বাংলাদেশি বেশ কিছু সামাজিক মাধ্যমের সাথে এর আগেও অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিছুদিন আগে ‘কথা’ একটি সামাজিক মাধ্যম কিছু জনপ্রিয় টেক ইউটিউবারের মাধ্যমে রিভিউ করার পর বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিলো, যদিও শুধু অ্যান্ড্রয়েড আর আইফোনের জন্য বলে খুব বেশি ব্যবহার করা হয়নি, তবে এখনও এটি শক্ত অবস্থানে বলেই জানতে পারলাম।

অন্যদিকে আলাপনা, ফ্রুটিবুক, তুমি-আমিসহ বেশ কিছু এসেছে, কিছুদিনের মধ্যেই হারিয়ে গেছে। অনেক অনেক বছর আগে শুরু হওয়া বেশতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি অন্য সবার থেকে একদমই আলাদা ইন্টারফেস ও ফিচার নিয়ে অবশ্য এখনো আছে, কিন্তু এক্টিভিটি প্রায় শূন্য।

যাইহোক, এটা পরিষ্কার যে ফেসবুকের আধিপত্যের মধ্যে নতুন একটি সামাজিক যোগাযোগের প্রতিষ্ঠিত হওয়া, বা ‘ফেসবুকের বিকল্প’ হওয়ার পর্যায়ে যাওয়া এটা খুবই কঠিন। বিশেষ করে, শুধু ‘বাংলাদেশি’ সোশ্যাল মিডিয়া হওয়াটা এর কারণ হিসেবে যথেষ্ট নয়। মেভবুক কিন্তু নিজেদেরকে অনেকটা ফেসবুকের বিকল্প একটি বাংলাদেশি সামাজিক মাধ্যম হিসেবেই প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে এবং একই টিমের অধীনে পরিচালিত নিউজ পোর্টাল, Mev Times-এ  এধরণের প্রতিবেদন-ই প্রকাশ করা হয়েছে।

তাদের স্লোগান হলো “We will change the nation”। Mev Times এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, CEO ড. তানভীর কামাল বলেন, “বর্তমানে বিশ্বে অনেক সোশ্যাল মিডিয়া রয়েছে কিন্তু কোনো সোশ্যাল মিডিয়া আজপর্যন্ত অশ্লীলতা দমনের উদ্যোগ নেয়নি। একমাত্র মেভবুকই সর্বপ্রথম বিশ্ব থেকে অশ্লীলতা দুর করে সভ্যতার আলো ছড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।”

এরকম শক্ত দাবির পর মেভবুুক নিয়ে অনেক প্রত্যাশা জন্মানো স্বাভাবিক, এবং বাস্তবেও তা হয়েছে। গতরাত নয়টায় মেভবুকের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিলো, আর এ নিয়ে তাদের ফেসবুক গ্রুপে অনেকের মধ্যেই খুব তীব্র আগ্রহের সাথে প্রতীক্ষা দেখা যায়, আমিও উৎসাহী ছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে মেভবুক আমাকে খুবই আশাহত করেছে।

সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জন্য বেশ কিছু উপকারী অবদান রাখে। কিন্তু একইসাথে এটার নেতিবাচক দিকগুলোও গুরুতর। যদি কোনভাবে নেতিবাচক দিকগুলো সম্পূর্ণ পরিহার করে একটি সোশ্যাল মিডিয়া গড়ে তোলা যেত, সেটা সত্যিই অসাধারণ হত। কিন্তু ম্যাভবুকের অশ্লীলতা দূরীকরণের সংজ্ঞা আমার কাছে ফেসবুক বা অন্য কিছু সোশ্যাল মিডিয়া থেকে খুব বেশি ভিন্ন মনে হয়নি।

ছবিতে ৩ নং পয়েন্টটি দেখুন। ফেসবুকেও কিন্তু সরাসরি ১৮+ কোন কনটেন্ট যুক্ত করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে হয়ত এত বিশাল কম্যুনিটির মধ্যে কিছু বিষয়কে মেইনটেন করা সম্ভব হয় না, বা স্ট্রিক্টনেস কিছুটা কম। ম্যাভবুক হয়ত আরেকটু স্ট্রিক্ট হবে এ বিষয়ে, এটুকুই। বিশেষ করে এটা দেখে অবাক হয়েছি, তাদের সাইটে Movie, Games সেকশনগুলো আছে, যেগুলোকে ফিচার হিসেবে দেখানো হয়েছে।

বিশেষ করে, সরাসরি এভাবে মুভি প্রমোট করাটা আমাকে অবাক করেছে, কেননা বর্তমানে কতগুলো অশ্লীলতামুক্ত মুভি আছে, তা আমি বেশ অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে ‘অশ্লীলতামুক্ত’ ব্যাপারটি তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য না, এটা পরিষ্কার।

বরং বাস্তবতা হলো, তারা বাস্তবেই আরেকটি ‘বাংলাদেশি সোশ্যাল মিডিয়া’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কাজ করছে। এবং এখানে তারা চীনের মডেল অনুসরণ করছে। এটা আমার কথা নয়, ম্যাভবুকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নিজেই বলেছেন।

OUR TIMES NEWS অনলাইন পোর্টাল থেকে,

ম্যাভবুক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডঃ তানভীর কামাল আওয়ার টাইমস নিউজকে নব এই ম্যাভবুক সোশ্যাল মিডিয়ার লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, বাংলাদেশ কে ভার্চুয়াল জগতে স্বনির্ভর হওয়া উচিত। যাতে করে বাংলাদেশকে কারোর দ্বারস্থ না হতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনকে আইডল হিসেবে বেঁছে নিয়েছে। কারণ চীনে রয়েছে ‘চীনা ফেসবুক’ খ্যাত উইচ্যা‌ট। চীনের ইন্টারনেট জগতে উইচ্যাটের ম‌তো আর কোনো কিছুরই তাদের কাছে এতো গুরুত্ব নেই। ইনশা-আল্লাহ্ আমরা মেভবুক কোম্পানি Mevbook এ্যপসকে বাংলাদেশী ফেসবুক বা বাংলাদেশী উইচ্যাটরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের আরেকটি জনপ্রিয় অ্যাপ্স গুগলও বন্ধ রয়েছে চী‌নে। সারাবিশ্বের মানুষ যেখানে তথ্যভান্ডার হিসেবে গুগলে খোঁজে।সেখানে চীনারা ব্যবহার করছে তাদের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন বাইডু।‌ ইনশা-আল্লাহ্ মেভবুক কোম্পানিও ‘বাংলাদেশী গুগল হিসেবে’ MevAsk নামে সার্চ ইঞ্জিন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি আরো বলেন বহির্বিশ্ব বা চীনের ভেতরে ই-কমার্স সাইট হলো আলিবাবা। এটি এত জনপ্রিয় যে অ্যামাজনের মতো কোম্পানিরও এখানে ঠাঁই নেই। আমরাও মেভবুক কোম্পানির Mevmart নামে দেশীয়, জনপ্রিয় ই-কমার্স সাইট প্রতিষ্ঠা করছি। এবং এছাড়া আমরা লাইকি,টিকটকের মত বিদেশি এ্যপসকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেশীয় ভিডিও শেয়ারিং এ্যপস Mevjup নির্মাণ করেছি, এবং পাশাপাশি আমরা হোয়াইটএ্যপ,ইমু,টেলিগ্রামের বিকল্প হিসেবে Mevchat এ্যপসও নির্মাণ করেছি। এবং এছাড়াও আমরা এই কোম্পানির নিজস্ব নিউজ ভিত্তিক ওয়েবসাইট Mevtimes.com নির্মাণ করেছি।

এটা বেশ অদ্ভুত একটা পরিকল্পনা মনে হয়েছে। প্রথমত, চীন একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, তাদের রীতিনীতি সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলাদেশে চীনের অনুসরণে সবকিছুর বাংলাদেশি ভার্সন তৈরির কোন যথার্থতা আছে কিনা, এ বিষয়ে আমি অনিশ্চিত। এছাড়াও অতীত অভিজ্ঞতা বলছে ফেসবুকের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশি সোশ্যাল মিডিয়াগুলো বা গুগলের বিকল্প হিসেবে পিপীলিকা বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি।

এরপর তাদের কাজের মধ্যেও আসলে খুব বেশি ক্রিয়েটিভিটি দেখতে পাইনি। নাম নিয়ে বলতে চাই। বলা হয়েছে Mevbook এর Mev এর অর্থ Make the earth virtual। কিন্তু এই পূর্ণরূপের সাথে book শব্দটি অবশ্যই মানানসই নয়, শুধু ফেসবুকের অনুকরণে যুক্ত করা হয়েছে। এরপর যদি লোগোও দেখি, ফেসবুকের মতই নীল রংয়ের বৃত্তের ভেতর। তবে M লেখাটিতে কিছুটা কারুকাজ আছে, যা ফেসবুকের f-এ নেই। এই বিষয়টি আসলে পুরো মেভবুকের ইন্টারফেস ও ফিচারকে উপস্থাপন করে, হুবহু ফেসবুকের ফাংশন, সাথে কিছু বাড়তি। লোগোটিও আমার ভালো লাগেনি।

এরপর গতকাল রাত নয়টায় ওয়েবসাইট ও প্লেস্টোরে অ্যাপ পাবলিশ হওয়ার কথা থাকলেও সেটিও সম্ভব হয়নি, বলা হয়েছে কিছুদিন পরে অ্যাপ পাওয়া যাবে। এবং অ্যাপের ডাউনলোড লিঙ্কও প্রকাশ করা হয় রাত ১২টার পর। ওয়েবসাইটও গতকাল সকাল পর্যন্ত একটু চালু হচ্ছিলো, আবার মেইনটেইনেন্স মোডে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। সব মিলিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতেও বেশ ভোগান্তি গিয়েছে এবং এরপর ভ্যারিফিকেশন ইমেইল না আসায় (আমিসহ অন্যদেরও) অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা যাচ্ছিলো না।

মেভবুকের কাজের মধ্যে প্রোফেশনালিটির একটা অভাব আমার বোধ হয়েছে। মানুষের যতটা আগ্রহ ছিলো এবং ৮ মাস ডেভেলোপমেন্টের দীর্ঘ অপেক্ষার পর সাইটটি যেহেতু উন্মুক্ত করা হয়, তাই এরকম সমস্যাগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত। গ্রুপে দেখলাম, ইতোমধ্যেই এখানে ৪০০০ এর বেশি অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়েছে, আর খুব সম্ভবত তাদের সার্ভার এ পরিমাণ চাপ নেয়ার মত শক্তিশালী নয়। এখন পর্যন্ত সাইটটি বেশ স্লো কাজ করছে। প্রায়সময়ই লগইন হতে অনেক সময় নিচ্ছে।

এবং আরেকটি ব্যাপার হলো, ৮ মাস ডেভেলোপ হওয়া কোনকিছু যেরকম আশা করা যায়, ম্যাভবুক সেরকম কিছু নয়। এটি পুরোপুরি কাস্টম কোডেড নয়, এখানে খুব সম্ভবত ব্যবহৃত হয়েছে Sngine নামের একটি সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রিপ্ট।  এমনকি এখনও প্রচুর পরিমাণ ডেমো কনটেন্ট আছে, এমনকি তাদের Favicon-ও স্পষ্টতই প্রাসঙ্গিক কিছু নয়।

তাদের About পেজটির পরিস্থিতি নিম্নরূপ:

ইন্টারফেসের কথা যদি বলি, এখানেও আসলে ফেসবুকেরই অনুকরণ করা হয়েছে। ফিচারও ফেসবুকের মতই, পাশাপাশি কিছু বাড়তি ফিচার আছে, যেমন ট্রেন্ডিং, আর্টিকেল প্রকাশ সুবিধা, অ্যানোনিমাস পোস্ট প্রভৃতি। তবে মোটাদাগে ফেসবুকের ক্লোনেরই একটা চেষ্টা।

আরেকটা মজার ব্যাপার, স্ক্রিনশটটা বেলা সাড়ে বারোটার দিকে নেয়া, কিন্তু Good Afternoon জানানো হচ্ছে, যদিও আমার পিসির টাইম ঠিকই আছে। অর্থাৎ, সাইটের অভ্যন্তরীণ টাইম জোন অনুযায়ী এটা দেখাচ্ছে, যা অন্য কোন দেশ সেট করা, যদিও সাইটটি বাংলাদেশ কেন্দ্রিক। ভাষার বেলায় গ্রীক ভাষা আছে, কিন্তু বাংলা ভাষা নেই…

এছাড়া বিভিন্ন এরর মেসেজ সার্বক্ষণিক নিত্যসঙ্গী।

সিকিউরিটির কথা বললে, পুরো আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, টিম ততটা প্রফেশনাল নয় এবং সিক্যুরিটি বিষয়ে অভিজ্ঞতা রাখেন এমন একজন আমাকে জানিয়েছেন মেভবুকে সিকিউরিটি রিলেটেড ফল্ট আছে। তো, মেভবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি বিষয় অবশ্যই অনুসরণ করবেন, অন্য আরো সাইটে আছে, এমন পাসওয়ার্ড এখানে ব্যবহার করবেন না।

অনেকে বলতে পারেন, মেভবুক সবে যাত্রা শুরু করেছে, আস্তে আস্তে সব ঠিক হবে। হ্যা, কিছু ব্যাপার হয়ত হবে, তারা হয়ত আরো শক্তিশালী নিজস্ব সার্ভারে আপগ্রেড করবে, ডেমো কনটেন্টগুলো ঠিকঠাক করবে, ইমেইল ভ্যারিফিকেশনসহ বিভিন্ন এররগুলো সমাধান করবে। প্রথমদিকে এরকম সমস্যা থাকতে পারে, মানা যায়।

তবে আমি আশাহত মেভবুকের কার্যকারিতা নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়াগুলো কিন্তু পুরো পৃথিবীকে সংযোগের বা বিশ্বায়নের একটা ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের জন্য একটা, চীনের জন্য একটা, ভারত-আমেরিকার মত দেশগুলোর প্রতিটা রাজ্যের জন্য একটা করে ফেসবুকের ক্লোন তৈরি হলে এই বিষয়টির প্রতিফলন ঘটে না।

বাংলাদেশের জন্য বিশেষায়িত কিছু করতে চাইলে সেটি অন্য বিষয়, যেমন- বেশতো বা কথা একটা ইউনিক কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করেছে বা করছে। কিন্তু যখন শুধুই ফেসবুকের একটি ক্লোন করার চেষ্টা হয়, এটা আমার মনে হয় না খুব ভালো আইডিয়া। অন্যদিকে ইউনিক কিছু হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করা খুবই কঠিন, যেমন গুগলের মত কোম্পানির গুগল প্লাস-ও বন্ধ করে দিতে হয়েছে, বেশতো এখন একদমই ইনএক্টিভ।

তবে কঠিন হলেও অসম্ভব অবশ্যই না, বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইন্টারনেটের জগতে নিজের শক্ত জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। মাইক্রো-ব্লগিং ও জনমত গড়ে তোলার জন্য টুইটার, মিডিয়া শেয়ারিংয়ের জন্য ইনস্ট্রাগ্রাম, প্রফেশনাল ক্ষেত্রে লিংকড ইন, এডভান্সড মেসেজিং ফিচারসহ টেলিগ্রাম, বিজ্ঞাপনমুক্ত সিকিউর অভিজ্ঞতার জন্য সিগনাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি। বাংলাদেশি ‘কথা’ অ্যাপও একটা অডিয়েন্স তৈরি করতে পেরেছে। এছাড়া ইউটিউবও কিন্তু একধরণের সোশ্যাল মিডিয়া।

মেভবুক সংশ্লিষ্টরা এটিকে একটি গঠনমূলক সমালোচনা হিসেবে নেয়ার অনুরোধ করছি। নিছক দোষ ধরা আমার উদ্দেশ্য নয়, বরং আপনারা ভালো কিছু করুন, এটা আমি চাই। তবে বর্তমানে যেভাবে কাজ হচ্ছে, তা নিয়ে আমি সত্যি বলতে আশাবাদী হতে পারছি না, খুব বড় ধরণের পরিবর্তন দরকার। আরো ক্রিয়েটিভিটি, দক্ষতা ও প্রফেশনালিটির সাথে মেভবুক কতৃপক্ষ সামনে আরো ভালো কিছু করে দেখাবেন বলে আশাবাদ রইলো।

One comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *