীয় সূত্র: যখন একটি বস্তু অন্য একটি বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করে তখন সেই বস্তুটিও প্রথম বস্তুটির ওপর বিপরীত দিকে সমান বল প্রয়োগ করে।
এই সূত্রটা সাধারণভাবে “প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে” এভাবে জনপ্রিয়। যদিও দুটো একই কথা প্রকাশ করে, তবে এভাবে বললে কিছুটা অস্পষ্টতা থাকে, যেমন ক্রিয়া বল A বস্তু B বস্তুতে প্রয়োগ করলে প্রতিক্রিয়া বল B বস্তু A বস্তুতে প্রয়োগ করবে, অর্থাৎ দুটো আলাদা বস্তুতে কাজ করছে, ফলে বলদুটো কাটাকাটি হবে না, এ বিষয়টি এখানে স্পষ্ট নয়।

গাণিতিকভাবে লেখা যায়: F2 = -F1, যেখানে F1 ক্রিয়া বল হলে প্রতিক্রিয়া বল F2 এর সমান, কিন্তু দিক বিপরীতমুখী হওয়ার কারণে (-) চিহ্ন যুক্ত হয়েছে।

নিউটনের তৃতীয় সূত্রের অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন পৃথিবী যদি কোন বস্তুকে আকর্ষণ করে, তবে ওই বস্তুটিও পৃথিবীকে একই বলে আকর্ষণ করবে যা আগেই আলোচনা হয়েছে। মাটিতে যখন আমাদের ওজনের বল প্রযুক্ত হয়, তখন মাটিও প্রতিক্রিয়া বল প্রদান করে, ফলে আমরা ওজন অনুভব করি। এখানে দারুণ একটা ব্যাপার আছে, যেটা সাধারণ প্রশ্নে গিয়ে দেখা হবে।
আমরা যখন হাঁটি, তখন মাটিতে বল প্রয়োগ করি, মাটির প্রতিক্রিয়া বলে আমরা অগ্রসর হতে পারি। পিচ্ছিল রাস্তায় ঘর্ষণ বল খুব কম হলে সামনের দিকে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রতিক্রিয়া বল না পাওয়াতে হাঁটা মুশকিল হয়ে পড়ে। তুমি হয়ত খেয়াল করেছ, গাড়ি চলার সময় গাড়ির চাকার রাস্তার স্পর্শে থাকা অংশ কিন্তু পেছনের দিকে চলে, অথচ ঘর্ষণ বলের প্রতিক্রিয়ায় গাড়ি সামনে এগিয়ে যায়।

এই প্রশ্নের ক্ষেত্রে পাথরে 50 N বলে ধাক্কা দেয়ার ফলে প্রতিক্রিয়ায় পাথরও তোমাকে একই বলে ধাক্কা দিবে। যদি ঘর্ষণযুক্ত সমতল হত, তাহলে এই ধাক্কার ফলে তুমি মাটিতে একটা বল প্রয়োগ করে ঘর্ষণ বলের প্রভাবে নিজের জায়গায় থাকার বা সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতে পারতে।

কিন্তু এখানে যেহেতু ঘর্ষণ নেই, পাথরকে 50 N বলে ধাক্কা দিলে পাথরে F/m = 50 N / 100 kg = 0.5 ms-2 ত্বরণ সৃষ্টি হবে, কিন্তু তোমারও বিপরীত দিকে 50 N / 50 kg = 1 ms-2 ত্বরণ সৃষ্টি হবে, তাই ধাক্কাটা শুধু মুহুর্তের জন্য প্রয়োগ করতে পারবে। অর্থাৎ, ঘর্ষণবিহীন সমতলে টানা 10 s ধাক্কা দিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।

তবে এই ক্ষণিক সময়ের ত্বরণে উভয়ের একটা বেগ সৃষ্টি হবে এবং ঘর্ষণ না থাকায় (সাথে যদি ধরে নিই বাতাসের বাঁধা বা আর কোন বলও নেই) এরপর উভয়ে সমবেগে চলে ঘর্ষণহীন সমতলের দুই বিপরীত মাথায় পৌঁছে যাবে। v = u + at বা v = at থেকে বলা যায় তোমার শেষ বেগ পাথরের শেষ বেগের দ্বিগুণ হবে।

এখন প্রশ্ন হলো ত্বরণ যদিও আমি জানি, কিন্তু ত্বরণটা কতক্ষণ প্রযুক্ত হবে তা নির্ণয় করে বেগ বের করা কি বের করা সম্ভব? সম্ভবত না, এটুকু তথ্য এর জন্য যথেষ্ট নয়। এটা নির্ভর করছে ধাক্কা কীভাবে দেয়া হচ্ছে তার ওপর। যেমন তুমি যদি হাত দিয়ে ধাক্কা দেও, তাহলে হাত প্রসারিত করতে থাকায় পিছিয়ে যেতে থাকলেও কিছুটা সময় পাথর আর তোমার হাত স্পর্শে থাকবে, এই সময়টা বলের ক্রিয়াকাল হবে, যার ওপর শেষ বেগ নির্ভর করবে।

তবে এটা ঠিক যে, এটা একটা অস্থিতিস্থাপক সংঘর্ষের মত, যেহেতু পাথর ও তোমার মধ্যে 50 N বল প্রয়োগের ঘটনা আছে, স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষের সূত্র এখানে প্রযোজ্য হবে না। অবশ্য ভরবেগের সংরক্ষণ ঘটবে, ভরবেগের সংরক্ষণের সূত্র প্রয়োগ করলে দেখবে তোমার শেষ বেগ পাথরের শেষ বেগের দ্বিগুণ, যা বেগ ও ত্বরণের সম্পর্কের সূত্র থেকেও একই রকম পেয়েছিলাম।

নিউটনের তৃতীয় সূত্র থেকে ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্রের প্রমাণ দেখা যায়।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র থেকে,
F2 = -F1
বা, m2a2 = -m1a1
বা, m2 × (v2-u2)/t = – m1 × (v1-u1)/t
বা, m2 × (v2-u2) = – m1 × (v1-u1)
বা, m2v2 – m2u2 = – m1v1 + m1u1
বা, m1u1 + m2u2 = m1v1 + m2v2
যা ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র।

ঘর্ষণ বল

ঘর্ষণ বলের কথাটা বেশ কয়েকবার এর মধ্যেই এসেছে, এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এটা কতটা জড়িত তার কিছু ধারণা হয়ত এর মধ্যেই পেয়ে গেছ। ঘর্ষণ বল: যে বল সংস্পর্শে থাকা দুটি বস্তুর মধ্যকার আপেক্ষিক গতিকে বাঁধা প্রদান করে

সাধারণভাবে যদিও সমতল মনে হয়, বাস্তবে প্রতিটি পৃষ্ঠেই ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বা আণুুবীক্ষণিক যন্ত্রে দেখলে দেখা যাবে কিছু মাত্রায় হলেও তা এবড়োথেবড়ো। একারণে কোনকিছুর ওপর দিয়ে অন্যকিছু যেতে চাইলে বাঁধার সৃষ্টি হয়। ওজন যত বেশি হয়, এই বাঁধাও তত বেশি হয়।

সংজ্ঞাতেই বলা হয়েছে ঘর্ষণ বল আপেক্ষিক গতিতে বাঁধাদানকারী বল। তুমি ওপরের ছবি থেকে চিন্তা করতে পারবে ডানে-বামে যেদিকেই যেতে চাওয়া হোক না কেন এই এবড়োথেবড়ো ভাব এতে বাঁধার তৈরি করবে। মানে ঘর্ষণ বলের বৈশিষ্ট্য হলো এটা সবসময়ই গতিপথের বিপরীত দিকে কাজ করে। বাক্সটা ডানে নিয়ে যেতে চাইলে ঘর্ষণ বল কাজ করবে বামে, বামে নিয়ে যেতে চাইলে ডানে। তবে হ্যা, দুদিকে এটার মান সমান হবে এমন কোন কথা নেই।

ঘর্ষণের প্রকারভেদ (৪ প্রকার):
১. স্থিতি ঘর্ষণ: সংস্পর্শে থাকা দুটো বস্তু পরস্পরের সাপেক্ষে স্থির থাকা অবস্থায় যে ঘর্ষণ বল কার্যকর হয়। টেবিলের ওপরে থাকা একটা ভারি বাক্সকে ধরা যাক তুমি F বলে ধাক্কা দিলে, কিন্তু দেখা গেলো বাক্সটা একটুও নড়লো না। আসলে এখানে ঘর্ষণ বল f = -F হয়ে দুটো মিলে কাটাকাটি হয়ে যাচ্ছে, তাই বাক্সটা স্থির থাকছে। একটা পর্যায় পর্যন্ত তুমি বল বাড়ালে ঘর্ষণ বলও বেড়ে বাক্সকে স্থির রাখবে, তবে কখনোই ঘর্ষণ বল প্রযুক্ত বল থেকে বেশি হবে না।

২. গতি ঘর্ষণ: সংস্পর্শে থাকা দুটো বস্তু পরস্পরের সাপেক্ষে চলমান থাকা অবস্থায় যে ঘর্ষণ বল কার্যকর হয়। আগের বাক্সটাকে কিছুটা বেশি বলে ধাক্কা দিলে সেটা যখন চলতে শুরু করবে, তখন থেকে গতি ঘর্ষণ কার্যকর হবে। তোমার দেয়া বল F আর গতি ঘর্ষণ f হলে লদ্ধি কার্যকর বল হবে F’ = F-f। গতি ঘর্ষণের মান ওজনের বা উল্লম্বভাবে প্রযুক্ত বলের ওপর নির্ভর করে।
কোন বস্তুর ওজন W হলে এর জন্য গতি ঘর্ষণ f = μW। এখানে μ হলো গতি ঘর্ষণ সহগ, যা দুটো পৃষ্ঠের জন্য উল্লম্ব বল ও গতি ঘর্ষণের অনুপাত নির্দেশ করে। যদি কোন পৃষ্ঠকে এর ওপর থাকা বস্তুসহ θ কোণে ঢালু করলে বস্তুটি গতিশীল হওয়া শুরু হয়, তবে μ = tan θ। এইচএসসি পর্যায়ে বিস্তারিত রয়েছে এ বিষয়গুলো।

৩. আবর্ত ঘর্ষণ: একটি তলের উপর যখন অন্য কোন বস্তু গড়িয়ে বা ঘুরতে ঘুরতে চলার সময় কার্যকর ঘর্ষণকে বলে আবর্ত ঘর্ষণ। অন্য ঘর্ষণ বলগুলো থেকে এর মান কম হয়, একারণে একই ভরের চাকা লাগানো একটি স্যুটকেস টেনে নেয়া চাকাবিহীন অনুরূপ কিছু টানা থেকে অনেক সহজ বোধ হয়।

৪. প্রবাহী ঘর্ষণ: তরল বা বায়বীয় পদার্থের মধ্য দিয়ে চলার সময়ে বস্তুতে কার্যকর ঘর্ষণকে প্রবাহী ঘর্ষণ বলে। প্যারাস্যুটে ধীরে ধীরে নেমে আসা যায় প্রবাহী ঘর্ষণের কারণে। প্যারাস্যুটের ক্ষেত্রফল বিস্তৃত বলে এটা বাতাসের বাধা বাড়িয়ে দেয়, যা একরকম প্রবাহী ঘর্ষণ।

ঘর্ষণকে একটি প্রয়োজনীয় উপদ্রব হিসেবে চিন্তা করা যায়। এটা সত্য যে ঘর্ষণের কারণে আমাদের অনেকসময় অসুবিধেয় পড়তে হয়, ঘর্ষণের কারণে অপ্রয়োজনীয় তাপশক্তি উৎপাদন হয়, যাতে শক্তির অপচয় হয়। ঘর্ষণ বলকে পরাস্ত করতে বিভিন্ন যন্ত্র ও যানবাহনে অতিরিক্ত জ্বালানি শক্তি খরচ করতে হয়।

তবে এর বিপরীতে ঘর্ষণ না থাকলে হাঁটা, গাড়ি চালানো কিছুই সম্ভব হত না, ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরানো যেত না, কাগজে পেনসিল দিয়ে লেখা যেত না। আসলে এসব কিছুর প্রয়োজনও তখন থাকতো না, কারণ ঘর্ষণ না থাকলে মহাবিশ্ব নিমেষেই ধূলিস্মাৎ হয়ে যেত, কেননা অণু-পরমাণু পরস্পরকে ধরে রেখে পদার্থ গড়ে তুলতে পারে ঘর্ষণের জন্য।

কাজেই যদিও কখনো ঘর্ষণ অসুবিধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবুও এটাই সত্য ঘর্ষণ না থাকলে কিছুই থাকতে পারতো না।

যেহেতু ঘর্ষণ আবশ্যক, আবার অধিকতর ঘর্ষণ অসুবিধার তৈরি করে, তাই ঘর্ষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার হয়। গতির ওপর ঘর্ষণের প্রভাব ও ঘর্ষণ কমানো-বাড়ানো সংক্রান্ত আলোচনা তোমাদের বইয়ের ৯০-৯৩ পৃষ্ঠায় আছে, দেখে নিও।

প্রয়োজনীয় গাণিতিক সূত্রাবলি

১. নিউটনের প্রথম সূত্র: F = 0 হলে, v = u
২. নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র: F = ma
৩. নিউটনের তৃতীয় সূত্র: F2 = -F1
৪. নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র:
৫. r উচ্চতায় অভিকর্ষজ ত্বরণ:
৬. ভরবেগ: p = mv
৭. ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র: m1u1 + m2u2 = m1v1 + m2v2
৮. স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষে গতিশক্তির সংরক্ষণ সূত্র: ½ m1u12 + ½ m2u22 = ½ m1v12 + ½ m2v22
৯. গতি ঘর্ষণ: f = μW
১০. গতি ঘর্ষণ সহগ: μ = tan θ
১১. লদ্ধি কার্যকর বল: F’ = F-f

অনুশীলনী – সাধারণ প্রশ্ন

১. চলন্ত ট্রেন থেকে নামার চেষ্টা করলে তুমি কেন সামনের দিকে আছাড় খেয়ে পড়?

চলন্ত বাহন থেকে নামার চেষ্টা করা বিপজ্জনক হতে পারে, এর কারণ হলো গতি জড়তা। তুমি পা স্থির মাটিতে রাখলেও গতি জড়তা তোমাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চায়, যার কারণে আছাড় খেয়ে পড়তে পারো এবং দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

প্রাসঙ্গিকভাবে, বাস থেকে নামার সময় বাম পা দিয়ে নামতে বলা হয়, কারণ বাসের দরজা বামদিকে থাকে, বাম পা দিয়ে দরজার সাথে সমান্তরালে থাকে বলে গতি জড়তাকে সামাল দেয়া তুলনামূলক সহজ হয়। তবে চলন্ত বাহন থেকে নামা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ।

২. চিত্র 3.21 এ দেখানো সুতায় হ্যাঁচকা টান দিলে A সুতাটি ছিড়বে, ধীরে ধীরে টান দিলে B সুতাটি ছিড়বে। কেন?
প্রশ্নটা আমাকে বেশ ভাবনায় ফেলে দিয়েছিলো। তো চিন্তা করে যেটা এর সম্ভাব্য কারণ মনে হলো, হ্যাঁচকা টান দিলে A সুতার সহনক্ষমতার থেকে বেশি বল প্রয়োগ হওয়াতে এটা ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে টান দিলে B সুতার ওপর টান বল ও বাক্সের ওজন উভয়টি প্রযুক্ত হবে, A সুতায় শুধু টান বল প্রযুক্ত হবে। তাই A সুতার আগেই B সুতা সহনক্ষমতার সীমায় পৌঁঁছে ছিঁড়ে যাবে।

৩. বেশি ভরের বন্তুর ওজন বেশি বা বল বেশি তাই উপর থেকে ছেড়ে দিলে তার ত্বরণ বেশি হবে, কথাটি কি সত্যি?
আমরা আগেই গাণিতিকভাবে দেখেছি, অভিকর্ষজ ত্বরণ বস্তুর ভরের ওপর নির্ভর করে না। কেননা ওজন বা ভর বেশি হলে অভিকর্ষ বল F = GMm / R2 বেশি হবে সত্য কিন্তু এই বলের ফলে বস্তুতে সৃষ্ট ত্বরণ যেহেতু a = F/m, তাই বেশি বল প্রয়োগেও ভারি বস্তুর ত্বরণ বেশি হবে না।

৪. তুমি একটি লিফটের ভেতর ওজন মাপার যন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছো। লিফটের ক্যাবল ছিড়ে গেল। তোমার ওজন কত দেখাবে?
সাধারণভাবে যখন তুমি ওজন মাপো, তোমার ওজন যন্ত্রের ওপর প্রযুক্ত হয় এবং যন্ত্র একটা মান প্রদর্শন করে। কিন্তু লিফটের ক্যাবল ছিঁড়ে গেলে লিফট ও এর অভ্যন্তরের সবকিছু মুক্তভাবে নিচের দিকে পড়তে থাকবে। ভূমি স্পর্শ করার আগ পর্যন্ত ওজন মাপার যন্ত্র আর তুমি একই ত্বরণে পড়তে থাকায় কোন বল ওজন মাপার যন্ত্রে প্রযুক্ত হবে না। তাই এখানে ওজন দেখাবে ০।

মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তু কোন ওজন অনুভব করে না। তুমি যখন ভূমিতে থাকো, ভূমিতে W বল প্রয়োগে ভূমিও তোমাকে প্রতিক্রিয়া বল প্রদান করে, তাই তুমি ওজন অনুভব কর। যখন মুক্তভাবে কোনকিছু নিচে পড়তে থাকে, তখন কোন বাঁধাদানকারী বল থাকে না, তাই ওজনও অনুভব হয় না।

এটা অবশ্য নিউটনীয় বলবিদ্যা অনুযায়ী, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান একদমই ভিন্নভাবে এটা ব্যাখ্যা করে, যেখানে গ্রাভিটির পরিবর্তে স্পেসটাইম কার্ভেচারের ধারণা ব্যবহার করা হয়। যদি তুমি কৌতুহলী হও, এই ভিডিওটা চেক করতে পারো।

৫. পুরোপুরি ঘর্ষণহীন একটা পৃষ্ঠে একটা পাথরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিজের দিকে আলার চেন্টা করলে কী হবে?
এর আগে ঘর্ষণবিহীন পৃষ্ঠে পাথরকে ধাক্কা দেয়া নিয়ে সমস্যা দেখেছিলাম। টানার ক্ষেত্রে পাথর যেমন তোমার দিকে এগিয়ে আসবে, তুমিও পাথরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকবে এবং যতক্ষণ টানা হবে, উভয়ের মধ্যে ত্বরণ সৃষ্টি হবে। বুঝতেই পারছো, এখানে দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে।

৬. জড়তা কাকে বলে? জড়তা কয় প্রকার?
৭. বল কাকে বলে?
৮. কোন স্থির বস্তুর জড়তা কী দ্বারা পরিমাপ করা হয়? (উত্তর- ভর)
৯. সাম্য বল ও অসাম্য বল বলতে কী বোঝ?
১০. কোনো বস্তুর ভরবেগ কাকে বলে?
১১. দেখাও যে, বল = ভর x ত্বরণ।
১২. ভরবেগের সংরক্ষণ নীতি বলতে কী বোঝ?
১৩. ঘর্ষণ কাকে বলে? বিভিন্ন প্রকার ঘর্ষণের নাম লেখ।
১৪. ঘর্ষণ একটি প্রয়োজনীয় উপদ্রব-এর স্বপক্ষে যুক্তি দাও।
৬-১৪ নং প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের আলোচনায় সরাসরি এসেছে।

অনুশীলনী – গাণিতিক প্রশ্ন

১. লেখচিত্রের বিভিন্ন সময়ে ত্বরণ নির্ণয় করতে হবে। ত্বরণকে ভর দিয়ে গুণ করে বল পাওয়া যাবে। লেখচিত্রটি এরকম হবে-

২. প্রথম 2 সেকেন্ডে,
ত্বরণ, a1 = F1 / m = 10 N / 5 kg = 2 ms-2
শেষবেগ, v1 = u + a1t1 = 2 ms-2 × 2 s = 4 ms-1
অতিক্রান্ত দূরত্ব, s1 = ut1 + ½ a1t12 = ½ × 2 ms-2 × (2 s)2 = 4 m

পরের 5 সেকেন্ডে,
অতিক্রান্ত দূরত্ব, s2 = v1t2 = 4 ms-1 × 5 s = 20 m

শেষ 3 সেকেন্ডে,
ত্বরণ, a3 = F3 / m = 20 N / 5 kg = 4 ms-2
অতিক্রান্ত দূরত্ব, s3 = v1t3 + ½ a3t32 = 4 ms-1 × 3 s + ½ × 4 ms-2 × (3 s)2 = 30 m

সর্বমোট অতিক্রান্ত দূরত্ব, s = s1 + s2 + s3 = 4 m + 20 m + 30 m = 54 m

(দ্বিতীয় 5 সেকেন্ডের বেগ ও তৃতীয় 3 সেকেন্ডের আদিবেগ v1 এর সমান। আগেই বলেছিলাম, নিয়ম হলো অঙ্কের সবগুলো ধাপে প্রতিটা রাশির সাথে সবসময় একক যুক্ত করা নিয়ম। যদিও বেশিরভাগ সময়ে আমি এই নিয়ম ভঙ্গ করে থাকি 🙄 এবং এজন্য পরীক্ষায় নাম্বার কমানো হয় না, তারপরও নিয়ম এটাই এটা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।)

৩. এটা সমাধানের জন্য আগের অঙ্কের মতই প্রথম 10 s ও পরের 5 s এর জন্য দূরত্ব নির্ণয় করতে হবে। অঙ্কে দূরত্ব বলা হয়েছে, যেটা স্কেলার। কাজেই মোট দূরত্ব নির্ণয়ের জন্য দূরত্বদুটো যোগ করতে হবে। যদি সরণ বলা হত, তাহলে বিয়োগ করতে হত। দ্বিধা এড়ানোর জন্য উত্তরে দূরত্ব ও সরণ দুটোই উল্লেখ করে দিতে পারো।

৪.
শুরুতে নৌকা ও তুমি উভয়ে স্থির ছিলে। নৌকার ভর m1, আদিবেগ u1 ও শেষবেগ v1 আর তোমার ভর m2, আদিবেগ u2 এবং শেষবেগ v2 হলে,
m1u1 + m2u2 = m1v1 + m2v2
বা, 0 = 100 kg × v1 + 50 kg × 10 ms-1
বা, v1 = – 5 ms-1
যেহেতু – নির্দেশ করে নৌকার বেগ তোমার বেগের বিপরীত দিকে তথা তীরের বিপরীত দিকে।
তাহলে, নৌকার বেগ তীরের বিপরীত দিকে 5 ms-1

৫.
গতি ঘর্ষণ বল, f = μW = μ × mg = 0.01 × 10 × 9.8 = 0.98 N
অর্থাৎ, কাঠের টুকরো নাড়াতে 0.98 N এর অধিক বল প্রয়োগ করতে হবে।

যদি কাঠের টুকরোর ওপর 100 kg ভরের পাথর রাখা হয়, এখনো সংস্পর্শে থাকা পৃষ্ঠ একই থাকাতে μ এর মান একই থাকবে। এক্ষেত্রে,
গতি ঘর্ষণ বল, f’ = μW’ = μ × m’g = 0.01 × (10+100) × 9.8 = 10.78 N
তাহলে এখন 10.78 N থেকে অধিক বল দরকার হবে।

মেঝে ঘর্ষণহীন হলে কোন গতি ঘর্ষণ থাকতো না। তাই যেকোন পরিমাণ বল প্রয়োগে ত্বরণ সৃষ্টি হত।

অনুশীলনী – বহুনির্বাচনী প্রশ্ন

অনুশীলনী – সৃজনশীল প্রশ্ন

1. (গ)
ত্বরণ, a = 0.8 ms-2
তাহলে, কার্যকর বল, F’ = ma = 10 kg × 0.8 ms-2 = 8 N
অতএব, প্রযুক্ত বল, F = F’ + f = 8 N + 1.5 N = 9.5 N

1. (ঘ)
ঘর্ষণবিহীন মেঝেতে পুরো 9.5 N ত্বরণ কার্যকর হবে।
অতএব, ত্বরণ হবে, a’ = 9.5 N / 10 kg = 0.95 ms-2
অর্থাৎ, ঘর্ষণবিহীন মেঝেতে ত্বরণ ঘর্ষযুক্ত মেঝে অপেক্ষা অধিক হবে।

2. (খ)
প্রযুক্ত বল ভরবেগের পরিবর্তনের সমানুপাতিক কথাটি সঠিক নয়। বরং নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র অনুসারে ভরবেগের পরিবর্তনের ‘হার’ প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক।

কোন বস্তুর আদি ভরবেগ p1 এবং t সময় F বল প্রয়োগের ফলে পরিবর্তিত ভরবেগ p2 হলে ভরবেগের পরিবর্তন হবে p2 – p1 এবং ভরবেগের পরিবর্তনের হার হবে (p2 – p1)/t।

তাহলে ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক কথাটি নির্দেশ করে F ∝ (p2 – p1)/t

2. (গ)
এখানে দ্বিতীয় বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তন, অর্থাৎ, (m2v2 – m2u2) = 4 kg ms-1 দেয়া আছে।
এখন, m1u1 + m2u2 = m1v1 + m2v2
বা, m1v1 = m1u1 – (m2v2 – m2u2)
বা, 5 × v1 = 5 × 5 – 4
বা, v1 = 4.2 ms-1

2. (ঘ)
ভরবেগের পরিবর্তন না হলে,
m2v2 – m2u2 = 0
বা, m2 (v2 – u2) = 0
হয়, m2 = 0 অথবা v2 = u2

সংঘর্ষ ঘটলে বল প্রযুক্ত হবে, ফলে ভরযুক্ত বস্তুর ক্ষেত্রে v2 = u2 হবে না।
কাজেই, m2 = 0

অর্থাৎ, দ্বিতীয় বস্তুটি ভরহীন।

Series Navigation<< নবম-দশম শ্রেণি – পদার্থবিজ্ঞান – দ্বিতীয় অধ্যায়: গতি (গাণিতিক অংশ)নবম-দশম শ্রেণি – পদার্থবিজ্ঞান – চতুর্থ অধ্যায়: কাজ, ক্ষমতা ও শক্তি >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *