সোশ্যাল মিডিয়াতে কেউ বাজেটের মধ্যে স্মার্টফোনের সাজেশন চাইলে প্রায়সময়ই বাজেট আরেকটু বাড়ানোর জন্য সাজেস্ট করা হয়। তবে সম্ভবত এখন একটা সময় চলে এসেছে, যখন বাজেট বাড়ানোর প্রয়োজন খুব একটা আর নেই, কেননা প্রায় সব বাজেটেই এখন দারুণ সব ডিভাইস বাজারে আছে।
একদিন এবং ১০০০ টাকা দামের ব্যবধানে বাংলাদেশে রিলিজ হয়ে গেলো realme narzo 20 ও POCO M3 নতুন দুটি স্মার্টফোন, এবং দুটি স্মার্টফোনই দামে চমক দেখিয়েছে। narzo 20-র যে ফিচারটি সবচেয়ে বেশি ফোকাস করা হচ্ছে, তা হলো এর Helio G85 চিপসেট, বিপরীতে POCO M3 বিশেষভাবে প্রচার করছে তাদের FHD+ ডিসপ্লের কথা।
দুটো স্মার্টফোন বেশ কাছাকাছি বাজেটে, আর স্পেকের মধ্যেও অনেকটাই মিল, কাজেই এখানে সত্যি বলতে স্পেক কম্পারিজন খুব বেশি কার্যকর না, ইউজার এক্সপেরিয়েন্স, সফটওয়্যারসহ টুকটাক ব্যাপারগুলো পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। যাইহোক, যেহেতু হ্যান্ডস অন কম্পারিজন আমরা করতে পারছি না (কিন্তু আমার ব্লগে পোস্ট করা প্রয়োজন), তাই এই পোস্ট…
Table of Contents
প্রাইসিং
এন্ট্রি লেভেলে কয়েকটি ডিভাইস, যেমন Redmi 9A, 9C, POCO C3 এরকম কিছু ডিভাইস ছাড়া প্রায় সব শাওমি ডিভাইসেই আমরা এগ্রেসিভ প্রাইসিং দেখে আসছি। তবে POCO M3-র প্রাইসিং যেমনটা এক্সপেক্টেড ছিলো, তার থেকেও বেশি এগ্রেসিভ বলেই আমার মনে হয়েছে। বিশেষ করে শাওমি যদিও এখনো দেশে অ্যাসেম্বল করছে না, তারপরও কিন্তু দেশে অ্যাসেম্বল করা ডিভাইসগুলোর সাথে সমানে ট্যাকল দেয়ার মত প্রাইসিং তারা করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে রিয়েলমি দেশে অ্যাসেম্বল শুরু করার পর C3 ও 5i বেশ আকর্ষণীয় দামে আনলেও তারপর থেকে তাদের ডিভাইসগুলো প্রাইসিংয়ে বেশ হতাশ করে আসছে। কিন্তু narzo 20-তে এসে তারা আবারো দামে চমক দেখিয়েছে এবং আমার কাছে এটা C3 ও 5i থেকেও প্রাইস টু পারফর্মেন্স রেশিওতে বেটার মনে হয়েছে।
রিয়েলমি নারজো ২০ এর একটি ভ্যারিয়েন্টই দেশে এসেছে, ৪/৬৪ যার দাম ১০ টাকা কম ১৪০০০ টাকা। অন্যদিকে পোকো এম৩ এর দুটি ভ্যারিয়েন্ট এসেছে, যার একটি ৪/৬৪, ১৫০০০ টাকা, আর ৪/১২৮ ভ্যারিয়েন্টের দাম ১৬৫০০ টাকা। তবে এখানে একটা ব্যাপার আছে, যা স্টোরেজ কম্পারিজনের সময় আলোচনা করেছি। তবে আমাদের মূল কম্পারিজন হবে ৪/৬৪ ভার্সনের সাথে।
এক্সটেরিয়র
বরাবরই শাওমি তাদের ডিভাইসে বৈচিত্রপূর্ণ ডিজাইন এনে থাকে, যতটা বৈচিত্র রিয়েলমি ডিভাইসে দেখা যায় না। নারজো ২০ এর ভি-প্যাটার্ন ব্যাক ডিজাইন আমার ভালোই লেগেছে, কিন্তু যদি বলি এর ক্যামেরা মডিউলের কথা, আমার মোটেও পছন্দ হয়নি, এটা realme C11, C12, C15 ফোনগুলোর অনুরূপ। দুটি কালার ভ্যারিয়েন্টে এসেছে, নামগুলো সেই, Silver Sword ও Blue Blade।
অন্যদিকে পোকো এমথ্রি-র ডিজাইনের বেস্ট পার্ট হলো এর ভিন্নধর্মী ক্যামেরা বাম্প, অনেকটা ওয়ানপ্লাস ৮টি সাইবারপাঙ্ক এডিশনের মত। তো, এটা অনেকেরই পছন্দ হবে। বাদবাকি ডিজাইন বেশ সিম্পল ও সুন্দর। POCO Yellow কালারটা আমার বেশ ভালো লেগেছে, অন্য দুটি কালার হলো Cool Blue আর Power Black।
narzo 20-তে রেয়ারে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর যুক্ত আছে, কিন্তু M3-তে পাওয়ার বাটনের সাথে সাইড মাউন্টেড, যেটা আমার বেশি পছন্দ। আরেকটি ব্যাপার হলো ওজনের দিক দিয়ে M3 198g, narzo 20 208g, তফাৎ বেশি না হলেও 6000 mAh ব্যাটারী দিয়ে 200g এর নিচে ওজন শুনতে বেশ আকর্ষণীয়। অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী থিকনেসও M3-তে সামান্য কম, 9.6mm, যেটা narzo 20-তে 9.8mm।
narzo 20, অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়নি, তবে খুব সম্ভবত 20:9 অ্যাসপেক্ট রেশিওর, যেখানে M3 19.5:9। একারণে নারজোর দীর্ঘতা একটু বেশি 164.5mm, আর এমথ্রির 162.3mm। কিন্তু প্রস্থে নারজো একটু কম, 75.9mm, যেখানে এমথ্রি 77.3mm। তো, হাতে ধরার সময় প্রস্থ কম হওয়ায় নারজো হয়ত একটু বেশি কমফোর্টেবল হতে পারে, নট সো বিগ ডিল।
যাইহোক, ওভারঅল আমার মতে এক্সটেরিয়র সেকশনে সহজেই বিজয়ী হয় POCO M3।
ডিসপ্লে
আমি একজন মানুষ, যে 1366*768 রেজ্যুলেশনের 19″ মনিটরে 360P বা 480P ভিডিও দেখে অভ্যস্থ। তো, আমার জন্য 6.5″ ডিসপ্লেতে HD+ আর FHD+ আসলে বিশেষ ম্যাটার করে না। কিন্তু অবশ্যই অনেকের জন্য এটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে ডিসপ্লে যখন সেই অংশ যার মাধ্যমে ফোনের সব আউটপুট আপনি দেখতে পাবেন, তখন ডিসপ্লে ভালো হওয়াটা জরুরী।
১৪-১৫ হাজার টাকায় একটা ডিভাইস কিনতে হলে স্বাভাবিকভাবেই 1080P বা FHD+ রেজ্যুলেশন এক্সপেক্টেড থাকে, কিন্তু দেশের প্রেক্ষিতে বেশিরভাগ ডিভাইসেই 720P বা HD+ ডিসপ্লে আমরা দেখে দেখে থাকি। narzo 20 তেও HD+ ডিসপ্লে, রেজ্যুলেশন সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই, খুব সম্ভব 1600*720।
তবে POCO M3 এর অন্যতম আকর্ষণ হলো এখানে FHD+ রেজ্যুলেশনের ডিসপ্লে আছে, 2340*1080। তাছাড়া রিয়েলমি তাদের ওয়েবসাইটে ডিসপ্লে প্রটেকশন উল্লেখ করেনি, যেখানে M3-তে Gorilla Glass 3 থাকছে। আকারে M3-র ডিসপ্লে সামান্য বড় 6.53″, যেটা narzo 20-তে 6.5″। দুটো ডিসপ্লেই IPS LCD Panel।
সব মিলিয়ে, ডিসপ্লে সেকশনেও অবশ্যই সহজ বিজয়ী POCO M3।
চিপসেট/SoC
স্মার্টফোনে যে চিপসেট থাকে, তাকে SoC বলাটা বেশি একুরেট, চিপসেট বললেও সমস্যা নেই। চিপসেট হলো অনেকগুলো চিপের সমষ্টি, এখানে CPU, GPU, ISP, DSP এরকম অনেক পৃথক পৃথক চিপ থাকতে পারে। কিন্তু স্মার্টফোনের চিপসেটে এই সব অংশ এক করে একটি চিপেই থাকে, যেটাকে SoC বা System on a Chip বলা হয়। খুব দ্রুতই (১ জানুয়ারী ইন শা আল্লাহ) চিপসেট নিয়ে প্রায় ৬০০০ শব্দের একটি পোস্ট নিয়নবাতিতে প্রকাশ হবে ইন শা আল্লাহ। কাজেই এরকম পোস্টগুলোর জন্য নিয়নবাতি ব্লগটি অবশ্যই নিয়মিত ভিজিট করবেন।
narzo 20-তে থাকছে Helio G85, যা এর প্রধান আকর্ষণ। অন্যদিকে POCO M3-তে Snapdragon 662 দেয়া হয়েছে। SD662-এর প্রসেসর অক্টারো, যেখানে থাকছে চারটি Kyro 260 Gold (ARM Cortex A73@2.0GHz), বাকি চারটি Kyro 260 Silver (ARM Cortex A53@1.8GHz)। জিপিইউ Adreno 610, যার ক্লকস্পিড উল্লেখ করা হয়নি। ট্রানজিস্টর সাইজ 11nm।
অন্যদিকে Helio G85-ও অক্টাকোর, কিন্তু এখানে দুটি কোর হলো ARM Cortex A75@2.0GHz আর বাকি ছয়টি A55@1.8 GHz। ট্রানজিস্টর সাইজ 12nm। িজপিইউ Mali G52 MC2@1GHz।
চিপসেট নিয়ে ভালো জানা না থাকলে SD662 বেটার মনে হতে পারে, যেহেতু এতে চারটা 2GHz কোর, ট্রানজিস্টর সাইজও কম। তবে আসলে না। A75 কোর A73 কোর অনেকটা বেটার, ফলে বিশেষ করে সিঙ্গেল কোর পারফর্মেন্সে narzo 20 একটা বিশেষ এডভান্টেজ পায়। আবার ট্রানজিস্টর সাইজ সামান্য বেশি হলেও A55 কোরগুলো A53 থেকে ১৫% পাওয়ার ইফিশিয়েন্ট আর ১৮% পাওয়ারফুল (ARM এর দাবি অনুযায়ী)। তারপর Mali G52 MC2 জিপিইউ-ও Adreno 610 থেকে বেটার।
সবমিলিয়ে বুঝতেই পারছেন, Helio G85 ভালোভাবেই SD662 থেকে এগিয়ে। SD662 কিন্তু মোটেও খারাপ না, ১৫০০০ টাকায় যথেষ্ট ভালো এবং পাওয়ারফুল, তবে হেড টু হেড কম্পারিজনে G85 সহজ বিজয়ী। তবে Snapdragon এখনও লং টার্মে বেশি বিশ্বস্ত ধরা হয়, অনেকেই Snapdragon প্রিফার করেন, সেরকম কারো জন্য SD662-সহ POCO M3 বেটার চয়েস হতে পারে।
যাইহোক, চিপসেট সেকশনে narzo 20 বিজয়ী হচ্ছে।
মেমোরি-স্টোরেজ
Poco M3 দুটো ভ্যারিয়েন্টে এসেছে, যেখানে ৪/১২৮ ভ্যারিয়েন্টে UFS 2.2 স্টোরেজ থাকলেও ৪/৬৪ ভার্সনে থাকছে UFS 2.1, উভয় ভ্যারিয়েন্টে র্যাম LPDDR4x। অন্যদিকে রিয়েলমি তাদের ওয়েবসাইটে এসংক্রান্ত তথ্য উল্লেখ করেনি। যাইহোক, র্যাম LPDDR4x-ই হওয়ার কথা, কিন্তু GSMArena অনুযায়ী স্টোরেজ টেকনোলজি হলো eMMC 5.1। ডেডিকেটেড এসডি কার্ড স্লট দুটো ডিভাইসেই আছে।
আমরা ৪/৬৪ ভ্যারিয়েন্টটিই মূলত বিবেচনা করছি এবং এখানে রিড-রাইট স্পিডে UFS টেকনোলজি বেটার অপশন। কাজেই এখানে POCO M3 বিজয়ী।
ক্যামেরা
ক্যামেরা একটা সেক্টর, যেখানে স্পেক থেকে খুব কমই ধারণা পাওয়া যায়। দুটো ডিভাইসেই 48MP f/1.8 প্রাইমারি ক্যামেরাসহ ত্রিপল ক্যামেরা সেটআপ থাকছে, আর আমরা জানি MP ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে বাজেট রেঞ্জের 12MP বা 13MP ক্যামেরাগুলো থেকে সাধারণত বাজেট রেঞ্জের 48MP/64MP ক্যামেরাগুলোর সেন্সর বেটার হয়, কাজেই দুটো ফোনেই এই বাজেটের হিসেবে ভালো ক্যামেরা-ই এক্সপেক্টেড।
তবে POCO M3-তে বাকি দুটো ক্যামেরা হলো 2MP করে ম্যাক্রো ও ডেপথ, যেখানে narzo 20-তে ডেপথ ক্যামেরার পরিবর্তে এজ ডিটেকশন সফটওয়্যারের হাতে ছেড়ে দিয়ে 8MP f/2.3 119° ফিল্ড অফ ভিউ সমৃদ্ধ একটি আল্ট্রাওয়াইড লেন্স দেয়া হয়েছে। দুটো স্মার্টফোনেই সেলফি ক্যামেরা 8MP f/2.0।
সবশেষে, আল্ট্রাওয়াইড লেন্স থাকায় narzo 20-কে ক্যামেরা সেকশনে এগিয়ে রাখছি।
ব্যাটারী
দুটো ডিভাইসেই থাকছে 6000 mAh ম্যাসিভ ব্যাটারী। তবে ব্যাকআপ narzo 20-র HD+ ডিসপ্লে, তুলনামূলক পাওয়ার ইফিশিয়েন্ট সিপিইউ কোরের জন্য একটু বেশি হতে পারে। বড় ব্যাটারীকে চার্জ করার জন্য দুটো ফোনেই 18W (9V/2A) ফাস্ট চার্জ সমর্থন থাকছে, থাকছে Type C পোর্ট। narzo 20-তে বক্সে 18W চার্জার থাকছে, কিন্তু POCO M3-তে সাপোর্ট না থাকলেও বক্সে 22.5W চার্জার দেয়া হয়েছে, যা একটা গিমিক ব্যাপার এবং এটা ভালো লাগেনি।
সেন্সর
narzo 20-তে Magnetic induction sensor, Light sensor, Proximity sensor ও Accelerometer থাকছে। খুব সম্ভবত সাথে সফটওয়্যার বেজড Gyroscope সেন্সর থাকবে, যা ম্যাগনেটিক ও একসেলেরোমিটার সেন্সর সমন্বয়ে কাজ করে, এবং স্বাভাবিকভাবেই একুরেসি হার্ডওয়্যার বেজড সেন্সর থেকে কম।
শাওমি বরাবরই IR Bluster দিয়ে থাকে, যা POCO M3-তেও আছে। আরো থাকছে Proximity sensor, Light sensor, Accelerometer, Gyroscope Electronic compass ও Linear motor সেন্সর। তাই অবশ্যই এখানে M3 বিজয়ী।
সফটওয়্যার
কেউ কি আমাকে একটু বুঝিয়ে দিবেন, Narzo 20 ওভারভিউ পেজে লেখা Android 11 আর স্পেকস পেজে Android 10 বেজড realme UI? যাইহোক, আমি নিশ্চিত নই, সম্ভবত এখন পর্যন্ত এটা Android 10 বেজড, পরবর্তীতে Android 11 আসবে কিনা জানি না। অন্যদিকে POCO M3-ও Android 10 বেজড MIUI।
MIUI বা realme UI কোনটা নিয়েই আমার বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই, কাজেই এ নিয়ে আর কিছু বলারও নেই।
অন্যান্য
বক্সে কেউই ইয়ারফোন দিচ্ছে না, তবে 3.5mm ইয়ারফোন পোর্ট থাকছে। POCO M3 সাথে একটা সফট কেস দিচ্ছে, যা নারজোর বক্সে থাকছে না।
পরিশেষে
আমার পক্ষ থেকে স্পেক যেটুকু বিশ্লেষণ করার ছিলো, সেটুকু করেছি। যদি আপনি এই দুটো ডিভাইসের একটি কেনার চিন্তা করেন, তাহলে ঠিক কোন বিষয়গুলো আপনার প্রায়োরিটি অবশ্যই তা বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিবেন। আমার কাছে দুটো ডিভাইসই দাম অনুযায়ী যথেষ্ট আকর্ষণীয় আর ভ্যালু ফর মানি মনে হয়েছে।
দ্রষ্টব্য: কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও সঙ্গত কারণেই পোস্টের কিছু কথায় পোকো ব্র্যান্ডকে শাওমির অধীন ধরে নেয়া হয়েছে। কেননা এমনকি পোকোর তথ্য পেতে হলেও আপনার Mi Bangladesh ওয়েবসাইটেই যেতে হবে। আর কোম্পানি নারজো বানান সব ছোট হাতের (narzo), পোকো সব বড় হাতের (POCO) লিখে, তাই সেভাবেই লিখেছি।