মহাবিশ্বের বিশালতা: আপনার কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি

রাতের ওই আকাশের জ্বলজ্বলে একেকটা তারা নাকি আমাদের সূর্যের মতই, আর প্রায়ই, আমাদের সূর্যের চেয়ে আরো অনেক অনেক বড় সব আগুনের গোলা, নিস্তদ্ধ রাতের শান্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই মন এক অসীম শূন্যতায় হারিয়ে যায়, হঠাৎই মনে হয়, ক্ষুদ্র, বড় ক্ষুদ্র আমরা। মহাবিশ্বের অসীমতার বুকে এক বিন্দুও কি বলা চলে? ভাবনাগুলো হঠাৎই এলোমেলো হয়ে যায়, মন দূরের ওই তারার দেশে হারিয়ে যায়।

আমাদের পৃথিবী, আমাদের বাসস্থান। আমি, আপনি, আমাদের সবার ঠিকানা। একে ঘিরে আমাদের স্বপ্ন, আমাদের ভাবনা, আমাদের চাওয়া, আমাদের হতাশা। একান্নো কোটি বর্গ কিলোমিটার, শুনতে মনে হয় অনেক, অনেক। হ্যাঁ, আমাদের পৃথিবীটা ছোট্ট নয়, ক্ষুদ্র আমাদের তুলনায় অনেকটা বড়। কিন্তু, যখন আরেকটু বড় করে ভাবি?

আমাদের সসীম মস্তিষ্কের অসীম কথাটার তাৎপর্য বোঝা কতটা সম্ভব, তা বলা কঠিন, তবে ইউনিভার্সকে আপনি যতটা সম্ভবত বড় ভাবছেন, বা যতটা বড় জানেন, তার চেয়ে তা অনেক অনেক অনেক বড়!

চাঁদ, ইউনিভার্সে আমাদের সবচেয়ে কাছের সঙ্গী। কত দূরে সে? যতটা কাছের মনে হচ্ছে, ততটাও নয়। চাঁদ আর আমাদের মাঝের যে ‘ছোট্ট’ দূরত্ব আছে, তার মধ্যে আমাদের পৃথিবীর মত আরো ৩০ টা পৃথিবী ধরবে! সেখানে, ১২ জন মানুষ, তার পায়ের ছাপ বসিয়ে এসেছে, আর এটাই সবচেয়ে দূরবর্তী জায়গা, যেখানে, কোন মানুষ যেতে পেরেছে।

চাঁদ আমাদের চেয়ে তিন লক্ষ চুরাশি হাজার কিলোমিটার দূরে!

মঙ্গল গ্রহ, আমাদের প্রতিবেশী। লাল গ্রহের মাটিতে পৌছাতে আমাদের পাড়ি দিতে হবে প্রায় ২২৫ মিলিয়ন কিলোমিটার। আর যখন সবচেয়ে দূরে, তখন তা ৪০১ মিলিয়ন কিলোমিটার। চাঁদের চেয়ে প্রায় ৯৮৬ গুণ বেশি দূরে, এর মাঝে ধরবে প্রায় তিরিশ হাজার পৃথিবী। আর মঙ্গলের আকাশ থেকে আমাদের পৃথিবী দেখতে শুধুই এক বিন্দু!

মঙ্গলগ্রহ থেকে তোলা নাসার রোভার কিউরিসিটির ছবিটির ছোট্ট বিন্দুটিই আমাদের পৃথিবী

ভয়েজার ১, ১৯৭৭ সালে প্রেরিত মানুষের সৃষ্ট সবচেয়ে দূরবর্তী বস্তু। পৃথিবী থেকে দূরত্ব, 148.685 AU (২ জানুয়ারী ২০২০ পর্যন্ত)। AU হলো এস্ট্রোনোমিকাল ইউনিট, যেটা পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব নির্দেশ করে, অর্থাৎ ১৪ কোটি ৯৬ লক্ষ কিলোমিটার। এর দীর্ঘ যাত্রায় এখন সে প্রতি সেকেন্ডে চলেছে ১৭ কিলোমিটার বেগে, জাস্ট ইমাজিন, ঘন্টায় ৬১২০০ কিলোমিটার। কিন্তু এমনকি এই বেগেও, আমাদের সোলার সিস্টেমকে আগামী ৩০০০০ বছরে অতিক্রম করতে পারবে না।

দূরত্বের জন্য এখন আমরা আলোকবর্ষের হিসেবে চলে যাবো। আলোকবর্ষ হলো, সেই দূরত্ব, যেটা পৃথিবীর প্রতি বছরে আলো অতিক্রম করে। 63 239.7263 AU এর সমান, আর কিলোমিটার এককে 9.461 ট্রিলিয়ন! ভাবতে পারেন, এক ট্রিলিয়ন মানে 1018!

প্রক্সিমা সেন্টিউরি, সূর্যের পর আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। দূরত্ব ৪.২৪ আলোকবর্ষ। যদি ভয়েজার-১, সঠিক পথে এই গতিতে চলতে থাকে, সেখানে পৌছুতে তার ৭০০০০ বছর চলে যাবে।

১৯৯০ সালে, পাওয়ার সেভিংয়ের জন্য ভয়েজার-১ এর ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার আগে তোলা শেষ এই ছবিটি Pale Blue Dot নামে পরিচিত। দেখুন তো, পৃথিবীকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা!

এবার একটা মজার হিসাব, যদি পৃথিবী থেকে সরাসরি সেখানে একটা রাস্তা করা হয়, আর সেখানে আপনি ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে চলা কোন গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন, পৌছুতে যে সময় আপনার লাগবে, তা এই বিশ্বজগতের বয়সের চেয়ে ৬ গুণ বেশি! আই মিন, সিরিয়াসলি! আর এমনকি সেসময় পর্যন্ত প্রক্সিমা সেন্টিউরি থাকবেই না।

এবার আমরা ভাবনাকে আরো বড় করি, চলে আসি আমাদের গ্যালাক্সিতে, মিল্কিওয়ে! নিচের ছবিটা দেখুন, খুব ভালো করে তাকালে রেড মার্ক করা স্থানের মাঝে খুব ছোট্ট একটা ইয়েলো ডট দেখা যাবে, এটা সেই এরিয়া, যেখানে পৌছেছে পৃথিবীতে মানুষের শেষ চিহ্ন, মানব প্রেরিত রেডিও সিগনাল এর চেয়ে বেশি দূরে এখনো যেতে পারেনি। এর বাইরে? নীরবতা, নীরবতা, শুধুই নীরবতা… যদি এর বাইরে কোন প্রাণের স্পন্দন থাকে, তবে তারা আমাদের কোন সিগনাল পাবে না।

এই গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্ব ১ লক্ষ আলোকবর্ষ, এখানে আমাদের সূর্যের মত নক্ষত্র আছে অন্তত ১০০ বিলিয়ন, মানে ১০০,০০০,০০০,০০০ টি‍!। কিন্তু এই গ্যালাক্সি আসলে কিছুই নয়!

এরপর আমরা যদি আসি, গ্যালাক্সির লোকাল গ্রুপে, সেখানে রয়েছে ৫৪ টি গ্যালাক্সি, আমাদের মিল্কিওয়ের মত। সব মিলিয়ে এর দুপ্রান্তের দূরত্ব প্রায় ১০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ! মানবমস্তিষ্কের পক্ষে এটা বোধহয়, একটু বেশিই বড়, কিন্তু এটাও কিছু নয়।

আরো বড় করলে আমরা পাবো Virgo Supercluster, যেখানে রয়েছে অন্তত ১০০ টি গ্যালাক্সির গ্রুপ। আর দুপ্রান্তের দূরত্ব? মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া ১১০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ!

কিন্তু ম্যাসিভ এই Virgo Supercluster কিছুই না, যখন আমরা Laniakea Supercluster এর কথায় আসি। লক্ষ গ্যালাক্সির বসতি এখানে, দুপ্রান্তের দূরত্ব ৫২০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ।

কিন্তু আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের অতি ক্ষুদ্র জায়গা নিয়ে এই ম্যাসিভ এরিয়ার অবস্থান, যেখানে রয়েছে অন্তত ২ ট্রিলিয়ন ভিন্ন ভিন্ন গ্যালাক্সি আর আরেকবার মিল্কিওয়েকে স্মরণ করুন, প্রতিটা গ্যালাক্সি আসলে খুব খুব বড়।

দৃশ্যমান ইউনিভার্স হলো সেই জায়গা, যেখান থেকে আলো আমাদের পৃথিবীতে আসে। আর এর বাইরে যারা আছে, তাদের আলো বিশ্বজগতের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবী পর্যন্ত পৌছানোর সময় পায়নি। এই পৃথিবী থেকে সব দিকে ৪৬.৫ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৬৫০ কোটি আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিদ্যমান এই দৃশ্যমান মহাবিশ্ব।

আমরা জানি না এর বাইরে কি আছে। আমাদের ধারণার তা সম্পূর্ণ বাইরে। এবং খুবই সম্ভব এর বাইরে এই বিশ্বজগৎ অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত, অথবা হতে পারে, তা ক্রমাগত বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে, আলোর গতিতে অথবা তার চেয়ে বেশি। এমনকি যদি মানুষ ও পৃথিবী চিরকাল থেকে যায়, ইউনিভার্সের অনেক অনেক জায়গা থেকেই আলো এখানে কখনোই পৌছাবে না, কারণ তা হয়তো আলোর চেয়েও দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, কে জানে?

এখানে একটা কথা, Cosmic Inflation তত্ত্ব অনুযায়ী ইউনিভার্সের মোট ব্যাপ্তি দৃশ্যমান ইউনিভার্সের 1.5*10^23, অর্থাৎ, ১৫০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ গুণ! এরপর মাল্টিভার্স বা প্যারালাল ইউনিভার্সের কথায় না-ইবা গেলাম…

আর যদি ইউনিভার্স অসীম হয়? সুবহানআল্লাহ! আমাদের ছোট্ট মস্তিষ্কে বোধহয় অসীম কথাটা ধরা কঠিন, অতএব, এখন ভাবনার রাজ্য থেকে বের হয়ে তাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া যাক!

“যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন স্তরে স্তরে সপ্তাকাশ। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখিতে পাইবে না; তুমি আবার তাকাইয়া দেখ, কোন ত্রুটি দেখিতে পাও কি? অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও, সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হইয়া তোমার দিকে ফিরিয়া আসিবে।

[সূরা মূলক: ৩-৪]

[সূরা মূলক: ৩-৪]

নোট

গত কয়েকদিন কিছু পড়াশোনা ও মূলত এই ভিডিও অনুসরণে পোস্টটি লেখা। স্বাভাবিকভাবেই ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে, এমন কিছু চোখে পড়লে কমেন্টে জানানোর অনুরোধ থাকলো। এতক্ষণ কষ্ট করে পোস্টটি পড়ায় শুকরিয়া, জাজাকাল্লহু খইরন। ভালো লাগলে কমেন্ট করুন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন।

ছবি ক্রেডিট:

NASA/JPL-Caltech/MSSS/TAMU

Andrew Z. Colvin, CC BY-SA 4.0

3 Comments

  1. আপনাদের ব্লগের লেখা গুলা পড়তে বেশ ভালো লাগে। কারন আপনাদের লেখাগুলার সাইজ তেমন বড় হয় না কিন্তু মূল ভাবটা ফুটিয়ে তোলা হয়।এগিয়ে যান দোয়া রইলো আপনাদের জন্য।আর হ্যাঁ লেখার সাইজটা এরকম ই রাখবেন যাতে পাঠকরা বিরক্ত বোধ না করে।ধন্যবাদ।।।।।

    • জাজাকাল্লহু খইরন। পরামর্শের জন্য শুকরিয়া। ইন শা আল্লাহ, আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব যেন আমাদের লেখায় বিরক্তিবোধ না আসে।

  2. জাজাকাল্লাহু খাইরান। Neil deGrasse Tyson এর COSMOS : A Space-time Odyssey এর ‘Standing up in the milky way'(প্রথম পর্বে) মহাকাছের বিশালত্ত video আকারে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *