অনেক বড় একটা সংখ্যাকে আপনি কীভাবে লিখবেন? যেমন ধরা যাক পৃথিবীর ভর যদি কিলোগ্রাম এককে লিখতে হয়, তাহলে সেটা হবে মোটামুটি 5972200000000000000000000 kg। এটা শতভাগ এক্সাক্টভাবে মাপা এমন না, এর থেকে 600000000000000000000 kg কম অথবা বেশি হতে পারে। আমি বেশ নিশ্চিত পাঠকদের কেউই সংখ্যাগুলো ঠিকঠাক পড়ার চেষ্টাও করেননি। এরকম বড় সংখ্যাগুলো এভাবে লিখলে পাঠক কিংবা লেখক, কারো জন্য এটা পড়া, লেখা, কিংবা মনে রাখা সুবিধাজনক হবে না।

তাহলে কী করা যেতে পারে? একটা সুন্দর উপায় আছে এরকম সংখ্যাগুলোকে সহজভাবে প্রকাশের জন্য। আমরা সূচক বা exponent ব্যবহার করতে পারি।

সূচক দিয়ে বোঝায় একটা সংখ্যা কতবার গুণ আকারে আছে। ধরা যাক b একটা সংখ্যা, যেটা n বার গুণ আকারে আছে- এটাকে bⁿ অথবা b^n ফরমেটে লেখা হয় এবং পড়া হয় b to the power n এভাবে, অথবা বাংলায় পড়তে চাইলে b-এর n তম ঘাত এভাবে। যতবার গুণ আকারে আছে তাকে পাওয়ার বা ঘাত বলা হচ্ছে। যেমন 10 × 10 × 10 × 10, চারটা 10 গুণ আকারে আছে এখানে, এটাকে লেখা যাবে 104 অথবা 10^4।

বর্গ এবং ঘন

অবশ্য b2 ও b3-কে সাধারণত যথাক্রমে b squared (b-এর বর্গ) ও b cubed (b-এর ঘন) পড়া হয়। এটার কারণও আছে।

1 meter দৈর্ঘ্যের একটা রেখা নিন। এবার এই দৈর্ঘ্যকে বাহুর দৈর্ঘ্য ধরে একটা বর্গক্ষেত্র (square) আঁকুন। তাহলে যে বর্গক্ষেত্র পাওয়া যাবে তার ক্ষেত্রফলকে বলা হবে 1 meter2। যদি আপনি 5 meter দৈর্ঘ্যের বাহু নিয়ে বর্গক্ষেত্র আঁকেন, তাহলে দেখবেন এর ক্ষেত্রফল আগের মত ২৫টি বর্গক্ষেত্রের সমান। অর্থাৎ, এখন ক্ষেত্রফল দাঁড়াবে 25 meter2, 5 meter কে যদি আপনি ২ বার গুণ করেন তাহলে আপনি এটা পাবেন, অর্থাৎ 5 meter*5 meter = (5 meter)2 = 25 meter2

অর্থাৎ কোন দৈর্ঘ্যকে ২ বার গুণ করা হলে সে বাহুর দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট বর্গক্ষেত্র বা Square-এর ক্ষেত্রফল পাওয়া যাবে। একইভাবে চিন্তা করতে পারেন, ৩ বার গুণ করলে সে বাহুর দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ঘনক বা Cube-এর আয়তন পাওয়া যাবে।

শূন্য

সূচক আকারে স্বাভাবিক পূর্ণসংখ্যা থাকলে তা চিন্তা করা বেশ সহজ। যেমন- 45 = 4 × 4 × 4 × 4 × 4 = 1024। 73 = 7 × 7 × 7 = 243।

যদি কোন সংখ্যার সূচক 0 থাকে, তাহলে অবশ্য ব্যাপারটা বেশ ইন্টেরেস্টিং। যেমন 20 মানে শূন্যবার 2 গুণ আকারে আছে। কোন কিছু শূন্যবার গুণ আকারে থাকা এটা কীভাবে চিন্তা করা যায় আসলে? এটা বোঝা সহজ হবে যদি আমরা অন্য কোন সংখ্যার সাথে গুণ 20 থাকলে কী হয় সেখান থেকে আসি।

1 * 20 কে আমরা চিন্তা করতে পারি, 1 এর সাথে শূন্যবার 2 গুণ হচ্ছে। তাহলে আসলে এটা 1-ই থাকবে। অর্থাৎ, 20 = 1 * 20 = 1। অর্থাৎ কোন সংখ্যা to the power 0 হলো 1। এটা শুধু 2 এর জন্য না, যেকোন সংখ্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

আরেকটা মজার ব্যাপার হলো 00 = 1, কিন্তু a যদি 0 বাদে অন্য যেকোন বাস্তব সংখ্যা হয়, তাহলে 0a = 0। আগের উদাহরণের মত করেই চিন্তা করা যায়, 1 * 00, 1 এর সাথে 0 একবারও গুণ করা হয়নি, তাহলে 1-ই থাকবে। কিন্তু 1 * 05, 1 এর সাথে 0 পাঁচবার গুণ আছে- 0 গুণ থাকা মানেই ফলাফল হবে 0।

গমের দানা

দাবার বোর্ড নিয়ে একটা প্রাচীন কিংবদন্তী আছে, যার সত্যতার যদিও কোনরকম প্রমাণ নেই, তবে এটা বেশ চমকপ্রদ। কিংবদন্তী অনুযায়ী ক্ষমতাধর একজন রাজা দাবা খেলা নিয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন এবং তিনি যখন জানলেন দাবার আবিষ্কারক তার রাজ্যের একজন প্রজা- তখন তার চাওয়া অনুযায়ী পুরস্কার ঘোষণা করেন। তো আবিষ্কারক তার পুরস্কার হিসেবে চাইলেন দাবার ৬৪ ঘরের প্রথম ঘরের জন্য ১টি গমের দানা, দ্বিতীয় ঘরের জন্য ২টি গমের দানা, তৃতীয় ঘরের জন্য ৪টি, চতুর্থ ঘরের জন্য ৮টি, পঞ্চম ঘরের জন্য ১৬টি এবং এভাবে পরবর্তী প্রতি ঘরের জন্য এটা দ্বিগুণ হতে থাকবে।

তো একজন সম্পদশালী রাজার জন্য খুব সামান্য পুরষ্কার মনে হচ্ছে, তাই না? হিসাব করে দেখা যাক আসলে রাজাকে কতগুলো গমের দানা দিতে হবে। প্রথম ঘরের জন্য একটি গমের দানা, পরবর্তী প্রতি ঘরের জন্য তা দ্বিগুণ হবে, অর্থাৎ ২ করে গুণ হবে। আমরা সূচক আকারে এটা প্রকাশ করতে পারি। প্রথম ঘরে শুরু হয়েছে 20 = 1 থেকে। পরের ঘরে হয়েছে 21 = 2। এভাবে ৬৪ তম ঘরে গিয়ে 263

20 = 1
21 = 2
22 = 2*2 = 4
23 = 2*2*2 = 8
24 = 2*2*2*2 = 16
25 = 2*2*2*2*2 = 32
26 = 2*2*2*2*2*2 = 64
ইত্যাদি।

অনুমান করার চেষ্টা করুন তো, পরবর্তী দিকে সংখ্যাগুলো কেমন দাঁড়াতে পারে।

একটা জিনিস যদি দেখি, 25 মানে হলো ৫টা ২ গুণ আছে। 23 মানে ৩টা ২ গুণ, 22 মানে ২টা ২ গুণ- এই দুটো গুণ করলে আমরা 25 পাবো। অর্থাৎ, 25 = 2(3+2) = 23 * 22। অর্থাৎ, পাওয়ারে যোগ থাকলে তাদেরকে আলাদাভাবে গুণ আকারে প্রকাশ করা যায়। এটা যদি বুঝি, তাহলে এখন একটু স্কিপ করে করে পরবর্তী মানগুলো বের করা সহজ হবে।

210 = 25 * 25 = 32*32 = 1024
215 = 210 * 25 = 32*1024 = 32768
230 = 215 * 215 = 32768*32768 = 1,074,921,796

যদি এখন 260 তে আসি, তাহলে একটা সত্যিকারের হিউজ সংখ্যা পাবো আমরা। 260 = 230 * 230 = 1,074,921,796*1,074,921,796। এটার মান হলো 1,159,795,050,467,961,616। এরপর 263 হবে এর 23 = 8 গুণ, মানে 9,223,372,036,854,775,808।

চিন্তা করুন, শুরু হয়েছিলো 1 থেকে আর শেষ হলো এত বড় একটা সংখ্যায়, যেটা পড়াটাও চ্যালেঞ্জিং। এটা ৬৪-তম ঘরের জন্য। শর্ত অনুযায়ী প্রথম ঘর থেকে ৬৪-তম ঘর পর্যন্ত গমের দানার সংখ্যা যোগ হবে। একটা কৌশল ব্যবহার করে এই যোগ করাটা খুব সহজ হয়ে যাবে।

খেয়াল করি, প্রথম ঘর পর্যন্ত গমের দানার সংখ্যার যোগফল ১। দ্বিতীয় ঘরের জন্য গমের দানার সংখ্যা ২। দ্বিতীয় ঘর পর্যন্ত যোগফল ৩, তৃতীয় ঘরে দানার সংখ্যা ৪। একইভাবে, তৃতীয় ঘর পর্যন্ত যোগফল ৭, চতুর্থ ঘরে ৮। এভাবে প্রত্যেক ঘরে গমের দানার সংখ্যা আসলে আগের ঘর পর্যন্ত যোগফল থেকে ১ বেশি। তার মানে ৬৩ তম ঘর পর্যন্ত যোগফল 9,223,372,036,854,775,807। ৬৪ তম ঘরের গমের দানাগুলো যোগ করলে সর্বমোট হবে তাহলে 18,446,744,073,709,551,615। 18 কুইন্টিলিয়নেরও বেশি!

সায়েন্টিফিক নোটেশন এবং সিগনিফিকেন্ট ডিজিট

কোন মানকে সহজবোধ্যভাবে প্রকাশ করার জন্য সূচক ব্যবহার করে একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে, যাকে বলা হয় সায়েন্টিফিক নোটেশন। এই পদ্ধতিতে 1 থেকে 10 এর মধ্যবর্তী সংখ্যার সাথে 10-কে কোন সূচকে গুণ আকারে প্রকাশ করা হয়। যেমন 18,446,744,073,709,551,615 কে লেখা হবে 1.8446744*1019

দশমিকের পর যেমন আমরা ঘর সংখ্যা সুবিধা অনুযায়ী নিয়ে থাকি, এখানেও তা করা যায়। যেহেতু অনেক বড় সংখ্যা, তাই যেটুকু কমবেশি হবে তাতে সচারচর খুব একটা যায় আসে না। দশমিকের আগে পরে মিলিয়ে যতগুলো ডিজিটের সঠিক ভ্যালু লেখা হয় তাকে বলা হয় সিগনিফিকেন্ট ডিজিট। যেমন 1.844*1019 এখানে সিগনিফিকেন্ট ডিজিট ৪টি, 1.8446744*1019 এখানে সিগনিফিকেন্ট ডিজিট ৮টি। সূক্ষ্মতর পরিমাপের প্রয়োজন থাকলে অধিক সংখ্যক সিগনিফেন্ট ডিজিট ব্যবহার করতে হয়।

এতক্ষণের আলোচনার পর আমরা পৃথিবীর ভরে ফিরে আসতে পারি। সূচক ব্যবহার করে পৃথিবীর ভর হবে 6*1020 kg কমবেশি 5.9722*1024 kg, যেটাকে লেখা যায় 5.9722*1024 kg ± 6*1020 kg অথবা (5.9722±0.0006)×1024 kg।

ছোট সংখ্যা

এবার এতক্ষণের আলোচনার বিপরীত কিছু চিন্তা করা যাক, খুব ছোট কোন সংখ্যা। যেমন ইলেক্ট্রনের ভর প্রায় 0.000000000000000000000000000000910938 kg। দশমিকের পর ৩০টি 0 আছে এখানে।

এরকম সংখ্যাগুলো লেখার জন্য ঋণাত্মক সূচকের ধারণা প্রয়োজন হবে। আমরা দেখেছি পাওয়ারে যোগ থাকলে গুণ আকারে প্রকাশ করা যায়। পাওয়ারে বিয়োগ থাকলে ভাগ আকারে প্রকাশ করা সম্ভব। যেমন 25 = 2*2*2*2*2, 23 = 2*2*2, তো আমরা লিখতে পারবো 25 / 23 = (2*2*2*2*2) / (2*2*2) = 4 = 22 = 25-3

ঠিক একইভাবে 2-2 = 23-5 = 23 / 25 = (2*2*2) / (2*2*2*2*2) = 1 / (2*2) = 1 / 22। অর্থাৎ, b-n = 1/bn

সায়েন্টিফিক নোটেশন ব্যবহার করে ইলেকট্রনের ভরকে লেখা যাবে 9.10938 * 10-31 kg। দশ দিয়ে ভাগ করা দশমিককে এক ঘর বামে আনার সমতূল্য। এছাড়া দশমিকের আগে সংখ্যার বামে এবং দশমিকের পর সংখ্যার ডানে যেকোনসংখ্যক 0 চিন্তা করা যায়।

এই কনসেপ্টটুকু কাজে লাগিয়ে বলা যায় 9.10938 * 10-31 এর মানে 9.10938 কে ৩১ বার 10 দিয়ে ভাগ করা। একবার দশ দিয়ে ভাগ করলে 0.910938 পাওয়া যাবে, আরো ৩০ বার ভাগ করলে দশমিকের পর 9 এর আগে আরো ৩০টি 0 থাকবে।

সূচকের সূচক

সূচকযুক্ত সংখ্যায় যদি সূচক থাকে, তাহলে সূচকগুলো গুণ আকারে দেখানো যায়। (33)3 – এর মানে হলো 3 বার গুণ আকারে থাকা 3, 3 বার গুণ আকারে আছে- মানে (3*3*3)*(3*3*3)*(3*3*3), অর্থাৎ মোট 3*3 = 9 বার 3 গুণ আকারে আছে। তাহলে (33)3 = 33*3 = 39

তবে (33)3 আর 33^3 কিন্তু সমান না। (33)3 = 39 = 19383, 33^3 = 327 = 7.625597485×10¹²। পার্থক্যটা অনেক বেশি!

মূল

2 বার 2-কে গুণ করলে 4 পাওয়া যায়। 2 এর বর্গ হলো 4। বিপরীতভাবে বলা হবে 4 এর বর্গমূল হলো 2। আবার 3 বার 2-কে গুণ করলে 8 পাওয়া যায়। 2 এর ঘন 8, 8 এর ঘনমূল 2। 4 বার 2-কে গুণ করলে 16 পাওয়া যায়। 4 এর চতুর্থ ঘাত 16, 16 এর চতুর্থ মূল 4।

অর্থাৎ an = b হলে b-এর n তম মূল হলো a। এটাকে লেখা যায় n√b, যাকে n-th root of b, কিংবা b-এর n-তম মূল। অর্থাৎ, an = b হলে n√b = a। তবে বর্গমূলের ক্ষেত্রে 2√b না লিখে শুধু √b লেখা হয়।

ভগ্নাংশ সূচক

সূচকে ভগ্নাংশ থাকলে কী হবে তা দেখা যাক এখন। an = b মানে an আর b সমান। তাহলে এদের যেকোন ঘাত বা মূলও সমান হবে। অর্থাৎ সমীকরণের উভয়পক্ষকে একই ঘাতে উন্নীত করা যেতে পারে। সমীকরণটিকে উভয়পক্ষকে এদের 1/n তম মূলে উন্নীত করা যাক।

অর্থাৎ, b1/n মানে মূলত b-এর n-তম মূল। 161/4 = 4√16 = 2। অন্যান্য ভগ্নাংশ সূচকে থাকলে ঘাত এবং মূলের সমন্বয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন 31.333 ≈ 34/3 = 4√33 = 4√27 = 2.2795।

অনেক বড় সংখ্যা

পদার্থবিজ্ঞান বলছে গতির সর্বোচ্চ সীমা হলো আলোর গতি। বিগ ব্যাঙ তথা মহাবিশ্বের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সময়ে যতদূর পর্যন্ত থেকে আলো পৃথিবীতে আসা সম্ভব তাকে বলা হয় দৃশ্যমান মহাবিশ্ব, আমাদের আধুনিক থেকে অত্যাধুনিকতম প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সীমা। এই বিস্তৃত অঞ্চলে আছে কয়েকশো বিলিয়ন গ্যালাক্সি। আর এর আয়তন 3.566×1080 m3

সূচকের বিস্ময়কর দিকটি হলো অবিশ্বাস্য বড় বা ছোট সংখ্যাকে কত সহজে সূচক দিয়ে লেখা যায়। 10,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000,000 এই সংখ্যাটাকে লেখা যাবে 10100। 1 এর পর 100টা 0।

এই সংখ্যাটার একটা নাম আছে, গুগল, তবে বানান হলো Googol। এর থেকে আরেকটু বড় একটা সংখ্যা হলো Googolplex। Googolplex মানে 10googol অর্থাৎ, 1010^100। অনুমান করতে পারেন সংখ্যাটা কত বড় হতে পারে? যদি প্রতি ঘন মিলিমিটারে একটা করে অঙ্ক লেখা হয়, Googolplex লিখে শেষ করতে আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের মত মোটামুটি 28042624790 টা মহাবিশ্ব লেগে যাবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *