আমার মায়ের স্মার্টফোনটি Helio S60, আমি নিজে Symphony Z40 স্মার্টফোন ব্যবহার করি। তাই স্বাভাবিকভাবেই হেলিও-র ফিরে আসার খবরটি আমার জন্য ছিলো এক্সাইটিং। হেলিও ব্র্যান্ড সম্পর্কে হয়ত অনেকের জানা নেই। এটি সিম্ফনি ব্র্যান্ডের একটি সিস্টার ব্র্যান্ড। তাদের প্রিমিয়াম স্মার্টফোনগুলো এই ব্র্যান্ডিংয়ের অধীনে আসতো। ২০১৮ সালের আগস্টে Helio S60 ও S5 রিলিজ হয় হেলিও ব্র্যান্ডের সর্বশেষ দুটি স্মার্টফোন হিসেবে। এরপর আসলে সিম্ফনির পক্ষ থেকে ১১ হাজার টাকার ওপরের বাজেটে স্মার্টফোন এই কয়েক বছরে আসেনি, হেলিও ব্র্যান্ডটিও থেমে গেছিলো ওখানেই।
হেলিও ব্র্যান্ডিংয়ে মোট ৭টি স্মার্টফোন এসেছে- S1, S2, S5, S10, S20, S25 ও S60। এর মধ্যে Helio S5 একদমই ভালো কিছু অফার করতে পারেনি। তবে বাকি স্মার্টফোনগুলোতে দেখা মিলেছে বিভিন্ন প্রিমিয়াম ফিচারের, যার মধ্যে মডেলভেদে দেখা মিলেছে অ্যামোলেড ডিসপ্লে, থ্রিডি টাচ, ওয়ারলেস চার্জিং কিংবা থ্রিডি ফেস আইডি-র মত ফিচারগুলোর। এছাড়া S5 ছাড়া বাকি প্রতিটি স্মার্টফোন ছিলো মেটাল অথবা গ্লাস মেটাল বিল্ড। এসব মিলিয়ে ১৫-২৬ হাজার টাকায় মিড বাজেট সেগমেন্টে স্মরণীয় কিছু স্মার্টফোন এনেছিলো হেলিও।

তবে হেলিও-কে খুব সফল ব্র্যান্ড বলা যায় না, দীর্ঘ সময়ের জন্য হারিয়ে যাওয়া অন্তত তেমনটাই নির্দেশ করে। Helio S5 ও S60-র স্টক শেষ করা হয়েছিলো বড় ধরণের ডিসকাউন্ট প্রদান করে। মিড বাজেটের শক্ত কম্পিটিশনে হেলিও-র প্রতিপক্ষরাও ছিলো শক্তিশালী। এছাড়া বড় দুটো দুর্বলতা ছিলো হেলিও-র, স্পেয়ার পার্টসের পর্যাপ্ত এভেইলেবিলিটি না থাকা ও প্রয়োজনমত সফটওয়্যার আপডেট না দেয়া- যেটা একটা মিড বাজেট স্মার্টফোন থেকে এক্সপেক্টেড থাকে।
নিয়নবাতি টেলিগ্রাম চ্যানেল
নিয়নবাতি ফেসবুক গ্রুপ
শেষ পর্যন্ত প্রায় ৪ বছর পর আবারো ফিরে আসলো হেলিও। কিছুটা চমকের সাথে, কিছুটা অদ্ভুততার সাথে, আর হয়ত কিছুটা হতাশার সাথেও। হেলিওর নতুন মডেলটি হলো Helio 30। আগের মডেলগুলোর নামের ধারায় এবার S30 রাখা হয়নি। এছাড়া হেলিও-র ফিরে আসা সিস্টার ব্র্যান্ড না হয়ে বরং সিম্ফনির একটি সিরিজ হয়ে আসা বলা যায়, কেননা হেলিও-র আলাদা ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইট থাকলে Helio 30-র কোন আপডেট সেখানে আসেনি, এসেছে সিম্ফনির মেইন ওয়েবসাইট ও পেজে। অবশ্য স্মার্টফোনের গায়ে সিম্ফনির ব্র্যান্ডিং থাকছে না, ব্যাকপার্টে শুধু Helio 30 লেখাটির দেখা মিলবে।
স্মার্টফোন মার্কেটের বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী প্রাইস ট্রেন্ড অনুযায়ী বেশ কম্পিটিটিভ প্রাইসিংয়ের সাথে Helio 30 এসেছে। এর দাম রাখা হয়েছে ১৪,৯৯০ টাকা। অবশ্য এখানে একটা কিন্তু আছে, এর সাথে ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। এখন প্রায় সব স্মার্টফোন ব্র্যান্ড-ই ভ্যাট ছাড়া মূল্য উল্লেখ করছে। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত স্মার্টফোনে সম্ভবত ৫% ভ্যাট প্রযোজ্য, সেক্ষেত্রে স্মার্টফোনটির মূল্য দাঁড়াচ্ছে ১৫,৭৪০ টাকার মত।

আজ ২৯ জুন থেকে মার্কেটে চলে এসেছে Helio 30। এতে থাকছে সুন্দর ডিজাইন, আকর্ষণীয় ক্যামেরা, ৬/১২৮ র্যাম-রম ও সামগ্রিকভাবে ডিসেন্ট কনফিগারেশন। তবে পুরনো মডেলের Helio P70 চিপসেট ব্যবহার করাটা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এছাড়া থাকছে Android 11, যেখানে লেটেস্ট Android 12 দিতে পারলে স্মার্টফোনটি পূর্ণতা পেতো বলে মনে করি।
ডিজাইনের ক্ষেত্রে এই বাজেটের মধ্যে এরকম সৌন্দর্য্যের অধিকারী ফোন দুর্লভ। সাইডফ্রেম প্লাস্টিকের, হেলিওর আগের মডেলগুলোর মত মেটাল ফ্রেম এবার দেখা যাচ্ছে না। তবে এর ব্যাকপার্টে লেদার টেক্সচার্ড ফিনিশিং দেয়া হয়েছে, যা ডিউরেবিলিটিতে ভূমিকা না রাখলেও অন্তত একটি বেটার ফিল দিবে। Flame Orange ও Mint Green দুটি ব্যতিক্রমী কালারে মোবাইলটি আনা হয়েছে।
রেস্মার্টফোনটির ডিসপ্লে সেকশনে থাকছে 6.67″ FHD+ 2400*1080 রেজ্যুলেশনের একটি পাঞ্চহোলযুক্ত IPS ডিসপ্লে। কোন হায়ার রিফ্রেশের কথা বলা হয়নি, অর্থাৎ এটি 60 Hz রিফ্রেশ রেটের ডিসপ্লে।

স্মার্টফোনটির চিপসেট হিসেবে দেয়া হয়েছে Helio P70, যেটা এই ফোনের সবচেয়ে অদ্ভুত একটি দিক। Helio P70 চিপসেটটি ২০১৮ সালের শেষদিকের এবং এই সময়ে মার্কেটে আসা একটি ডিভাইসে এই চিপসেটটির দেখা পাওয়াটা একটু স্ট্রেঞ্জ। 12 nm আর্কিটেকচারের Helio P70-র সিপিইউ-তে ৪টি 2.1 GHz Cortex A73 পারফর্মেন্স কোর ও ৪টি 2 GHz Cortex A53 পাওয়ার সেভিং কোর ব্যবহার করা হয়েছে। জিপিইউ হিসেবে রয়েছে Mali G72-MP3 (সর্বোচ্চ ক্লকস্পিড 900)।
Helio P70 চিপসেটটি Snapdragon 660/662/665-এর সাথে সরাসরি তুলনাযোগ্য। Helio G70/G80/G85/G88 এর সাথে পারফর্মেন্স সামগ্রিকভাবে কাছাকাছি মানের, তবে A75 ও A55 কোর ব্যবহার, Bluetooth 5.0 সমর্থন, H.265 ভিডিও এনকোডিং সমর্থন এরকম কিছু নবতর প্রযুক্তি রয়েছে G সিরিজের উল্লিখিত চিপগুলোতে। P70 অবশ্য এদের থেকে অন্তত একটা মেজর এডভান্টেজ পাবে, তা হলো UFS 2.1 স্টোরেজ সমর্থন।
তবে বলাই যায় Helio G সিরিজ বা Snapdragon থেকে পুরনো চিপসেট হিসেবে Helio P70 সাশ্রয়ী, যা এই স্মার্টফোনের কম্পিটিটিভ প্রাইসিংয়ে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
আরো দেখুন: স্মার্টফোন চিপসেট, SoC (এসওসি): যা আপনার জানা দরকার আছে কিংবা নেই!
Helio 30-এর একটিই র্যাম-রম ভ্যারিয়েন্ট থাকছে , যেখানে রয়েছে 6 GB LPDDR4x র্যাম ও 128 GB UFS স্টোরেজ। UFS ভার্সন যদিও উল্লেখ করা হয়নি, তবে অবশ্যই এটা UFS 2.1 হয়ে থাকবে, এর হায়ার ভার্সনগুলো P70-তে সমর্থিত নয়। যাইহোক, এই দামের অনেক ফোন-ই eMMC 5.1 স্টোরেজসহ আছে, যা থেকে UFS 2.1 স্টোরেজ প্রায় দ্বিগুন গতিসম্পন্ন।

Helio 30-র সবচেয়ে আলোচিত একটি ফিচার হবে সম্ভবত এর 108 MP UHD ক্যামেরা। স্পষ্টতই এখানে পিক্সেল বিনিং প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে, তাই UHD মোড ছাড়া সাধারণ ছবিগুলো 12 MP-তে তোলা হবে। প্রসঙ্গত, পিক্সেল বিনিং নিয়ে একটি মিসকনসেপশন হলো এটা একটি পিক্সেলকে সামহাও একাধিক পিক্সেলে পরিণত করে, বাট একচুয়ালি এটা তার বিপরীতটা করে, অর্থাৎ একাধিক (সাধারণত ৪টি অথবা ৯টি) পিক্সেলকে একটি সুপারপিক্সেলে পরিণত করে। ফলে এই সুপারপিক্সেলগুলো লার্জার পিক্সেল সাইজের সুবিধা নিতে পারে এবং তার সাথে প্রসেসরের জন্য প্রসেসিং দ্রুততর হয়।
এরপরও এই হায়ার রেজ্যুলেশন ক্যামেরা ব্যবহার সত্যিকার অর্থে কতটা কার্যকর আর কতটা গিমিক এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ক্যামেরা নিয়ে রিয়েল লাইফ এক্সপ্রেরিয়েন্স ছাড়া মন্তব্য করা অনুচিৎ মনে করি, তবে এই রেঞ্জের হিসেবে এখান থেকে ভালো ছবি এক্সপেক্ট করব। মেইন ক্যামেরাসহ রেয়ারে থাকছে কোয়াড ক্যামেরা সেটআপ, যেখানে থাকছে একটি করে 5 MP ওয়াইড এঙ্গেল ক্যামেরা, ম্যাক্রো লেন্স ও ডেপথ সেন্সর। সেলফি ক্যামেরা হিসেবে থাকছে একটি 16 MP লেন্স।
দেখতে পারেন: ৮০০০ শব্দে লিনাক্স পরিচিতি

এখানে Android 11 থাকছে। সিম্ফনি স্টক-লাইক ইউআই ব্যবহার করে আসছে বরাবরই। কিছু প্রি-ইন্সটল্ড মোস্টলি আনইন্সটলেবল ব্লট অ্যাপ ছাড়া তাদের ইউআই-তে মূলত এডভার্টাইজমেন্ট থাকে না, যেটা একটা ভালো ব্যাপার। তবে Android 12 দিতে পারলে ফোনটি যে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো, তা বলা-ই বাহুল্য।
স্মার্টফোনটিতে থাকছে 5000 mAh ব্যাটারী। তবে এখানে ফাস্ট চার্জিং সুবিধা থাকছে না, এর চার্জিং স্পিড 10 W, যা দ্বারা ব্যাটারীকে পূর্ণ চার্জ করতে প্রায় ৩ ঘন্টার কাছাকাছি সময় প্রয়োজন। অন্তত 15 W অথবা 18 W চার্জিং না থাকাটা এই ফোনের দাম ও বাদবাকি স্পেকের সাথে যাচ্ছে না।
স্মার্টফোনটির থিকনেস 9.5 mm এবং ওজন 200 g। সেন্সর সেকশনে আসলে জাইরো সেন্সর ও কম্পাস সেন্সরসহ প্রয়োজনীয় সব সেন্সর এখানে থাকছে। সিক্যুরিটির জন্য থাকছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর, যেটি রেয়ার মাউন্টেড।
সবশেষে, চার্জিং ও অ্যান্ড্রয়েড ভার্সন ব্যাপারদুটি ছাড়া এই স্মার্টফোনটি অধিকাংশ দিকে আমার ভালো লেগেছে, কিছু ইমপ্রেসিভ ব্যাপার এখানে আছে। বর্তমান মার্কেটে দাম ১৫-১৬ হাজার টাকা রেঞ্জে 6/128 সহ ডিসেন্ট স্মার্টফোন খুব বেশি নেই, যেকারণে এটি অনেকের জন্য একটি ভালো চয়েস হতে পারে।
হেলিও সিরিজে সামনে আমার একটি প্রত্যাশা থাকবে আগের মত প্রিমিয়াম বিল্ডের ডিভাইস যেন দেখা যায়। এছাড়া আপ টু ডেট টেকের দ্রুত এডপ্টেশন, যেমন- লেটেস্ট অ্যান্ড্রয়েড, রিসেন্ট চিপসেটের উপস্থিতি এক্সপেক্ট করব। তবে আরো জরুরী হলো কোয়ালিটিফুল আফটার সেলস সার্ভিস নিশ্চিত করা। এই বাজেটের স্মার্টফোনে ভার্সন অ্যান্ড্রয়েড আপডেট আশা না করলেও দরকারমত বাগফিক্স/সিক্যুরিটি আপডেট প্রদানে সিম্ফনির সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এবং সেই সাথে স্পেয়ার পার্টস এভেইলেবিলিটিসহ এরকম দিকগুলো নিশ্চিত করতে হবে।