কেন গেম এখন শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়? গেমের আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়…

মানুষ কেন গেম খেলে? উত্তরটা হওয়া উচিৎ ছিলো বিনোদনের একটি মাধ্যম হিসেবে। একটা সময় আমরা নোকিয়া মোবাইলে যখন স্নেক গেম খেলতাম, তখনকার প্রেক্ষিতে এই সংজ্ঞা সঠিক হলেও হতে পারে, কিন্তু এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় শুধু এটুকুর মধ্যেই গেম সীমাবদ্ধ নেই। গেম নিয়ে আমরা হয়ে পড়ছি খুব বেশি সিরিয়াস, পরিণতিও হচ্ছে ভয়াবহ।

পাবজি, ফ্রি ফায়ার, কল অফ ডিউটি কিংবা সর্বশেষ Among Us-এর মত গেমগুলো রীতিমত আসক্তি পর্যায়ে পৌছে যাচ্ছে, এমনকি গেম খেলতে না দেয়ায় আত্মহত্যা [] বা নিজের বাবাকে হত্যা করে মাথা-পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলার [] মত গা শিউরে ওঠা ঘটনা আমরা দেখেছি সংবাদপত্রে।

এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে হয়ত গেমিংকে জাস্টিফাই করা যেতে পারে, হয়ত গেম খেলার পক্ষে শতশত যুক্তির ফিরিস্তি দেয়া যেতেই পারে, কিন্তু সর্বোপরি বর্তমানে গেমের প্রভাব যে আমাদের জীবনে অধিকাংশে নেতিবাচক এটা সম্ভবত অস্বীকার করার সুযোগ নেই। গেমের জন্য প্রচুর অর্থব্যয়, সময়ের অপচয়, নিজের কাজে অমনোযোগ, পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতাসহ সামাজিক জীবনে যে প্রভাব পড়ছে, তাকে আপনি কীভাবে অস্বীকার করবেন?

আমাদের একটি বিশেষ ক্ষমতা হলো এবস্ট্রাক্ট রিজনিং। আমরা একই বিষয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে নিজের মধ্যে যুক্তি-প্রতিযুক্তি উপস্থাপন করতে পারি। বিশেষ করে আমরা যা করতে চাই, বা পছন্দ করি, তাকে ডিফেন্ড করা আমাদের একটি সহজাত স্বভাব। কাজেই, ওপরের কথাগুলোর বিপরীতেও আপনি যুক্ত উপস্থাপন করতে পারেন, কিন্তু আরেকটু ভেবে দেখুন, আশা করি আপনি বুঝবেন গেমিংকে যতটা নিরীহ মনে হয়, ততটা হয়ত না।

কেন গেম খেলা আসক্তি হতে পারে?

এটা বুঝুন যে, কোম্পানিগুলো, যারা গেম বানাচ্ছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই চায় আপনি গেমটি খেলায় প্রচুর সময় ব্যয় করুন। আপনি দেখবেন বিভিন্ন গেম খেলার সাথে সাথে গেমটি ক্রমশ সহজ থেকে কঠিন হয়ে ওঠে আর চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। ফলে আপনি বিরক্ত হয়ে পড়েন না এবং বেশি থেকে আরো বেশি চেষ্টা করতে থাকেন চ্যালেঞ্জগুলো পূরণের জন্য।

এই সহজ ব্যাপারটা বুঝলে আপনার জন্য বোঝা কঠিন হওয়া উচিৎ নয় যে, গেমগুলো আসলে সেভাবেই বানানো হয় যেন তা খেললে আসক্তি আসে। কোম্পানির গেমটি কতটা চলছে, তাদের কতটা আয় হচ্ছে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে গেমটি কতটা আসক্তিকর, তার ওপর। আর এজন্য পাবজির মত হাই গ্রাফিক্সের গেম যেমন, তেমনি Among Us এর মত কার্টুনিস্টিক গ্রাফিক্সের গেম দুটোই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে সক্ষম হয়েছে, কারণ তারা আসক্তি সৃষ্টি করতে পারে।

কেন এটা ক্ষতিকর?

সময়: আপনি যদি রেগুলার গেমার হয়ে থাকেন, তাহলে একটু হিসেব করুন, গত তিনদিনে ঠিক কত ঘন্টা আপনি গেমের জন্য ব্যয় করেছেন। এই সময়টাতে আপনি নিজেকে এর থেকে উত্তম কোন কাজে নিয়োজিত রাখতে পারতেন কিনা। যদি মনে হয়, না, সমস্যা নেই, পোস্টটি পড়তে থাকুন, আমরা জানানোর চেষ্টা করছি অলস সময়টাতে ভালো কী করা যেত।

অপচয়: গেমের জন্য বিভিন্নভাবে আমরা খরচ করছি। অনেকে, যাদের ৫ হাজার টাকার একটি ফোন সব চাহিদা পূরণে যথেষ্ট ছিলো, তাদের বাজেট ২৫ হাজার হয়ে যাচ্ছে, শুধুমাত্র পাবজিতে কিছুটা স্মূথনেসের জন্য। গেমের মধ্যে বিভিন্ন পারচেজ করছি এবং আরো বিভিন্নভাবে অর্থ ব্যয় করছি।

বিচ্ছিন্নতা ও অমনোযোগ: প্রযুক্তি পৃথিবীর একপ্রান্তকে আরেক প্রান্তের সাথে যুক্ত করেছে অথচ আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন করছে। এটা এককভাবে শুধু গেম নয়, সামাজিক যোগাযোগ ও প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। হয়ত কেউ আপনার সাথে কথা বলছে, কিন্তু আপনি মোবাইলের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন, কথার দিকে না। আপনার পরিবারের সদস্য আর আশেপাশের মানুষদের সাথে ক্রমেই একটি দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে।

অশ্লীলতা ও অসামাজিকতা: অনেক গেমেই এমন অনেক কনটেন্ট থাকে যা অসামাজিক ও অশ্লীল হিসেবে বিবেচিত। অনেক সময়ই এমন অনেক চ্যালেঞ্জ বা মিশন থাকে যা ধর্ম ও সমাজের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য। আপনি বলতে পারেন, এটা জাস্ট একটা গেম, কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত আপনার বাস্তব জীবনে এর প্রভাব নেই? আর তর্কের খাতিরে, যদি না-ও থাকে, গেম হিসেবেও বিনোদনের জন্য এ বিষয়গুলো কি অনুচিৎ নয়?

অপরাধপ্রবণতা: বিভিন্ন গেমের কনটেন্টগুলোর মধ্যে সহিংসতা, খুন ও বিভিন্ন অপকর্মগুলোকে খুব হালকাভাবে দেখানো হয়, আর সত্যিকার অর্থেই অনেককে তা অপরাধপ্রবণ করে তোলে।

চোখ-কান: স্ক্রীনের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকা কিংবা ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে গেম খেলা, আপনার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

ডিপ্রেশন: এই পয়েন্টটি ব্যাখ্যা করা কঠিন এবং আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি না। কিন্তু এটা বাস্তব যে, অর্থহীন কাজ, যেখানে ক্ষণিকের আনন্দ পাওয়া যায়, দিনশেষে তা ডিপ্রেশনের দিকে ধাবিত করে।

গেম খেলার ক্ষেত্রে পরামর্শ

Islam Question & Answer-তে ইলেকট্রনিক গেম সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার সারমর্ম হলো, অবসরে বিনোদনের অংশ হিসেবে গেম খেলা জায়েজ হতে পারে, যদি তা নিজের আবশ্যক কাজগুলোতে বিঘ্ন না ঘটায় এবং কোন হারাম কনটেন্ট না থাকে। কিন্তু বিভিন্ন গেমেই তা থাকে, যেমন, সৃষ্টিকর্তার বিরোধিতা, ভিন্নধর্মীয় প্রতীক, কালো জাদু, কুফফারদের মহিমান্বিত করা, ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ, অশ্লীলতা, জুয়া প্রভৃতি সংশ্লিষ্টতা, অপরাধপ্রবণ করে তোলা, বাস্তবজ্ঞান থেকে বিচ্যুত করা, মিউজিকের মত হারাম বিষয়ের সংশ্লিষ্টতা, শারীরিক ক্ষতি প্রভৃতি। বিস্তারিত এখানে

এখন আমরা যদি গেমগুলোর দিকে দেখি, বর্তমানের অধিকাংশ গেমে এর এক বা একাধিক উপস্থিত, বিশেষ করে অন্য বিষয়গুলো না থাকলে অন্তত মিউজিক কিন্তু প্রতিটা গেমেই থাকে। তো এক্ষেত্রে, গেম যদি খেলতে হয়, লক্ষ্য রাখুন যেন আপনার জরুরী কাজগুলো গেমের দ্বারা বাঁধাগ্রস্থ না হয়, মিউজিক বন্ধ রাখুন এবং বাকি পয়েন্টগুলো অনুপস্থিত এমন গেম বেছে নিন।

অবশ্যই নিজের কাজগুলো যেন গেমের জন্য ব্যহত না হয়। বিনোদনের বাইরে গেমের বিষয়ে সিরিয়াস না হওয়াই মনে হয় ভালো। অনেকেই গেমের পক্ষে আরো অনেক উদ্দেশ্য হাজির করে, এমনকি পাবজি খেলে কেউ কেউ নাকি যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নেয় (!)। তো, শুধু এটুকু বলি, নিড ফর স্পীড খেলে সোজা রাস্তায় গাড়ি চালাতে নেমে গেলে সম্ভবত জীবনে আর গেম খেলার প্রয়োজন হবে না…

আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়

আগে যেমনটা বলা হয়েছে, আপনি হয়ত গেমে আসক্ত হয়ে থাকলে এটাকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করবেন এবং খুব সম্ভবত আপনার মধ্যে ক্ষমতা আছে যে আপনি এই যুক্তিগুলোর পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করবেন। তাই যদি আপনি আসক্তি থেকে মুক্ত হতে চান, প্রথমেই ডিফেন্ড করার চেষ্টা বাদ দিতে হবে, এর ক্ষতিগুলো বুঝতে হবে এবং সাথে মনের মধ্যে ইচ্ছা করতে হবে যে আপনি গেমের প্রতি আসক্তি বাদ দিতে চান।

হ্যা, বিনোদনের প্রয়োজন জীবনে আছে, তবে জীবন মানে শুধু বিনোদন নয়। অবশ্যই আমরা অবসাদগ্রস্থ হই এবং তখন কিছু  আপনি যে সময় গেম খেলে অপচয় করছেন, সেই সময় কাজে লাগিয়ে অনেকে এর থেকে ভালো কিছু, প্রোডাক্টিভ কিছু করছে। জীবনের মানে বোঝার পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা না থাকলে এই জীবনের গল্পটি ডাউনলোড করে শুনতে পারেন।

এখন আমরা কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরার চেষ্টা করছি যা গেমের আসক্তি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। এখানে একটি কথা, আমরা নিজেরা যে এ বিষয়গুলো পুরোপুরি অনুশীলন করি বা করতে পারি, এমন নয়। তবে এটা আমাদের বিশ্বাস, এই পয়েন্টগুলো অনুসরণ করলে আপনার জন্য তা উত্তম হবে।

১. ট্রেন্ডিং গেম থেকে দূরে থাকুন

একটি গেম ট্রেন্ডিং হওয়ার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে এটি প্রচন্ড এডিকটিভ। একসময়ে ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যানস, এখন পাবজি কিংবা অ্যামং আস যে গেমগুলো ট্রেন্ডিং হয়েছে, তাদের গেমপ্লে ও গ্রাফিক্সে বিস্তর তফাৎ থাকলেও মিলটা কিন্তু এখানেই। কাজেই এই গেমগুলো থেকে দূরে থাকাটাই নিরাপদ।

২. পরিবারের সাথে সম্পর্ক তৈরি করুন

এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ এই সময়ে এসে। পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে বাবা-মার সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো দিনদিন কেমন শিথিল হয়ে পড়ছে। এখানে একটি পরিবর্তন আনতে শুরুটা হোক নিজের পরিবার থেকে! ঘরের কাজগুলোতে অংশ নিন, পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটান।

৩. ইবাদত ও প্রডাক্টিভ কাজে নিয়োজিত হোন

ইবাদতে আরো সময় দিন। প্রডাক্টিভ কিছু কাজে নিয়োজিত হোন। বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিংয়ে অনেকেই যুক্ত হচ্ছেন, এধরণের কোন কাজে যুক্ত হতে পারেন। শেখার জন্য অনলাইনে পর্যাপ্ত রিসোর্স আছে। ব্লগিং আরেকটি চমৎকার কাজ, কেননা ব্লগিং করে আপনি জানার এবং জানানোর আনন্দ পেতে পারেন।

৪. বই পড়া ও অন্যান্য উত্তম অভ্যাস গড়ে তুলুন

অবসরে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলাটা বেশ ভালো। এর সাথে নতুন কিছু জানা ও শেখার চেষ্টা করুন। ইন্টারনেটকে যদি আপনি ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে তা সত্যি চমৎকার একটা অস্ত্র। উইকিপিডিয়া, The Fact Site, Space.com সহ অনেক ওয়েবসাইট ও ব্লগে অনেক ইন্টেরেস্টিং কিছু আছে। পিসি ব্যবহারকারীরা এন্ডলেস ওএস ইন্সটল করে নিতে পারেন, কেননা এখানে প্রচুর অফলাইন লার্নিং রিসোর্স যুক্ত আছে।

৫. একটু ঘোরাঘুরি

করোনাকালীন এই সময়টা দূরে কোথায় ভ্রমণের জন্য অবশ্য খুব উপযুক্ত নয়, তবে নিজের বাসার ছাদ থেকে তো ঘুরে আসতেই পারেন! ঘরের মধ্যেও এককোণায় বসে মোবাইল না চালিয়ে একটু হাঁটাহাটি করাটাও কিন্তু মন্দ নয়!

৬. ছোটদের জন্য উত্তম আদর্শ হোন

কারণ তারা অনুকরণপ্রিয়! আপনি কী বলছেন তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি কী করছেন। কাজেই ভাইবোন বা আপনার থেকে ছোট যারা আছে চেষ্টা করুন আপনার থেকে ভালো কিছু পায়, খারাপটা নয়!


লেখা: মোঃ ইমরান মিয়া
সম্পাদনা: তাহমিদ হাসান মুত্তাকী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *