সৃষ্টিকর্তা একজন হলে কেন এত ধর্ম? সত্য ধর্ম কোনটি?

: আচ্ছা ভাইয়া, সৃষ্টিকর্তা কি সত্যিই আছে?

আধা ঘন্টা আগে ফেসবুকে মেসেজটা পাঠিয়েছে হাসান। এখন রাত আড়াইটা। সেহরি খেতে উঠে দেখলাম। হাসান আমার বছর তিনেকের ছোট হবে। মুসলিম পরিবারে জন্ম হিসেবে কিছুকিছু ধর্ম মানে। জুমআর নামাজটা মিস হয় না টাইপের। তবে আজকাল ধর্ম নিয়ে একটু সিরিয়াস হয়েছে। মাঝে মাঝে এরকম প্রশ্ন করে। আমার অবশ্য বিরক্ত লাগে না, কারণ ও জানার জন্যই প্রশ্ন করে, অযাচিত তর্ক করার জন্য না। এখনও একটিভ দেখাচ্ছে। রিপ্লাই দিলাম,

– এই সুনিয়ন্ত্রিত সৃষ্টিজগৎ কি একজন মহান স্রষ্টার সাক্ষ্য দেয় না?

ওদিক থেকে ফিরতি মেসেজ আসলো কয়েক মিনিট দেরিতে,

: কিন্তু, যাকে দেখিনি, কীভাবে বুঝব তিনি আছেন? তাছাড়া, পদার্থবিজ্ঞান এখন বলছে, বিশ্বজগতের সৃষ্টিতে স্রষ্টা অনাবশ্যক। প্রকৃতির নিয়মে শূন্যতা থেকে বিপরীতধর্মী পজিটিভ ও নেগেটিভ এনার্জি সৃষ্টি হয়ে সৃষ্টিজগতের সূচনা হতে পারে। বাহিরের শক্তি প্রয়োজন নেই।

মৃদু হেসে একটা লম্বা নিশ্বাস নিলাম। তারপর লিখলাম,

– দূরে কোথাও ধোঁয়া উড়ছে। এর একটা অর্থ আছে, সেখানে আগুন জ্বলছে, ধোঁয়া দেখেই তুমি কিন্তু বলে দিতে পারবে। মানুষকে সে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতির সবকিছু যদি নিজের থেকে হয়, তবে তা কখনো এবং কখনোই এত সুনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। সৃষ্টি তার স্রষ্ঠার সাক্ষ্য দেয়। এখানে দুটো কথা আছে, প্রথমত তারা শূন্যস্থানের উপর ভিত্তি করে কথা বলে। কিন্তু যখন আমি বলছি শূন্য তখন স্থানের প্রশ্ন আসছে কীভাবে? তারা বলে, প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। প্রশ্ন হলো, তারা ‘প্রকৃতি’ আর ‘স্থান’ কোথায় পাচ্ছে যখন আমরা একদম ‘শূন্য’ নিয়ে কথা বলছি? দ্বিতীয়ত, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যেকোনভাবে সত্যিই সবকিছু কোন বুদ্ধিমান সত্তা ছাড়া সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে, তাহলে তা অর্থবহ, সুশৃঙ্খল কিছু হতে পারত না। কিছু কালি আর কাগজ একসাথে রেখে দিলেও কখনো তা থেকে বাতাসের ঝাপটায় কোন অর্থবহ বই তৈরি হয়ে যায় না, দরকার হয় একজন লেখকের। তবে শূন্য থেকে কীভাবে আসতে পারে এ সবকিছু? মহাবিশ্বের এই সুবিশাল আয়োজন? কেন সবকিছু এত সুনিয়ন্ত্রিতভাবে চলে? কেন কখনো আপেল গাছে পেয়ারা কিংবা আমি গাছে লিচু ধরে না? বিজ্ঞান তো শুধু প্রকৃতির নিয়মগুলো ব্যাখ্যা করে, কিন্তু এ নিয়মগুলো কীভাবে এলো? এ সবকিছু সাক্ষ্য দেয় এমন একজনের যিনি সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যে সীমাবদ্ধ না। যার শুরু নেই, শেষ নেই। তিনি অনন্ত, অসীম। আর তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। আরেকটা মজার বিষয় বলব? নাস্তিকরাও কিন্তু একরকম স্রষ্টায় বিশ্বাসী, তারা অজ্ঞতা ও গোঁড়ামিবশত প্রকৃতিকে স্রষ্টার আসনে বসিয়েছে মাত্র!

: সেটা কীরকম?

– স্রষ্টার ধারণা আমাদের জন্মগতভাবেই আছে। স্রষ্টায় বিশ্বাস করাটা মানুষের ফিতরাতগত বিষয়। নাস্তিকরা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস না করার কথা বললেও দেখো, তারা প্রকৃতিকেই স্রষ্টা বানিয়ে নিয়েছে। তারা বলে, শূন্য থেকে ‘প্রকৃতির নিয়মে’ ‘প্রকৃতির ইচ্ছাতে’ সবকিছু হয়েছে। আবার তারা ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’, ‘প্রকৃতির দয়া’ এসব কথা বলে। এর অর্থ কী? প্রকৃতি কি ইনটেলিজেন্ট? এটা অদ্ভুত না, প্রকৃতিকে তারা ইনটেলিজেন্ট ভাবতে পারে, কিন্তু এর পেছনে কোন ইনটেলিজেন্ট সত্তা আছেন, এটা বললে তাদের দৃষ্টিতে অবৈজ্ঞানিক। বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে বিশ্বজগতের সূচনা, এটা বললে ঠিক আছে, কিন্তু একজন এই বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছিলেন, এটা বলা অবৈজ্ঞানিক।

: কিন্তু ভাইয়া, তাহলে কি প্রশ্ন আসবে না, সৃষ্টিকর্তা কীভাবে আসলেন?

– একসময় পৃথিবীতে তুমি ছিলে না। তারপর তোমার জন্ম হয়েছে, তুমি পৃথিবীতে এসেছো, তাই না?

: হ্যাঁ

– এবং একদিন তোমার মৃত্যুও হবে?

: অবশ্যই, আমার এবং সবারই।

– এই জন্ম এবং মৃত্যু, সূচনা এবং সমাপ্তি, এটা সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। স্রষ্টার নয়। সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য দিয়ে স্রষ্টাকে মাপা যায় না। যেমন একটা উদাহরণ দিই, একটা বই কালি এবং কাগজে তৈরি। বইয়ের লেখক কিন্তু তাই বলে কালি-কাগজে তৈরি নয়! কারণ এটা বইয়ের বৈশিষ্ট্য, লেখকের নয়।

: কিন্তু ভাইয়া, তাহলে কেন এত ধর্ম? কেন ধর্মে ধর্মে এত ভিন্নতা? যদি সৃষ্টিকর্তা একজন হয়, তবে তার ধর্ম কোনটি? কীভাবে বুঝব?

সহজভাবে উত্তর দিয়ে দিলাম।

– ইসলাম। এই প্রশ্নের একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান।

: কিন্তু, আমি যদি কোন হিন্দুকে এই প্রশ্ন করি সে নিশ্চয়ই শুধু হিন্দুধর্মকে সত্য বলবে?

– না, বলবে না, বলতে পারবে না যদি সে সত্যিই হিন্দুধর্ম মানে।

: কেন?

– গুগলে একটু সার্চ দেও তো Bhagavad Gita Chapter 3 Verse 35। কী পেলে মেসেজ দেও।

: śhreyān swa-dharmo viguṇaḥ para-dharmāt sv-anuṣhṭhitāt swa-dharme nidhanaṁ śhreyaḥ para-dharmo bhayāvahaḥ

– অর্থাৎ, নিখুঁত পরধর্ম অপেক্ষা ত্রুটিপূর্ণ স্বধর্ম শ্রেয়। স্বধর্মে মৃত্যু শ্রেয়, পরধর্ম ভয়ঙ্কর। হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরের কোন ধারণা নেই- মানে যার যে ধর্মে জন্ম, তার জন্য সেটাই সঠিক।

: এটাই কি একদিক দিয়ে ভালো না? কোন সংঘাত নেই। যে যার ধর্ম অনুশীলন করবে?

– না। এটা কখনোই হতে পারে না। কোন ধর্ম তেত্রিশ কোটির উপাসনা করতে বলবে, আর কোন ধর্ম একজনের, আর কোন ধর্ম বলবে ঈশ্বর নেই, সব ধর্ম একসাথে কীভাবে সত্য হতে পারে? বৌদ্ধধর্ম কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্বই স্বীকার করে না। (উইকপিডিয়া দ্রষ্টব্য)

: সেটা ঠিক… আর খ্রিস্টান ধর্ম?

– গুগলে সার্চ দিয়ে Matthew 15:22-15:24 পর্যন্ত দেখ তো কী লেখা…

: 22. A Canaanite woman from that vicinity came to him, crying out, “Lord, Son of David, have mercy on me! My daughter is demon-possessed and suffering terribly.” 23. Jesus did not answer a word. So his disciples came to him and urged him, “Send her away, for she keeps crying out after us.” 24. He answered, “I was sent only to the lost sheep of Israel.”

– কী বুঝলে? যীশু এমনকি বাইবেলের বর্ণনাতেই স্পষ্ট যে, পুরো পৃথিবীবাসীর জন্য আসেননি। তিনি এসেছিলেন একটি নির্দিষ্ট সময় ও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য।

: কিন্তু খ্রিস্টানরাতো সারা পৃথিবীব্যাপী ধর্ম প্রচার করে?

– হ্যাঁ, কারণ তারা তাদের ধর্মকে বিকৃত করেছে। সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আসা কথাকে পরিবর্তন করেছে তাদের মত। তারা তোমাকে মথি ২৮:১৯ এর উদ্ধৃতি দিবে, যেখানে সব জাতি থেকে শিষ্য বানাতে বলা হয়েছে। কিন্তু মথি ১৫:২৪ এর কথা তারা বলবে না। এই বৈপরিত্ব থেকেই বোঝা যায়, বর্তমান বাইবেলে অনেক কথা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। এখন এটা অবশ্যই আর নির্ভরযোগ্য কোন গ্রন্থ না। তবে মজার কথা জানো? এখনও বাইবেলে কিন্তু একাধিক জায়গায় পরবর্তী নবীর ভবিষ্যৎবাণী থেকে গেছে। যোহন, ১৬:৭ এ বলা হয়েছে, “বরং, আমি তোমাদের সত্যি কথাটি বলি। আমি চলে গেলেই তোমাদের সবার জন্য ভাল হবে। কারণ আমি না গেলে সেই সাহায্যকারী আসবে না কিন্তু আমি গেলে তাকে আমি তোমাদের কাছে পাঠাবো।” বলত, সেই সাহায্যকারী কে হতে পারেন?

: রাসুলুল্লহ হযরত মুহাম্মদ (সা) অবশ্যই।

– হ্যাঁ।

: আর ইসলাম তাহলে কী বলে?

– সেহরির সময় হয়ে গেলো ভাইয়া, পরে এ নিয়ে কথা হবে ইন শা আল্লাহ। আচ্ছা?

: ইন শা আল্লাহ।

পরেরদিন রাতে আমিই নক দিলাম,

– আছো, হাসান?

: আছি, ভাইয়া।

– ইসলামে কী বলা হয়েছে জানো?

: কী?

– “আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
সূরা আল ইমরান, আয়াত ৮৫

দেখো, কী স্পষ্ট কথা। পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া হয়েছে ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম। অন্য কোন ধর্মাবলম্বী এত জোর দিয়ে বলতে পারবে না তার ধর্মই সত্য, তার ধর্মগ্রন্থই অন্য কথা বলছে। শুধু ইসলাম ছাড়া।

: ভাইয়া, একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকে গেলো। এত ধর্ম কেন তাহলে?

– ছোট্ট করে যদি বলি, মানুষ বারবার পথভ্রষ্ট হয়েছে, আর আল্লাহ নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন সঠিক পথের দিশা দিতে। তাদের কিতাবেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যৎবাণী ছিলো। কিন্তু তারা তাদের কিতাবকে বিকৃত করেছে। কিছু ধর্মের মূলে ছিলো কোন আসমানী ধর্ম, যা এখন বিকৃত হয়ে গেছে আর কিছু কিছু ধর্ম মানবরচিত। যেমন, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে যায়। কেউ বলে তিনি ছিলেন একজন নবী ও রাসুল, কেউ বলে তিনি ছিলেন ঈশ্বরের পুত্র, আর কেউ বলে তিনি নিজেই ছিলেন ঈশ্বর।

“যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী; যার গুণাবলী তারা নিজদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে। আর তাদের থেকে বোঝা ও শৃংখল- যা তাদের উপরে ছিল- অপসারণ করে। সুতরাং যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার সাথে যে নূর নাযিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করে তারাই সফলকাম।”
– সূরা আল আ’রাফ, আয়াত ১৫৭

পরে ইন শা আল্লাহ ডিটেইলে এটা নিয়ে আলোচনা করব। আচ্ছা?

: ঠিক আছে ভাইয়া।

দুতিনদিন সময় নিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট লিখলাম এই বিষয়ে। তারপর ওকে মেনশন করে দিলাম। পোস্টটা ছিলো:

একজন নির্মাতা তার পণ্যের জন্য একটি ম্যানুয়াল বই দিয়ে দেন। মানুষকে সৃষ্টি করে সৃষ্টিকর্তাও আমাদের জীবন-বিধান দিয়ে দিয়েছেন। আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, কোন পথে আমাদের চলতে হবে সফলতার জন্য আর ভুল পথের পরিণতি কী হবে। প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ) কে পৃথিবীতে প্রেরণ করে আল্লাহ তায়ালা সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছিলেন।

“আমি বললাম,‘তোমরা সবাই তা থেকে নেমে যাও। অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন হিদায়াত আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না’।”
– সূরা আল বাকারা, আয়াত ৩৮

হযরত আদম (আ) কে আল্লাহ তায়ালা তাওহীদের শিক্ষা দিয়েছেন। এমনকি প্রত্যেক নবীর শিক্ষারই মূল কথা তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ। তবে কীভাবে এর সাথে শিরক মিশ্রিত হলো? আমাদের বিবেকবুদ্ধি দেওয়া হয়েছে, যা আমাদের সত্য ও মিথ্যাকে চিনতে সাহয্য করে। আর শয়তান ও নফস পাপের দিকে আমাদের নিয়ে যায়, সরল পথ থেকে বিচ্যুত করে।

“(ইবলীস) বললঃ আপনি যে আমাকে পথভ্রষ্ট করলেন এ কারণে আমিও শপথ করে বলছি – আমি আপনার সরল পথে অবশ্যই ওৎ পেতে বসে থাকব। অতঃপর আমি তাদের সম্মুখ দিয়ে, পিছন দিয়ে, ডান দিক দিয়ে এবং বাম দিক দিয়ে তাদের কাছে আসব, আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবেননা।”
– সূরা আল ‘আরাফ, আয়াত ১৬, ১৭

মূর্তিপূজার সূচনা হয়েছিলো অন্ধভক্তি থেকে। হযরত নূহ (আ) এর আগমনের পূর্বে ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক, নাসর ছিলেন কয়েকজন সৎ, পুণ্যবান লোক। তারা যখন মারা গেলেন, লোকেরা তাদের কবরের ওপরে মসজিদ স্থাপন করলো এবং সেখানে তাদের ছবি রেখে দিলো যেন তারা তাদের অবস্থা ও ইবাদতের কথা স্মরণ করতে পারে এবং নিজেদেরকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারে। শয়তানের প্ররোচনায় কালক্রমে তাদের ছবির পরিবর্তে মূর্তি স্থাপন করা হলো এবং মানুষেরা আল্লাহর পরিবর্তে সে মূর্তিগুলোর উপাসনাতে নিমজ্জিত হলো। [সূরা আল আরাফ – তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ আয়াত ৫৯-৬৪, সহীহ আল বুখারী – হাদিস ৪৯২০ দ্রষ্টব্য]

মূর্তিপূজা যখন বেড়ে যেতে থাকলো, আল্লাহ তায়ালা তখন হযরত নূহ (আ) কে প্রেরণ করলেন। তিনি তাওহীদের দাওয়াত দিলেন।

“আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। সে তাদেরকে বলেছিলঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা শুধু আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই, আমি তোমাদের প্রতি এক গুরুতর দিনের শাস্তির আশংকা করছি।”
– সূরা আল ‘আরাফ, আয়াত ৫৯

হযরত নূহ (আ) এর দীর্ঘ দাওয়াতে খুব কম মানুষই ঈমান আনয়ন করলো। আল্লাহ তায়ালা হযরত নূহ (আ) কে নৌকা তৈরি করতে নির্দেশ দিলেন। হযরত নূহ (আ) এবং ঈমানদাররা নৌকায় উঠলেন, তাদের আল্লাহ রক্ষা করলেন এবং বাকিদের তুফানে ডুবিয়ে দিলেন।

“অতঃপর তারা তাকে মিথ্যাবাদী বলে। ফলে তাকে ও তার সঙ্গে যারা নৌকায় ছিল, আমি তাদেরকে উদ্ধার করি। আর যারা আমার নিদর্শনাবলী প্রত্যাখ্যান করেছিল, তাদেরকে (তুফানে) নিমজ্জিত করি। নিশ্চয় তারা ছিল এক অন্ধ সম্প্রদায়।”
– সূরা আল ‘আরাফ, আয়াত ৬৪

কিছুকাল পরে, আবারো মানুষ অবাধ্যতায় লিপ্ত হলো। হযরত নূহ (আ) এর পুত্র সামের বংশধর আদ জাতি তাদের শক্তি-সামর্থ্যের কারণে অহঙ্কার এবং কুফরী করে। তাদের নিকটে আল্লাহ হযরত হূদ (আ) কে প্রেরণ করেন। “‍আর ‘আদ সম্প্রদায়, তারা যমীনে অযথা অহঙ্কার করত এবং বলত, ‘আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী কে আছে’? তবে কি তারা লক্ষ্য করেনি যে, নিশ্চয় আল্লাহ যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? আর তারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করত।”
– সূরা আল ফুসসিলাত, আয়াত ১৫

এভাবে মানুষ বারবার অবাধ্য হয়েছে এবং আল্লাহ তাদের নিকট নবি-রাসুল পাঠিয়েছেন। প্রত্যেক নবীর দাওয়াতের মূল কথা কিন্তু একই ছিলো। প্রত্যেকে তাওহীদ, রিসালাতের শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে সত্যের দাওয়াত দিয়েছেন। যুগ ও জাতি অনুযায়ী বিধানগত কিছু ভিন্নতা ছিলো মাত্র! হযরত মুসা (আ), হযরত ঈসা (আ), হযরত মুহাম্মদ (সা) কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা দেননি।

অর্থাৎ, মানব সৃষ্টির শুরু থেকে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে একটি ধর্মই শিক্ষা দিয়েছেন। বাকি ধর্মগুলোর কিছু মানবসৃষ্ট, কিছু আসমানী ধর্মের বিকৃত রূপ। ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম এবং ইসলাম ধর্মকে বলা হয় ইব্রাহিমীয় ধর্ম অথবা আব্রাহামিক রিলিজিয়ন।

“বল, ‘আমি রাসূলদের মধ্যে নতুন নই। আর আমি জানি না আমার ও তোমাদের ব্যাপারে কী করা হবে। আমার প্রতি যা ওহী করা হয়, আমি কেবল তারই অনুসরণ করি। আর আমি একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র’।”
– সূরা আল আহকাফ, আয়াত ৯

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দুয়া করেছিলেন,

“‘হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে আর তাদেরকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’।”
– সূরা আল বাকারা, আয়াত ১২৯

এই দুয়া আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন কবুল করেন এবং অনেক পয়গম্বর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধারায় আসেন। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশপরম্পরায় জন্ম নিয়েছেন। এই ধারাবাহিকতা ইসলামের সত্যতার আরেকটি প্রমান।

তবে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মকে বিকৃত করে। যা থেকে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের উৎপত্তি ঘটে। এখানে মনে রাখতে হবে, পয়গম্বরগণ ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান ছিলেন না, তারা ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম।

“নাকি তোমরা বলছ, ‘নিশ্চয় ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানেরা ছিল ইয়াহূদী কিংবা নাসারা? বল, ‘তোমরা অধিক জ্ঞাত নাকি আল্লাহ’? আর তার চেয়ে অধিক যালিম কে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে যে সাক্ষ্য রয়েছে তা গোপন করে? আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।”
– সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৪০

“ইবরাহীম ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান ছিলেন না, বরং তিনি একনিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন। আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্তও ছিলেন না।”
– সূরা আল ইমরান, আয়াত ৬৭

আল্লাহ তায়ালা একটি ধর্মের শিক্ষাই পয়গম্বরদের দিয়েছেন। সময় ও জাতি অনুযায়ী বিধানগত কিছু পার্থক্য থাকলেও শিক্ষা একই ছিলো। অর্থাৎ, তারা শিক্ষা দিয়েছেন তাওহীদ ও রিসালাতের। শিখিয়েছেন একজন প্রভুর ইবাদত করতে। শিখিয়েছেন সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য। মুমিন ও সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ জানিয়েছেন আর অন্য পথে চলার পরিণতি জানিয়েছেন। নবীদের শিক্ষার মধ্যে কোন অসামঞ্জস্যতা নেই।

“বল, ‘হে কিতাবীগণ, তোমরা এমন কথার দিকে আস, যেটি আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত না করি। আর তার সাথে কোন কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ ছাড়া রব হিসাবে গ্রহণ না করি’।”
– সূরা আল ইমরান, আয়াত ৬৪

এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, পূর্বের ন্যায় নবী-রাসুল প্রেরণের ধারা বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশেষ নবী। এবং তার মাধ্যমে রিসালাতের ধারা পূর্ণতা পেয়েছে। ফলে নতুন রাসুল কিংবা নবী আসার প্রয়োজন নেই।

উবাই ইবনু কাব (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ (পূর্ববর্তী) নাবীগণের মাঝে আমার উপমা সেই লোকের মত যে একটি সুরম্য, সম্পূর্ণ ও সুশোভিত প্রাসাদ নির্মাণ করল, কিন্তু একটি ইটের জায়গা অসম্পূর্ণ রেখে দিল। জনগণ প্রাসাদটি প্রদক্ষিণ করত এবং তাতে অবাক হয়ে বলত, যদি তার নির্মাণকারী ঐ ইটের জায়গাটি পূর্ণ করত। অতএব আমি নাবীগণের মাঝে সেই ইটের জায়গার সমতুল্য।
– জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৩৬১৩ হাদিসের মান: সহিহ

এখানে আমরা একটি বাস্তব উদাহরণ দেখতে পারি, রাসুলুল্লহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যা নাজিল হয়েছে, তা এখনও অবিকৃত। আল কুরআনের একটি হরফও এত শত বছরে পরিবর্তন হয়নি। অথচ, অন্য কোন আসমানী ধর্ম তার মূল রূপে নেই। অর্থাৎ, ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, ইসলাম সত্য ধর্ম।

“বরং তিনি, যিনি সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর তার পুনরাবৃত্তি করবেন এবং যিনি তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে রিযিক দান করেন, আল্লাহর সাথে কি কোন ইলাহ আছে? বল, ‘তোমাদের প্রমাণ নিয়ে এসো যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’”
– সূরা আন নামাল, আয়াত ৬৪

কৃতজ্ঞতা
quranmazid.com
সীরাহ অডিও সিরিজ
প্যারাডক্সিকাল সাজিদ
সংবিৎ
ডাবল স্ট্যান্ডার্ড

[উপস্থাপনের সুবিধার্থে কিছু অংশ গল্প এবং কিছু অংশ প্রবন্ধ আকারে লেখা হয়েছে। লেখাটির কোন কপিরাইট নেই। নির্দ্বিধায় শেয়ার এবং কপি করতে পারেন।]

6 Comments

  1. paradoxical sazid আগেও পড়েছি। আলহামদুলিল্লাহ আবার পড়ে ভালৈ লাগলো। শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

  2. সৃষ্টিকর্তা না থাকলে আপনাকে কে সৃষ্টি করলো? আপনার শরীরের দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন কতটা নিখুঁত ও কতটা সমন্বয় করে সব কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। পাগল তো সেই যে বলে সৃষ্টিকর্তা বলতে কিছুই নেই।

    সৃষ্টিকর্তা নিয়ে কিছুদিন আগে একটা ভিডিও দেখলাম। কিছুটা নিস্তব্ধ হয়েছিলাম ভিডিও টা দেখে। আপনি দেখলে আপনারাও ভুল ভাঙ্গবে।
    https://youtu.be/mjGhg5TSRf0

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *