আঘাতপ্রাপ্ত অঙ্গ নতুন করে গজায় যে প্রাণীর!

মিলিমিটার স্কেলে যে প্রাণীর দৈর্ঘ্য মাপতে হয়, তার নাম কিনা ৯ মাথাওয়ালা গ্রীক মিথলজির সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকান্ড দানবের নামে! হাইড্রার গল্পটা চমকপ্রদ এক রূপকথা, যেখানে গ্রীক মিথলজির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর হারকিউলিস তাকে বধ করেছিলেন। গ্রীক মিথলজিতে তার নাম অবশ্য হেরাক্লিস, রোমান নাম হলো হারকিউলিস। হারকিউলিসের গল্পে রাজা ইউরেস্থিস তাকে খুব কঠিন ১২টা কাজ দিয়েছিলেন, নিমিয়ার দুষ্ট দানব সিংহকে বধের পর দ্বিতীয় কাজ ছিলো হাইড্রাকে বধ করা।

ছবি সোর্স: MTG Wiki

হাইড্রাকে বধ করার গল্পটা রোমাঞ্চকর। হাইড্রাকে গ্রীক দেবী হীরা (Hḗrā) প্রতিপালন করেছিলেন শুধু হারকিউলিসকে বধ করার জন্য। দানব সিংহ থেকে হাইড্রাকে বধ করা ছিলো আরো কঠিন। আগের কাজটি একা করলেও এবার হারকিউলিস সাথে নেন বিশ্বস্ত ভাতিজা লোলাউসকে এবং বেরিয়ে পড়েন ঘোড়ার রথে চড়ে হাইড্রা লার্না লেকের পথে। হাইড্রার গভীর গুহা থেকে তাকে বের করতে জ্বলন্ত তীর ছুঁড়তে লাগেন হারকিউলিস। শেষবধি গগুহা থেকে বেরিয়ে এলে তার কাস্তে, মতান্তরে তলোয়াড় কিংবা বিখ্যাত গদা দিয়ে সম্মুখ সমরে মুখোমুখি হন। তবে হাইড্রাকে বধ করা সহজ ছিলো না, কেননা তার কোন মাথা কাটলেই সেখানে গজাতো দুটো করে নতুন মাথা! হারকিউলিস বুঝতে পারেন, একা একে পরাস্ত করা যাবে না। অভিনব বুদ্ধি নিয়ে এগিয়ে আসে লোলাউস, হারকিউলিস হাইড্রার কোন মাথা কাটলে সেখানে মশাল দিয়ে সেখানে পুড়িয়ে দিতেন তিনি যেন মাথা আর না গজায়।

হীরা যখন বুঝতে পারেন হারকিউলিস জিততে চলেছে, তখন তিনি এক দানব কাঁকড়া পাঠিয়ে দেন, তবে হারকিউলিস তার শক্তিশালী পা দিয়ে চূর্ণ করে দেয় সেটি। হাইড্রাকে বধ করার শেষ পর্যায়টা বাকি ছিলো, কেননা তার ৯ মাথার শেষেরটি ছিলো অমর। ওটাকে জীবন্ত বিশাল পাথরে চাপা দিয়ে হাইড্রার রক্তে তলোয়াড় ডুবিয়ে বিজয়ী হয়ে শেষ হয় হাইড্রা অভিযান। তবে গল্পটা আরেকটু বাকি, হাইড্রাকে বড় করে তোলা হীরা তার বধে বেদনার্ত হয়ে তাকে রাতের আকাশের Hydra constellation (হিন্দু মিথলজিতে বাসুকী নক্ষত্রপুঞ্জ) ও কাঁকড়াকে Cancer constellation (কর্কট নক্ষত্রপুঞ্জ)-এ পরিণত করেন।

হাইড্রা কনস্টেলেশন ৮৮টি নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে সর্ববৃহৎ

বাস্তবের হাইড্রা অবশ্য কোন দানব না। নিডারিয়া পর্বের নেহায়েত নিরীহ এক প্রাণী। এটা অবশ্যি মানুষের চোখে বলছি, ক্রাস্টাসীয় প্রাণী, ড্যাফনিয়া, সাইক্লপস এদের কাছে হাইড্রা দানব হলেও হতে পারে, কারণ হাইড্রা মাংশাসী শিকারী প্রাণী, আর এই প্রাণীগুলো আছে তার শিকারের তালিকায় ।

তবে ১০ মি.মি এর কাছাকাছি দৈর্ঘ্যের ক্ষুদ্র হাইড্রার এই নামের পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণ তা হলো এর প্রচন্ড পুনরুৎপত্তি ক্ষমতা। মিথলজির হাইড্রার মাথা কেটে দিলে যেমন দুটো মাথা গজাতো, বাস্তবের হাইড্রাকে দু’টুকরো করে ফেললে তা দুটো হাইড্রাতে পরিণত হবে। হাইড্রার এমনকি স্বাভাবিক মৃত্যু নেই।

ছবি সোর্স: Przemysław Malkowski – উইকিমিডিয়া কমনস

অবশ্য এর অর্থ এই না যে হাইড্রার কখনোই মৃত্যু ঘটে না। হাইড্রার পুনরুৎপত্তি ক্ষমতার সীমা রয়েছে- খাদ্যাভাবে, রাসায়নিক প্রভাবে, শিকারীর শিকার হয়ে হাইড্রার জীবনের সমাপ্তি হতে পারে। তবে অনুকূল পরিবেশে সে চিরযৌবনা, কখনো তার বার্ধক্য আসে না, কেননা কিছুদিন পরপর হাইড্রার সবগুলো কোষ নতুন করে তৈরি হয়। দেহ কয়েক টুকরো করে ফেললে টুকরোগুলোতেও নতুন করে বাকি দেহ তৈরি হয়ে প্রতিটা আলাদা হাইড্রাতে পরিণত হয়।

হাইড্রার সাথে মিথলজির দানবের আরেকটা মিল আছে। এর মুখছিদ্র ঘিরে থাকে কয়েকটি (১-১২টি) কর্ষিকা, যা দানবের বহুসংখ্যক মাথার কথা মনে করিয়ে দেয়।

হাইড্রার অঙ্গ গজানো বা পুনরুৎপত্তি কিভাবে ঘটে?

মূলত ইন্টারস্টিশিয়াল নামক একটি কোষ এদের শরীরে থাকায় হাইড্রা পূনরূৎপত্তি ক্ষমতাসম্পন্ন।এদের দেহপ্রাচীরের কোষগুলো বহিঃস্থ ও অন্তঃস্থ দুটি স্তরে বিন্যাস্ত থাকে। উভয় স্তরে বিশেষ একধরণের কোষ থাকে, যার নাম ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ। ইন্টারস্টিশিয়াল কোষগুলোর টটিপটেন্সি ক্ষমতা আছে।

টটিপটেন্সি হলো কোন কোষের বিভাজিত হয়ে দেহে উপস্থিত সব ধরণের কোষে রূপান্তর হওয়ার ক্ষমতা। এই আশ্চর্য ক্ষমতাসম্পন্ন ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোন ধরণের ত্বকীয় কোষে পরিণত হতে পারে। এই কোষটিই হাইড্রাকে খন্ডায়িত অংশ থেকে অন্য অঙ্গ সুযোগ দেয়।

প্রতি প্রায় ৪৫ দিনে হাইড্রার দেহের পুরাতন কোষগুলো ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ দ্বারা সৃষ্ট নতুন কোষ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়- তাই হাইড্রা চিরনবীন, চিরতরুণ। হাইড্রার মুকুল সৃষ্টি ও বংশ বিস্তারেও ভূমিকা রাখে ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ।

ছবি – Peter Schuchert – উইকিমিডিয়া কমনস

তথ্যসূত্র ও সহায়তা:

উইকিপিডিয়া – হাইড্রা
জীববিজ্ঞান – একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
Wikipedia – Labours of Hercules
রোর বাংলা – বহুমস্তক হাইড্রা: গ্রিক উপাখ্যানের প্রায় অমর দানব
LIVESCIENCE – Hail the Hydra, an Animal That May Be Immortal

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *