নবম শ্রেণি – বিজ্ঞান – বিজ্ঞানের ধারণা ও শাখাবিন্যাস

This entry is part 4 of 5 in the series নবম শ্রেণি - বিজ্ঞান

কোন বিষয় পড়ার আগে সে বিষয় নিয়ে একটি সাধারণ ধারণা থাকা প্রয়োজন। এই অংশে আমরা বিজ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট কিছু সাধারণ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব। এটি সিলেবাসে সরাসরি নেই, তবে বিজ্ঞান নিয়ে যারা আগ্রহী, তাদের এই ব্যাপারগুলো জানা উচিৎ।

আমরা এখানে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের ক্ষেত্র, বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে জানবো। এরপর আমরা বিজ্ঞানের শাখাবিন্যাস নিয়ে জানার চেষ্টা করবো এবং সবশেষে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান বিভাগগুলোতে পাঠ্যবইয়ের অধ্যায়গুলোকে বিন্যস্ত করব।

বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রয়োগক্ষেত্র

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শব্দের অর্থ বিশেষ জ্ঞান। ইংরেজি Science শব্দটা এসেছে ল্যাটিন শব্দ Scientia থেকে, যার অর্থ জ্ঞান। এখন যেকোন ধরণের জ্ঞানকেই বিজ্ঞান বলা যাবে না। উদাহরণ দিই, বাংলাদেশের রাজধানীর নাম ঢাকা এটা এক ধরণের জ্ঞান হলেও একে বিজ্ঞান বলা হবে না।

ঠিক কখন একটা জ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা হবে, একটা ধারণা পাওয়ার জন্য আমরা এভাবে সংজ্ঞা দিতে পারি যে, বিজ্ঞান হলো পরীক্ষণযোগ্য ব্যাখ্যা ও প্রেডিকশনরূপে জ্ঞান অর্জন ও বিন্যস্ত করার নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা (উইকিপিডিয়া অনুসারে)। প্রেডিকশন বলতে এরকম কিছু বিষয় থাকতে পারে যা হয়ত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় সম্ভাব্য মনে হয়, কিন্তু শতভাগ নিশ্চিত হয় না।

বিজ্ঞান সে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের ভিত্তিতে যাচাইযোগ্য। এর বাইরে যা আছে তা বিজ্ঞানের ক্ষেত্র নয়। এটা গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে অনেকসময়ই কিছু বিষয়কে বিজ্ঞান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা মূলত বিজ্ঞানের আওতাতেই পড়ে না। আবার অনেকসময়ই দর্শনকে বিজ্ঞানের সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়।

চুরি করা কেন খারাপ- এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারবে না। মূলত ভালো-খারাপ, নীতি-নৈতিকতার যে ধারণা আছে, এটা বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত নয়। একারণে কোন সমাজে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধকে বিজ্ঞান দিয়ে পুনঃস্থাপন করতে চাইলে সেখানে নৈতিক শূন্যতা অনিবার্য।

বিজ্ঞান সবসময় চূড়ান্ত কথা বলে এরকম না। পূর্বের পর্যবেক্ষণ থেকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে আরো পর্যবেক্ষণ করে তার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সেখানে পরিবর্তন বা পরিমার্জন আসতে পারে। বিজ্ঞান একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, এবং আমাদের জ্ঞান চূড়ান্ত নয়- এই স্বীকারোক্তি বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম শর্ত।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বা Scientific Method হলো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পক্ষপাত ছাড়া কোন ঘটনার প্রকৃত সত্য উদঘাটন ও ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টার পদ্ধতি। সবসময় এবং সবার কাছে এর প্রক্রিয়া একইরকম না। সাধারণ ধারণার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে কয়েকটি ধাপে দেখানো যেতে পারে-

১. সমস্যা বা প্রশ্ন উত্থাপন
২. এভেইলেবল তথ্য ও রিসোর্স সংগ্রহ
৩. ব্যাখ্যা হিসেবে অনুকল্প (Hypothesis) প্রণয়ন
৪. পরীক্ষণ ও উপাত্ত সংগ্রহ
৫. উপাত্ত বিশ্লেষণ
৬. উপসংহার টানা ও তার ভিত্তিতে প্রয়োজনে তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ ধাপের পুনরাবৃত্তি
৭. ফলাফল প্রকাশ

অর্থাৎ আমরা শুরু করব একটা প্রশ্ন দিয়ে, যার উত্তর আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। বিজ্ঞান একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, কাজেই পূর্বের গবেষণা থেকে যে এ বিষয়ে যে তথ্য ও রিসোর্স এভেইলেবল আছে সেগুলো আমরা ব্যবহার করতে পারি। এর আলোকে আমাদের প্রশ্নের একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করব। এরপর আমরা পরীক্ষা করে প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমাদের দেয়া ব্যাখ্যার বিষয়ে উপসংহারে আসতে পারি।

আমাদের উপসংহার নতুন একটি অনুকল্পের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা পুনরায় পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন হতে পারে। অর্থাৎ তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ ধাপগুলো পুনরাবৃত্তিমূলক। সবশেষে গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল প্রকাশ করা যাবে। তবে এখানেই শেষ না, এরপর যত বেশি পুনঃপরীক্ষণ, আরো বেশি উপাত্ত নিয়ে কাজ করা যাবে, সঠিক ফলাফলে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি থাকবে। প্রায়সই অন্যান্য গবেষকরা গবেষণার পুনরাবৃত্তি করে থাকেন।

আরো জানতে: উইকিপিডিয়া – Scientific method

কয়েকটি টার্ম

বিজ্ঞান পড়ার সময় স্বীকার্য, অনুকল্প, তত্ত্ব, নীতি প্রভৃতি শব্দগুলোর সাথে প্রায়শই দেখা হবে। তাই এদের অর্থ জেনে নেয়া ভালো।

কোন কিছু দিয়ে কী নির্দেশ করা হয় তা নির্ধারণের জন্য এর সংজ্ঞা বা Definition দেয়া হয়। মূলত একটা শব্দের সংজ্ঞা কীভাবে দেয়া হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করবে সেই শব্দ দিয়ে আমরা কী বোঝাতে চাই। অনেক সময়ই সংজ্ঞা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলে তাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জায়গা থাকে। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রয়োগক্ষেত্রের আলোচনায় সংজ্ঞার গুরুত্বের একটা উদাহরণ আমরা দেখেছি।

স্বীকার্য বা Axiom বা Postulate হলো এমন কোন কথা যা সত্য হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়। স্বীকার্য মূলত স্বতঃসিদ্ধ, একে প্রমাণ করা হয় না। যেমন, যেকোন দুটো স্বাভাবিক সংখ্যা x ও y এর জন্য x=y হলে y=x, এটা একটা স্বীকার্য।

অনুকল্প বা Hypothesis হলো একটি প্রস্তাবিত ব্যাখ্যা। অনুকল্প মূলত কোন গবেষণার ভিত্তি তৈরি করে, যেমনটা আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আলোচনায় দেখেছি।

তত্ত্ব বা Theory হলো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের মাধ্যমে উপনীত হওয়া এমন ব্যাখ্যা যা শর্তাবলী মেনে পুনরায় পরীক্ষা করে যাচাই করা সম্ভব।

যখন কোন ঘটনা পরীক্ষিতভাবে নির্দিষ্ট শর্তের উপস্থিতিতে প্রতিবার পুনরাবৃত্তি হয়, তখন তার বৈজ্ঞানিক আকারে প্রকাশিত রূপকে Law বা সূত্র বলে। যেমন প্রথম অধ্যায়ে বলের আলোচনায় আমরা নিউটনের গতিসূত্রগুলো নিয়ে জানবো।

প্রসঙ্গত, বাংলা ভাষায় সূত্র শব্দটি Mathemetical Formula বোঝাতেও ব্যবহার হয়। যেমন আয়তক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের সূত্র হলো ক্ষেত্রফল = দৈর্ঘ্য × প্রস্থ।

নীতি বা Principle হলো প্রকৃতির অনিবার্য নিয়ম। যেমন শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি অনুযায়ী শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, শুধু রূপান্তর আছে। অনেক সময় নীতি সরাসরি প্রমাণ করা সম্ভব হয় না, পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে উপনীত হওয়া যায়।

শাখাবিন্যাস

বিজ্ঞানের দুটো ধরণ হলো গবেষণামূক বিজ্ঞান (Emperical Science) ও সাধারণ বিজ্ঞান (Formal Science)। সাধারণ বিজ্ঞানের মধ্যে আছে গণিত, যুক্তিবিদ্যা ও পরিসংখ্যান- যা মূলত স্বীকার্য ও সংজ্ঞার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে গবেষণামূলক বিজ্ঞান গবেষণা ও যুক্তিপ্রয়োগনির্ভর।

গবেষণামূলক বিজ্ঞানের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান। সামাজিক বিজ্ঞান মানব আচরণ ও সমাজ নিয়ে কাজ করে, এর মধ্যে পড়ে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান প্রভৃতি। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান কাজ করে প্রাকৃতিক ঘটনাবলী নিয়ে। এর মধ্যে আছে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ভূ-বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি।

আরো জানতে: উইকিপিডিয়া – Branches of science

প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও পাঠ্যবইয়ের অধ্যায়বিন্যাস

বিজ্ঞান বইয়ে আমরা মূলত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়ব। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কয়েকটি শাখা আগের অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা আমাদের সুবিধার জন্য আলোচনার বিষয়গুলোকে বিভাজন করে নিই। তবে প্রকৃতিতে কিন্তু এরকম সূক্ষ্ম বিভাজন থাকে না। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার আলোচনা তাই অন্যান্য শাখার সাথে আন্তঃনির্ভরশীল হয়ে থাকে।

জীববিজ্ঞানে জীবজগৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়। জীব ও জীবন নিয়ে আলোচনার বিজ্ঞানই জীববিজ্ঞান। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন উভয়েই পদার্থ নিয়ে আলোচনা করে। তবে আলোচনার ক্ষেত্র ভিন্ন।

পদার্থবিজ্ঞানে পদার্থ ও শক্তি এবং এদের অন্তঃক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়। পদার্থের বৈশিষ্ট্য (ভর, আয়তন, স্থিতিস্থাপকতা প্রভৃতি), গতি, বল, শক্তি এরকম ব্যাপারগুলো পদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে রসায়নে পদার্থের রাসায়নিক ধর্ম (গলনাঙ্ক, স্ফূটনাঙ্ক, রাসায়নিক সক্রিয়তা প্রভৃতি), উপাদান, অভ্যন্তরীণ গঠন এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া এরকম বিষয়গুলোর আলোচনা হয়ে থাকে।

আমরা নবম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধান বইয়ের অধ্যায়গুলোকে যদি বিন্যস্ত করতে চাই, তাহলে প্রথম তিনটি অধ্যায় পদার্থবিজ্ঞান, চতুর্থ থেকে সপ্তম অধ্যায় রসায়ন এবং অষ্টম থেকে দ্বাদশ অধ্যায়কে জীববিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বলতে পারি। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অধ্যায়কে মূলত ভূ-বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ভূ-বিজ্ঞান হলো পৃথিবী সম্পর্কিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান।

সহায়তা

নবম-দশম শ্রেণি – পদার্থবিজ্ঞান (পূর্বের বই)
ষষ্ঠ শ্রেণি – বিজ্ঞান
ইঞ্জিনিয়ারিং কনসেপ্ট বুক – উদ্ভাস (২০২০ সংস্করণ)
উইকিপিডিয়া

Series Navigation<< নবম শ্রেণি – বিজ্ঞান – নতুন বই পর্যালোচনানবম শ্রেণি – বিজ্ঞান – চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান ও আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *