উইন্ডোজ ১০ এর সাপোর্ট শেষ হয়েছে, জরিন ওএস ১৮ কি সেরা বিকল্প হতে পারে?

আসসালামু আলাইকুম। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে আমার প্রথম লিনাক্স চালানো। তো এই সময়কালে উইন্ডোজ আর লিনাক্স দু’জায়গাতেই অনেক পরিবর্তন এসেছে। উইন্ডোজ ৭ ও ৮ এর সমাপ্তি হয়েছে, উইন্ডোজ ১০ ও ১১ এসেছে এবং সর্বশেষ এই অক্টোবরের ১৪ তারিখে উইন্ডোজ ১০-এর সাপোর্টের সময়কালও শেষ হয়েছে।

লিনাক্স এই সময়টাতে ডেস্কটপ জগতে আগের থেকে আরো পরিচিত হয়েছে। বিভিন্নভাবে ডেস্কটপ ব্যবহারকারীদের জন্য আরো আধুনিক ও ইউজার ফ্রেন্ডলি হয়ে উঠেছে। তবে এখনো লিনাক্স সর্বসাধারণের অপারেটিং সিস্টেম হয়ে উঠতে পারেনি- একটু এডভান্সড ইউজার বা ডেভেলোপার বা হ্যাকারদের অপারেটিং সিস্টেম হিসেবেই থেকে গেছে।

তবে উইন্ডোজ ১০ এর মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পর লিনাক্স নিয়ে আলোচনার নতুন একটা জায়গা তৈরি হয়েছে, কেননা উইন্ডোজ ১০ ব্যবহারকারীদের বড় অংশের হার্ডওয়্যার উইন্ডোজ ১১ চালানোর রিকুয়ারমেন্টগুলো পূরণ করে না। এখন উইন্ডোজ ১০ চালিয়ে যাওয়া অবশ্যই একটা অপশন, কারণ সত্যি বলতে আপডেট বা সিক্যুরিটি প্যাচ আসবে না- এটা নিয়ে চিন্তা ক’জনই বা করেন! 😅

তবে নিরাপদ থাকতে চাইলে আপনার জন্য অপশন হলো উইন্ডোজ ১১ সাপোর্ট করবে এমন হার্ডওয়্যারে আপগ্রেড করা। তবে বরাবরের মতই আমার মত লিনাক্সপ্রেমীরা বলতে চাইবেন এখনই উপযুক্ত সময় আপনার লিনাক্সে চলে আসার!

তবে হ্যা, প্রশ্ন তো আসবেই আসলেই লিনাক্স একজন সাধারণ ব্যবহারকারীর সব প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে কিনা, কিংবা কম্পিউটার নিয়ে যার খুব বেশি জ্ঞান নেই- তার পক্ষে আসলেই লিনাক্স ব্যবহার করা সম্ভব কিনা। প্রশ্নগুলো খুবই ভ্যালিড প্রশ্ন এবং এটার আলোচনা সৎভাবে করা প্রয়োজন।

এই পোস্টে আমরা স্পেসিফিকভাবে একটা লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের দিকেই আমাদের দৃষ্টি রাখবো, জরিন ওএস। কারণ তারা অনেক দিক থেকে কাজ করেছে উইন্ডোজ থেকে লিনাক্সে আসার পথটাকে সহজ করার জন্য।

জরিন ওএস কী?

জরিন ওএস একটি লিনাক্সভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম। এটা উবুন্টুর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে এবং এটা গ্নোম ডেস্কটপের একটি কাস্টমাইজড সংস্করণ ব্যবহার করে। অন্য লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমগুলো থেকে জরিন ওএসের বিশেষত্ব হলো উইন্ডোজ বা ম্যাক ওএস থেকে যারা লিনাক্সে আসতে চায়, তাদের দিকটি মাথায় রেখে এটা তৈরি করা।

জরিন ওএসের ডিফল্ট লেআউট উইন্ডোজের পরিচিত লেআউটের মতই। নিচের দিকে টাস্কবার কিংবা স্টার্ট মেনু (এক্ষেত্রে জরিন মেনু) সবকিছু একদমই পরিচিত একটা পরিবেশ দিবে। কাজেই এটা ব্যবহার শুরু করতে নতুন করে কিছু শেখার প্রয়োজন হবে না। এতদিন যেভাবে কম্পিউটার চালিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই চালাতে পারবেন।

তবে তার সাথে জরিন ওএস তার নিজস্বতার ছাপ রেখেছে পুরোপুরি। জরিন ওএসের এলিগেন্ট থিম, আইকন প্যাক, ফ্লোটিং ও রাউন্ডেড ডিজাইন, জরিন মেনু- কোনটাতে তারা উইন্ডোজের কপি হয়ে ওঠার চেষ্টা করেনি। সিস্টেম ইউটিলিটিগুলো তারা লিনাক্সের মতই রেখেছে- কোনটাকে উইন্ডোজের মত করে তোলার চেষ্টা করেনি। শুধু ততটুকু উইন্ডোজকে অনুসরণ করেছে যতটুকু একজন নতুন ব্যবহারকারীকে সহজ শুরুর পথ তৈরি করে দিতে পারে।

আমার কাছে এটাই জরিন ওএসের সবচেয়ে বড় অসাধারণত্ব। নিজস্বতা আর পরিচিতি- এই জায়গাটা তারা যত অসাধারণভাবে ব্যালেন্স করতে পেরেছে, আমি এর দ্বিতীয় কোন উদাহরণ জানি না।

ও আচ্ছা, জরিন ওএস নিয়ে কিন্তু আমরা কিছুদিন আগে একটা রিভিউ লিখেছি- লিনাক্স ডিস্ট্রো রিভিউ (পর্ব-৩): জরিন ওএস। ওটাতে ফিচার ও টেকনিকাল দিকগুলো আরেকটু বেশি ফোকাস করা হয়েছে। এই লেখাতে আমরা উইন্ডোজ ১০ ব্যবহার করা একজন সাধারণ ব্যবহারকারীর দিকটি যেহেতু ফোকাস করেছি, তাই সে দিকগুলো ততটা আসবে না।

জরিন ওএস ১৮

জরিন ওএসের নতুন সংস্করণ হলো জরিন ওএস ১৮। জরিন ওএস বর্তমানে দু’বছর পরপর নতুন সংস্করণ আনে। জরিন ওএস ১৮ এর রিলিজে অবশ্য তারা সরাসরিই উইন্ডোজ ১০-এর সমাপ্তিকে ফোকাস করেছে। মজার ব্যাপার হলো জরিন ওএস ১৮ তারা রিলিজ করেছে ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ঠিক উইন্ডোজ ১০ এর সাপোর্টের সমাপ্তির দিন! কাকতালীয় ব্যাপারস্যাপার… 😉

জরিন ওএসের এই মার্কেটিংগুলো অবশ্য বেশ কাজেও দিয়েছে। রিলিজের সপ্তাহখানেকের মাথায় ৩ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে জরিন ওএস ১৮-এর ডাউনলোড সংখ্যা! খুব কম না কিন্তু!

জরিন ওএসের আগের ভার্সনগুলোর ধারা বজায় রেখেই এসেছে জরিন ওএস ১৮, সাথে বিভিন্ন ইম্প্রুভমেন্টস ও অপটিমাইজেশনের মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে আরো বেটার হয়ে উঠেছে। এই সংস্করণের বড় একটা হাইলাইট হলো ওয়েব অ্যাপ ইন্ট্রিগ্রেশন। এডভান্সড উইন্ডো টাইলিং ফিচারও যুক্ত হয়েছে- কিছুটা উইন্ডোজ ১১ এর মত। থিমিংয়ে কিছু ইনহেন্সমেন্ট এসেছে, বাই ডিফল্ট প্যানেলকে ফ্লোটিং করা হয়েছে। সেইসাথে সিস্টেম ইউটিলিটিগুলোর নতুন ভার্সনের সাথে সর্বত্র বিভিন্ন কোয়ালিটি অফ লাইফ ইম্প্রুভমেন্ট এসেছে।

উইন্ডোজ ৭ এর পর থেকে পরবর্তী ওএসগুলোতে মাইক্রোসফট বেশ চমৎকার কিছু কাজ যেমন করেছে, তেমনই অনেক দিক থেকে এক্সপ্রেরিয়েন্সকে ব্লটেডও করে তুলেছে। যেমন মাইক্রোসফট এজ ব্যবহারের জন্য ঘ্যানঘ্যান করা, স্টার্টমেনুতে স্পন্সরড শর্টকাট দেখানো, নিউজ উইজেট যেখানে প্রাসঙ্গিক কিছু নেই, কিছু এআই ফিচার- যেগুলো অনেক ক্ষেত্রে অযাচিত এবং প্রাইভেসির দিক থেকেও প্রশ্নবিদ্ধ। এই সবকিছু সিস্টেমকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভারি করে তোলে এবং এক্সপ্রেরিয়েন্সকে কিছুটা ব্যহত করে।

এই জায়গাতে জরিন ওএস আপনাকে একটা রিফ্রেশিং অনুভূতি দিবে। যদিও লিনাক্সের লিমিটেশন আছে, আমরা সে কথাতেও আসবো- তবে সামগ্রিকভাবে গত ১০ বছরে লিনাক্স অনেক মিনিংফুল ডেভেলোপমেন্ট করেছে। শুধু ইউজার ইন্টারফেস ও ইউজার এক্সপ্রেরিয়েন্সের দিক থেকে বললে আমার চোখে অন্তত উইন্ডোজ ১০ থেকে জরিন ওএস ১৮ স্পষ্টভাবেই এগিয়ে থাকবে। কারণ এটা আরো রেসপোন্সিভ ও ক্লিন এক্সপ্রেরিয়েন্স।

সর্বনিম্ন ২ জিবি র‌্যাম ও ৬৪ বিট সমর্থনসহ 1 GHz ডুয়াল কোর প্রসেসর এই ওএসটির রিকুয়ারমেন্ট। লিনাক্সের স্ট্যান্ডার্ডে এটা একদম কমের দিকে না, তবে সিমিলার কনফিগারেশনে উইন্ডোজ ১০ থেকে জরিন ওএস অপটিমাইজড ও বেটার পারফর্মেন্স এনে দিতে সক্ষম। অবশ্য আপনি ভারি কোন অ্যাপ চালাতে চান, বা ওয়েব ব্রাউজারের অনেক ট্যাব ওপেন রাখতে চান- তখন এটা যে জাদুর মত আপনার কম্পিউটারকে সুপার কম্পিউটার বানিয়ে দিবে এরকমও না।

ইন্টারফেস ও ইউজার এক্সপ্রেরিয়েন্স

সিমপ্লিসিটির সাথে গ্র্যাডিয়েন্টের সুচিন্তিত ব্যবহার ও সর্বত্র একসেন্ট কালারের হালকা ছোঁয়া- জরিন ওএসের ডিজাইনে একটা চমৎকার এলিগেন্স আছে। এটা প্রায় যে কারো চোখেই সুন্দর লাগার মত।

জরিন ওএস এর ইন্টারফেসকে কাস্টমাইজ করা অনেক সহজ করে দিয়েছে। যেমন- ডিফল্ট প্যানেল লেআউট কিছুটা উইন্ডোজ ১০-এর মত, তবে Zorin Appearence থেকে আরো কিছু লেআউট পাওয়া যাবে। কোর সংস্করণে মোট চারটি লেআউট রয়েছে, প্রো সংস্করণে সাথে আরো ৮টি বাড়তি লেআউট থাকবে।

তবে এই কয়টি লেআউটের মধ্যে কাস্টমাইজেশন সীমিত না- টাস্কবার সেটিংস থেকে মার্জিন, বর্ডার, উচ্চতা, পজিশনসহ প্যানেলের সবরকম কাস্টমাইজেশন করা যাবে। সেইসাথে অ্যাকসেন্ট কালার, ডার্ক স্টাইল, জেলি মোডের মত ফান ইফেক্টসসহ অনেকরকম কাস্টমাইজেশন ফিচার Zorin Appearence এ আছে।

জরিন ওএস কিছু জায়গাতে উইন্ডোজের পরিবর্তে গ্নোম ডেস্কটপ বা লিনাক্সের বিহেভিয়রকে প্রাধান্য দেয়। যেমন উইন্ডোজ কী, লিনাক্সে যেটা সুপার কী নামে পরিচিত, প্রেস করলে ডিফল্ট স্টার্ট মেনুর পরিবর্তে ওভারভিউ চালু হয়, যেটা উইন্ডোজের টাস্ক ভিউয়ের মত।

এখান থেকে বিভিন্ন অ্যাপস, ফাইলস, সেটিংস প্রভৃতি সার্চ করা যায়। স্টার্ট মেনুতে যে সার্চ বক্স রয়েছে, সেটিও একইভাবে কাজ করে।

জরিন ওএস ১৮-তে নতুন যোগ হয়েছে এডভান্সড অটো টাইলিং। এটা অনেকটা উইন্ডোজ ১১ এর টাইলিং ফিচার থেকে অনুপ্রাণিত। তবে ইমপ্লিমেন্টেশন আরো সিমলেস। কোন উইন্ডো ড্রাগ করার সময় টাইলিং অপশনগুলো দেখা যাবে এবং ওখান থেকেই যেকোন একটাতে রিলিজ করে টাইলিং করা যাবে। সাথে এতে নিজের মত লেআউট তৈরিসহ অনেক রকম অপশনও আছে।

Zorin OS ইন্সটলের পর Tour অ্যাপের মধ্য দিয়ে দরকারি কয়েকটি বিষয় তারা তুলে ধরে, যেটা নতুনদের জন্য হেল্পফুল। যেমন অ্যাপ ওপেন করা, কাস্টমাইজেশন, অনলাইন অ্যাকাউন্টস, জরিন কানেক্ট, সফটওয়্যার ইন্সটলেশন প্রভৃতি।

জরিন কানেক্ট খুব চমৎকার একটা অ্যাপ, যেটা আপনার অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকলে কম্পিউটারের সাথে কানেক্ট করার জন্য। এর মাধ্যমে ফাইল শেয়ারিং, এসএমএস ম্যানেজমেন্ট, এমনকি মোবাইলকে মাউস বা কীবোর্ড বা প্রেজেন্টেশন রিমোট হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

সামগ্রিক ইন্টারফেসে জরিন অনেক পলিশড হলেও কিছু ইনকন্সিস্টেন্সি আছে। যেমন- কোন অ্যাপ ম্যাক্সিিমাইজ করলে প্যানেলের ওপরের দিকে মার্জিন অন্য তিন দিকের থেকে কম থাকে, এক্সাক্টলি বললে 4 পিক্সেল কম। যেহেতু ডিফল্ট মার্জিন 4 পিক্সেল, তাই তখন তিনদিকে মার্জিন থাকলেও ওপরের দিকে থাকে না। ফলে ফ্লোটিংয়ের সৌন্দর্য্য থাকে না।

তবে আবার যদি কোন উইন্ডোকে ড্র্যাগ করে স্ক্রিনের ওপরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আবার এটা এডভান্সড উইন্ডো টাইলিং সেটিংসের প্যাডিং অনুসরণ করে, যেকারণে বাই ডিফল্ট তখন উইন্ডোর সবদিকেই 4 পিক্সেল গ্যাপ থাকে। যেকারণে তখন আবার সুন্দর দেখায়।

জরিন ওএস ডিফল্ট ওয়েব ব্রাউজার হিসেবে ১৭.৩ থেকে ফায়ারফক্সের পরিবর্তে ব্রেভ ব্রাউজারে সুইচ করছে। এখন এমনিতে আমি ফায়ারফক্স ডিফল্ট রাখাটাই প্রিফার করতাম। তবে জরিন ওএস তাদের সিদ্ধান্ত ফায়ারফক্সের Terms of Use-এ কিছু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে তৈরি প্রাইভেসি আশঙ্কা থেকে নিয়েছে, ফায়ারফক্স বাদ দেয়া ও বিকল্প ব্রেভ সিলেক্ট করার বিস্তারিত কারণ তারা এখানে ব্যাখ্যা করেছে।

পার্সোনালি আমার কাছে ব্রেভ ব্রাউজার কিছুটা ব্লটেড মনে হয়। যেমন Rewards, Wallet, News প্রভৃতি বিষয় আছে, যা অনেকের জন্যই বাড়তি। যাইহোক, জরিন ওএস ডিফল্ট সেটিংসকে কাস্টমাইজড করে এই ফিচারগুলো তত দৃশ্যমান রাখেনি, যেকারণে জরিন ওএসের ব্রেভ অনেকটা ক্লিন-ই থাকছে। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি সহজেই ব্রেভ আনইন্সটল করতে এবং যেকোন পছন্দমত ব্রাউজারকে ইন্সটল করে ডিফল্ট সেট করে নিতে পারবেন।

ব্রেভের একটা সমস্যা হলো ইনফর্মেশন এনক্রিপ্ট রাখতে এটা লগইন কীরিং বা ডিফল্ট কীরিং ব্যবহার করে। কম্পিউটারে ইউজার পাসওয়ার্ড দেয়া ছাড়া অটো-লগইন চালু থাকলে রিস্টার্ট করার পর প্রতিবার ব্রেভ এনক্রিপশন পাসওয়ার্ড চায়। এটার একটা ওয়ার্কঅ্যারাউন্ড হলো Keyring পাসওয়ার্ড ব্লাঙ্ক সেট করা, তখন আনএনক্রিপ্টেডভাবে পাসওয়ার্ডগুলো সেভ হবে। যাইহোক, নতুন ইউজারদের জন্য কিছুটা কনফিউজিং ব্যাপারটা।

সামগ্রিকভাবে যদি বলি, ইউআই এর দিক থেকে জরিন ওএস উইন্ডোজ থেকে আমি সাধারণভাবে এগিয়ে রাখবো। যেহেতু এটার ইন্টারফেস ইনটুইটিভ এবং কিছু টুকটাক ডিটেইল বাদ দিলে সামগ্রিকভাবে ক্লিন ও ইনটুইটিভ এক্সপ্রেরিয়েন্স। আমার ধারণা একজন উইন্ডোজ ব্যবহারকারী খুব দ্রুতই এখানে কমফোর্টেবল ফিল করবেন।

তবে বড় সমস্যার জায়গাটা আসলে সফটওয়্যার। জরিন ওএস অবশ্য এখানেও অনেক দিক থেকে কাজ করেছে যতটা সম্ভব এই কনসার্ন কমিয়ে আনার জন্য। তবে দিনশেষে উইন্ডোজ ও লিনাক্স দুটো আলাদা অপারেটিং সিস্টেম, সফটওয়্যার প্যাকেজিং সিস্টেম আলাদা- যেকারণে হয়ত আপনার সব দরকারী অ্যাপ্লিকেশনগুলো লিনাক্সে না-ও থাকতে পারে।

সফটওয়্যার সাপোর্ট

সামগ্রিক চিত্র

সারমর্ম যদি করি, সাধারণ ব্যবহারকারী হিসেবে ওয়েব ব্রাউজার, পিডিএফ রিডার বা এডিটর, বাংলা কীবোর্ড সফটওয়্যার, অফিস সফটওয়্যার, গ্রাফিক্স ডিজাইন সফটওয়্যার, অডিও ও ভিডিও প্লেয়ার- যা কিছু দরকার হয়ে থাকে, সবকিছু লিনাক্সে আছে। তবে উইন্ডোজে যে সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে আসছিলেন, ঠিক সেটাই হয়ত না-ও থাকতে পারে। কাজেই পেশাগত এবং একাডেমিক দরকারে যদি ‘সুনির্দিষ্ট সফটওয়্যার’-ই দরকার হয়, সেক্ষেত্রে দেখে নেয়া ভালো লিনাক্সে সেটির সমর্থন আছে কিনা।

আমি শুধু গুরুত্বপূর্ণ কিছু নোট দিয়ে দিচ্ছি। জনপ্রিয় সব ওয়েব ব্রাউজার লিনাক্সে আছে (ক্রোম, ফায়ারফক্স, এজ)। কোডিং ও ডেভেলোপমেন্ট সংক্রান্ত বেশিরভাগ জনপ্রিয় টুল লিনাক্সে আছে (VS Code, Code::Blocks, Pycharm)। VLC ও OBS Studio লিনাক্সে সমর্থন আছে।

প্রায় সবরকম ওয়েব অ্যাপ- যেমন Google Docs, Canva, Office 365 Online লিনাক্সে উইন্ডোজের মতই কাজ করে। পিডিএফ পড়া, Rar ও Zip তৈরি ও এক্সট্রাকশন, বাংলা লেখা প্রভৃতি কাজের জন্য দরকারী সফটওয়্যার লিনাক্সে পেয়ে যাবেন, হয়ত উইন্ডোজের হুবহু না হতে পারে, তবে ফাংশনাল লিমিটেশন নেই।

Microsoft Office লিনাক্সে সমর্থন নেই। LibreOffice বা OnlyOffice বেশ চমৎকার বিকল্প, যারা প্রায় সব প্রয়োজনই পূরণ করতে পারে। এবং মাইক্রোসফট অফিসের অনলাইন ভার্সনও বেশ ফুল-ফিচার্ড। Adobe Photoshop বা Illustrator সমর্থন নেই। GIMP, Krita, Inkscape প্রভৃতি খুব ভালো সফটওয়্যার, তবে সবসময় বিকল্প হিসেবে যথেষ্ট নয়।

What’s App এর শুধু ওয়েব ভার্সন লিনাক্সে চলে, যেখানে অডিও বা ভিডিও কল সাপোর্ট নেই। Telegram, Discord প্রভৃতির অডিও-ভিডিও কল ও সব ফিচারসহ লিনাক্স সমর্থন আছে। Google Drive, OneDrive প্রভৃতির অফিসিয়াল অ্যাপ নেই, তবে জরিন ওএস সহ অনেক ওএসে অনলাইন অ্যাকাউন্টে কানেক্ট করলে ফাইল ম্যানেজার থেকে এক্সেস করতে পারবেন- তবে ইন্টারনেট না থাকলে অফলাইনে এক্সেস করা যাবে না। Mega সহ কিছু সার্ভিস এক্ষেত্রে লিনাক্সে অফিসিয়ালি পূর্ণ সমর্থিত।

গেমস একটা ইন্টারেস্টিং কেইস। Steam এর Proton কম্প্যাটিবিলিটি লেয়ার বা Proton Play-র কারণে Steam-এ থাকা প্রায় সব সিঙ্গেল প্লেয়ার গেমস লিনাক্সে চমৎকার পারফর্ম করে। Heroic গেম লঞ্চার দিয়ে Epic Games, GoG এর গেমগুলোও একইভাবে লিনাক্সে চালানো সম্ভব। তবে মাল্টিপ্লেয়ার গেমস অনেক ক্ষেত্রে এন্টিচিটের কারণে লিনাক্স সাপোর্ট না-ও করতে পারে।

তো এই গেলো লিনাক্সে কী কী সফটওয়্যার বা সার্ভিস আছে বা নেই তার একটা সামগ্রিক চিত্র। আর এর বাইরে অবশ্যই আরো অসংখ্য সফটওয়্যার ও টুলস আছে, আমি শুধু জনপ্রিয় বা যেগুলো বিশেষভাবে দরকার মনে হলো সেগুলো উল্লেখ করেছি।

জরিন ওএস

জরিন ওএস বেশকিছু কাজ করেছে লিনাক্সে সফটওয়্যার প্রাপ্তিকে যথাসম্ভব সহজ করতে। জরিন ওএসে ‘Software’ অ্যাপ থেকে বিভিন্ন লিনাক্স সফটওয়্যারগুলো ইন্সটল করতে পারবেন। জরিন ওএসের রিপোজিটরীর পাশাপাশি FlathubSnap Store এ থাকা সব অ্যাপ এখান থেকে ইন্সটল করা যাবে। তো এটা একটা হিউজ কালেকশন।

একই সফটওয়্যার একাধিক প্যাকেজিংয়ে থাকলে ইন্সটলের সময় কোন সোর্স থেকে বা কোন ভার্সন ইন্সটল হবে তা সিলেক্ট করে দেয়া যায়। apt, Flatpak, Snap- এখানে তফাৎটা মূলত প্যাকেজিং স্ট্রাকচারে, ইউজারের দিক থেকে মেজর কোন তফাৎ নেই।

উইন্ডোজের অ্যাপ, অর্থাৎ .exe বা .msi ফাইল রান করতে চাইলে অন স্ক্রিন ইন্সট্রাকশন ফলো করে সহজেই Windows App Support ইন্সটল করা যায়। এটা মূলত WINE ও Bottles দুটো কম্প্যাটিবিলিটি টুল ইন্সটল ও সেটআপ করে, যেটা অন্যান্য লিনাক্সেও করা যায়, তবে জরিন ওএস খুবই সহজ করে দিয়েছে ব্যাপারটা। তবে এর মাধ্যমে সব সফটওয়্যার চালানো যায় না, বা অনেক ক্ষেত্রে এক্সট্রা স্টেপস থাকে। উদাহরণস্বরূপ, Microsoft Office 2016 পর্যন্ত চালানো সম্ভব এভাবে, তবে লেটেস্ট Office 365 এভাবে চালানো যায় না।

আরেকটা চমৎকার দিক হলো জরিন ওএস উইন্ডোজ অ্যাপ সাপোর্ট ইন্সটলের অপশনের পাশাপাশি বিভিন্ন উইন্ডোজ সফটওয়্যারের লিনাক্স ভার্সন থাকলে সেটি সাজেস্ট করে, অথবা বিকল্প সাজেস্ট করে। এটার জন্য তারা জনপ্রিয় বিভিন্ন সফটওয়্যারকে তাদের ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

এখনকার সময়ে আরেকটা দিক হলো ওয়েব অ্যাপসের প্রচলন- এখনকার সময়ে অনেকেই Google Docs কিংবা Canva ব্যবহার করে অভ্যস্থ। আবার Microsoft Office সহ বিভিন্ন সফটওয়্যারের এখন ওয়েব ভার্সন রয়েছে। Adobe Photoshop ও AutoCAD-ও এই তালিকায় আছে, যদিও তাদের ওয়েব ভার্সনগুলো লিমিটেড।

জনিন ওএস এই ভার্সন থেকে Web Apps একটি টুল যুক্ত করে দিয়েছে, যা কোন ওয়েব সাইটকে অ্যাপের মত ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। এটা মেনুতে ইন্টিগ্রেশন ও আইকন সহ ওয়েব ব্রাউজারের মধ্যে ব্যবহারের ফিল অনেকটা কমিয়ে দেয়।

উইন্ডোজে একটা Software Center থাকলেও, এবং সেখানে বিভিন্ন সফটওয়্যার থাকলেও সাধারণত অনলাইনে সার্চ করে সফটওয়্যার ইন্সটল করাটাই উইন্ডোজে বেশি পপুলার। লিনাক্সের ক্ষেত্রে গ্রাফিকাল (বা কমান্ড লাইন) কোন সফটওয়্যার ম্যানেজার ব্যবহার করার প্রবণতা-ই বেশি। জরিন ওএসে যে Software অ্যাপ আছে, এটা তার একটা উদাহরণ। এবং এখান থেকে সফটওয়্যার ইন্সটল করা শুধু Install বাটনে ক্লিকের অপেক্ষা।

তবে জরিন ওএসের মূল আকর্ষণ হলো উইন্ডোজ সফটওয়্যার সাপোর্ট ইন্সটলকে সহজ করা, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে লিনাক্স ভার্সন বা বিকল্প রেকমেন্ডেশন ও এরকম যে কাজগুলো তারা উইন্ডোজ ব্যবহারকারীদের দিকে লক্ষ্য করে করেছে। ওয়েব অ্যাপস ইন্টিগ্রেশন জরিন ওএস ১৮ থেকে এদিকে আরেকটি নতুন পদক্ষেপ।

পরিশেষে

তো, এই তো। আজকের লেখাতে টেকনিকাল দিকগুলো যতটা পরিহার করার চেষ্টা করেছি, এবং চেষ্টা করেছি তুলে ধরার জরিন ওএস সত্যিই উইন্ডোজ ১০ এর বিকল্প হতে পারে কিনা। তো হয় কী, অনেক সময় হয়ত সবকিছুই ঠিক আছে, কিন্তু একটা সফটওয়্যারের জন্য আপনি উইন্ডোজ ছাড়তে পারছেন না। আবার উইন্ডোজে কোন সমস্যায় পড়লে হয়ত পাশের কম্পিউটারের দোকানটাতে নিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু লিনাক্স হয়ত ইন্সটল আপনাকে নিজেই করতে হবে, বা সমস্যায় পড়লে অনলাইন খুঁজে বা অনলাইন কমিউনিটির সাহায্য নিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে। এরকম অনেক দিক আছে, যেগুলো হয়ত লিনাক্সে আসার অন্তরায় হতে পারে।

তবে যদি সম্ভব হয়, জরিন ওএস একবার ব্যবহার করে দেখতে পারেন। ইন্সটলের আগেও কিন্তু জরিন ওএস বুটেবল ডিস্ক থেকে সরাসরি চালানো যায়, হার্ডডিস্কে থাকা ডাটার কোন পরিবর্তন না করে- যেটা একটা চমৎকার সুবিধা। হয়ত উইন্ডোজ ১০ এর সমাপ্তিতে জরিন ওএস হতে পারে সে অপারেটিং সিস্টেম যা আপনার পুরনো হার্ডওয়্যারকে আবারো করে তুলবে প্রাণবন্ত!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *