ভাস্কর্য থেকে মূর্তিপূজার সূচনা

“(ইবলীস) বললঃ আপনি যে আমাকে পথভ্রষ্ট করলেন এ কারণে আমিও শপথ করে বলছি – আমি আপনার সরল পথে অবশ্যই ওৎ পেতে বসে থাকব। অতঃপর আমি তাদের সম্মুখ দিয়ে, পিছন দিয়ে, ডান দিক দিয়ে এবং বাম দিক দিয়ে তাদের কাছে আসব, আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবেননা।”
– সূরা আল ‘আরাফ, আয়াত ১৬, ১৭

এমন কিন্তু হয়নি যে সবকিছু সুন্দরভাবে চলছিলো, আর একদিন শয়তান হঠাৎই মূর্তি বানিয়ে এনে হাজির হয়ে সেটির উপাসনা করার জন্য লোকদেরকে প্ররোচিত করলো আর লোকেরা মূর্তিপূজা শুরু করে দিলো। বরং শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে।

হযরত আদম আলাইহিস সালাম, প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী। যাকে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন তাওহীদ, তথা আল্লাহর একত্ববাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন। এমনকি প্রত্যেক নবীর শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাওহীদ, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, না তার কোন শরীক আছে, না আছে তার সমকক্ষ আর কেউ।

তাহলে তাওহীদের শিক্ষাসহ যে মানবজাতির সূচনা হয়েছিলো, কীভাবে তাদের মধ্যে শিরকের প্রবেশ ঘটলো? হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হযরত নূহ আলাইহিস সালামের মাঝামাঝি সময়ে মানুষের মধ্যে মূর্তিপূজার প্রচলন ঘটে, আর এর সূচনা হয়েছিলো ভাস্কর্য থেকে। বুখারী শরীফের হাদিসে ঘটনাটি সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে।

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে প্রতিমার পূজা নূহ্ (আঃ)-এর কওমের মাঝে চালু ছিল, পরবর্তী সময়ে আরবদের মাঝেও তার পূজা প্রচলিত হয়েছিল। ওয়াদ ‘‘দুমাতুল জান্দাল’’ নামক জায়গার কাল্ব গোত্রের একটি দেবমূর্তি, সূওয়া‘আ, হল, হুযায়ল গোত্রের একটি দেবমূর্তি এবং ইয়াগুছ ছিল মুরাদ গোত্রের, অবশ্য পরবর্তীতে তা গাতীফ গোত্রের হয়ে যায়। এর আস্তানা ছিল কওমে সাবার নিকটবর্তী ‘জাওফ’ নামক স্থান। ইয়া‘উক ছিল হামাদান গোত্রের দেবমূর্তি, নাসর ছিল যুলকালা‘ গোত্রের হিময়ার শাখার মূর্তি। নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের কতিপয় নেক লোকের নাম নাসর ছিল। তারা মারা গেলে, শায়ত্বন তাদের কওমের লোকদের অন্তরে এ কথা ঢেলে দিল যে, তারা যেখানে বসে মাজলিস করত, সেখানে তোমরা কতিপয় মূর্তি স্থাপন কর এবং ঐ সমস্ত পুণ্যবান লোকের নামেই এগুলোর নামকরণ কর। কাজেই তারা তাই করল, কিন্তু তখনও ঐ সব মূর্তির পূজা করা হত না। তবে মূর্তি স্থাপনকারী লোকগুলো মারা গেলে এবং মূর্তিগুলোর ব্যাপারে সত্যিকারের জ্ঞান বিলুপ্ত হলে লোকজন তাদের পূজা আরম্ভ করে দেয়।

– সহীহ আল বুখারী (তাওহীদ: ৪৯২০, আধুনিক: ৪৫৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ৪৫৫৫)

 

ইবনু আব্বাস (রাঃ)-সহ অনেক মুফাসসির বলেন: প্রতিমা পূজার সূচনা এভাবে হয়েছিল যে, সৎ ও পূণ্যবান লোকগণ যখন মারা গেলেন তখন তাদের অনুসারীরা তাদের কবরের ওপর মাসজিদ নির্মাণ করে এবং তাদের ছবি তৈরি করে মাসজিদে রেখে দেয় যাতে ঐগুলো দেখে তাদের অবস্থা ও ইবাদতকে স্মরণ করতে পারে। আর এর ফলে যেন নিজেদেরকে তাদের মত গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারে। যখন কয়েক যুগ অতীত হয়ে গেল। তখন ঐ ছবিগুলোর পরিবর্তে তাদের মূর্তি তৈরি করা হল। কিছু দিন অতীত হবার পর ঐগুলোর ইবাদত করতে লাগল এবং সৎ ব্যক্তিদের নামে নামকরণ করতে লাগল। যেমন ওয়াদ, সূওয়া‘আ, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসর ইত্যাদি।

– সূরা আল আরাফ, তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ আয়াত ৫৯-৬৪ দ্রষ্টব্য

অর্থাৎ ওয়াদ, সূওয়া‘আ, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসর ইনারা সৎ ও পূণ্যবান কয়েকজন ব্যক্তিই ছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর তাদের কওম তাদের কবরকে ইবাদতস্থলে পরিণত করেছে এবং সেখানে তাদের ছবি স্থাপন করেছে। কিন্তু এরপর শয়তানের প্ররোচনায় তারা এর পরিবর্তে মূর্তি স্থাপন করে।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো বর্তমান বিতর্কের প্রেক্ষিতে এই মূর্তিগুলো কিন্তু মূর্তি ছিলো না, এগুলো ছিলো ভাস্কর্য। কেননা তখন পর্যন্ত এদের ইবাদত করা হত না। বরং লোকেরা নেক সুরতে শয়তানের ধোঁকায় পতিত হয়েছিলো। তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে ভালোই ছিলো, অর্থাৎ, যেন তারা সৎকর্মশীলদের অবস্থাকে স্মরণ করে নিজেদেরকে সৎকর্মশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

কিন্তু যখন এই প্রজন্মের লোকেরা অতীত হোন, এবং মূর্তিগুলোর বিষয়ে প্রকৃত জ্ঞান হারিয়ে যায়, তখন জনগণের নিকট শয়তান এসে বলল : তোমাদের পূর্ব পুরুষগণ এদের উপাসনা করত ও এদের ওসীলায় তারা বৃষ্টি কামনা করতো। এভাবে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তারা তাদের উপাসনা করতে আরম্ভ করে। [(তাবারী ১২/২৯/৬২, এগাছাতুল লাহফান ২/১৬১)] [সূরা নূহ – তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ আয়াত ২১-২৪ দ্রষ্টব্য]

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : তাই সৎ ব্যক্তিদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, তাদের মর্যাদা থেকে বেশি সম্মান প্রদর্শন করা ও শরীয়ত গর্হিত কাজ মানুষকে পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়। সেজন্য তাদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় আমল করা আবশ্যক।

আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা উম্মু হাবীবাহ ও উম্মু সালামাহ (রাঃ) হাবশায় গীর্জা দেখলেন, সেগুলোকে মারিয়া বলা হয়। সেখানে অনেক ছবি, প্রতিকৃতি ও মূর্তি ছিল। রাসূলুুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসব কথা বললে, তিনি বলেন : ঐ সমাজে যখন কোন সৎ লোক মারা যেত, তারা সেই সৎ লোকের কবরের ওপর মাসজিদ বানাতো এবং তাতে তাদের প্রতিকৃতি বানিয়ে রাখতো। এসব লোকেরা হল সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট। এরা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জাতি হিসাবে গণ্য হবে।

– সহীহ বুখারী হা. ৪২৭, ৩৮৭৩, সহীহ মুসলিম হা. ৫২৮

আপাত দৃষ্টিতে শরীয়তের বিপরীত কোন কাজকে উত্তম মনে হলেও নিঃসন্দেহে আল্লাহ যে বিধান দিয়েছেন তা-ই মানুষের জন্য উত্তম। কাজেই আল্লাহ ও তার রাসুল যে নির্দেশ দেন, তা বিনা বাক্যে মেনে নেয়াতেই মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

সাঈদ ইবনু আবূল হাসান (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনু আব্বাস (রাঃ) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এমন সময়ে তাঁর কাছে এক ব্যাক্তি এসে বলল, হে আবূ আব্বাস, আমি এমন ব্যাক্তি যে, আমার জীবিকা হস্তশিল্পে। আমি এ সব ছবি তৈরি করি। ইবনু আব্বাস (রাঃ) তাকে বলেন, (এ বিষয়ে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমি যা বলতে শুনেছি, তাই তোমাকে শোনাব। তাঁকে আমি বলতে শুনেছি, যে ব্যাক্তি কোন ছবি তৈরি করে মহান আল্লাহ্ তা’আলা তাকে শাস্তি দিবেন, যতক্ষন না সে তাতে প্রান সঞ্চার করে। আর সে তাতে কখনো প্রান সঞ্চার করতে পারবে না।

(একথা শুনে) লোকটি ভীষনভাবে ভয় পেয়ে গেল এবং তার চেহেরা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এতে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বললেন, আক্ষেপ তোমার জন্য, তুমি যদি এ কাজ না-ই ছাড়তে পার, তবে এ গাছ-পালা এবং যে সকল জিনিসে প্রান নেই, তা তৈরী করতে পার।

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) – হাদিস নম্বরঃ ২২২৫

One comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *