লিব্রাঅফিস – ফ্রি ও ওপেন সোর্স অফিস সফটওয়্যার

বিগত দীর্ঘ সময় ধরেই অফিস সফটওয়্যারের নিত্যদিনের ব্যবহারে লিব্রাঅফিস ব্যবহার করছি। আমার সাধারণ ব্যবহারের মধ্যে আছে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি, প্রেজেন্টেশন স্লাইড তৈরি প্রভৃতি। আমার ব্যবহারের দিক থেকে লিব্রাঅফিসকে একটি চমৎকার সফটওয়্যার হিসেবে পেয়েছি।

লিব্রাঅফিস একটি পূর্ণাঙ্গ অফিস স্যুট। এই প্যাকেজে মোট ৬টি সফটওয়্যার আছে। ওয়ার্ড প্রসেসর হিসেবে রাইটার (LibreOffice Writer), স্প্রেডশিট প্রোগ্রাম হিসেবে ক্যাল্ক (LibreOffice Calc), প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যার হিসেবে ইমপ্রেস (LibreOffice Impress), ইকুয়েশন ও ফরমুলা এডিটিংয়ের জন্য ম্যাথ (LibreOffice Math), ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্টের জন্য ফ্রন্টএন্ড বেজ (LibreOffice Base) এবং ডায়াগ্রাম, ফ্লোচার্ট প্রভৃতি তৈরির জন্য ড্র (LibreOffice Draw)।

আরেকটি অফিস সফটওয়্যার, WPS অফিস নিয়ে আমরা এর আগে লিখেছি। WPS অফিস ব্যবহারের জন্য ফ্রি, তবে এটি প্রপারইটরী সফটওয়্যার। অন্যদিকে লিব্রাঅফিস লিব্রাঅফিস ফ্রি ও ওপেন সোর্স। লিনাক্স, উইন্ডোজ ও ম্যাকের জন্য লিব্রাঅফিস এভেইলেবল। অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস ও ক্রোমবুকে লিব্রাঅফিস এভেইলেবল নেই, তবে তাদের স্বীকৃত লিব্রাঅফিসভিত্তিক একটি সফটওয়্যার রয়েছে- কোলাবোরা অফিস (Collabora Office)।

লিব্রাঅফিস তৈরি ও পরিচালনা হয় The Document Foundation-এর মাধ্যমে, যা গড়ে তুলেছে OpenOffice.org কমিউনিটিরর সদস্যরা। লিব্রাঅফিস ওপেনঅফিসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, ওপেনঅফিসের সাক্সেসর বলা যায়। পরবর্তীতে ওপেনঅফিসের ডেভেলোপমেন্ট একদমই স্তিমিত হয়ে গেছে, ২০১৪ সালের পর কিছু মাইনর আপডেট ছাড়া মেজর কোন ভার্সন রিলিজ হয়নি, অন্যদিকে লিব্রাঅফিস নিয়মিত উন্নত হয়েছে।

WPS Office, OnlyOffice, FreeOffice, Polaris Office, OfficeSuite সহ অনেক অফিস সফটওয়্যারের মধ্যে মাইক্রোসফট অফিসের বিভিন্ন দিক কমবেশি অনুকরণের সাধারণ একটি প্রবণতা দৃশ্যমান। তবে লিব্রাঅফিস এখানে নিজেকে আলাদা রাখে। ইন্টারফেস ও ব্যবহারবিধিতে মাইক্রোসফট অফিসের সাথে পার্থক্য বেশ চোখে পড়বে, যার কারণে মাইক্রোসফট অফিস ব্যবহারকারীদের জন্য এখানে অভ্যস্থ হওয়া একটু সময়সাপেক্ষ হতে পারে।

পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ও ঠিক যে লিব্রাঅফিস ইউজার ফ্রেন্ডলিনেসের দিক থেকে সেরা নয়। অপশনগুলো আরেকটু সুবিন্যস্ত হতে পারতো মনে করি। মাঝে মাঝে কিছু ব্যাপার বেশ কনফিউজিং, যেমন ফিল হিসেবে কাস্টম গ্র্যাডিয়েন্ট সেটআপ করা যায় সাইডবার থেকে, অথচ প্রিডিফাইন্ড গ্র্যাডিয়েন্টগুলো পাওয়া যায় টুলবার থেকে। স্ট্যান্ডার্ড টুলবার ইন্টারফেসে পেজ বর্ডার অপশন মেনুবার বা টুলবার বা সাইডবার কোথাও সরাসরি নেই, Format মেনু বা রাইট ক্লিক মেনু থেকে Page Style-এ গিয়ে পাওয়া যাবে, যেটা না জানা থাকলে পাওয়া কঠিন। কখনো বেসিক কিছু অপশন পেতে শেষবধি অনলাইন সার্চ করা লেগেছে। অবশ্য ব্যবহারের সাথে এগুলো আয়ত্ত্বে চলে আসে।

লিব্রাঅফিসে কিছু মাইনর বাগ, ল্যাগ এবং কখনো ক্র্যাশও দেখেছি, যদিও সেটা প্রায়সই হয়, বা আনইউজেবল বানিয়ে ফেলে এমন কিছু না। ইন কেস কোন সমস্যা হলে অটোরিকোভারি ফিচার আছে। তবে উইন্ডোজ থেকে লিনাক্সে লিব্রাঅফিস বেশি অপ্টিমাইজড ও স্ট্যাবল, অন্তত আমার অভিজ্ঞতায়। উইন্ডোজ ১১-তে বিশেষ করে প্রোপারলি অপটিমাইজড না এরকম একটা ব্যাপার মনে হয়েছে।

অবশ্য এটার কারণ আছে, অনেক লিনাক্স ডিস্ট্রোতে এটা প্রিইনক্লুডেড এবং লিনাক্স ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশ লিব্রাঅফিস ব্যবহার করে থাকে। সে তুলনায় উইন্ডোজে ব্যবহারকারী, বাগ রিপোর্ট আনুপাতিক হারে হয়ত কম-ই হবে।

লিব্রাঅফিসের ন্যাটিভলি ODF (ওপেন ডকুমেন্ট ফরমেট- .odt, .ods, .odp,…) ফাইল ফরমেট ব্যবহার করে। মাইক্রোসফট অফিসের OOXML (.docx, .xlsx, .pptx,…) ও অন্যান্য জনপ্রিয় ফর্মেটগুলো সমর্থন রয়েছে, তবে OOXML ফর্মেট কম্প্যাটিবিলিটিতে OnlyOffice, FreeOffice বা WPS Office এগিয়ে থাকবে। মাইক্রোসফট অফিসে তৈরি অনেক ফাইল লিব্রাঅফিস ভালোমতই প্রদর্শন করবে, তবে কিছু জায়গায় গিয়ে ওলটপালট করে ফেলতে পারে।

তবে সামগ্রিকভাবে ফাইল ফরমেট সমর্থনে লিব্রাঅফিস মাইক্রোসফট অফিসকে ছাড়িয়ে যায়। এখানে EPUB, MediaWiki (উইকিপিডিয়া ফরমেট), XHTML, EPS প্রভৃতি ফর্মেটে সরাসরি এক্সপোর্ট করা যায়। বিভিন্ন লিগ্যাসি ফরমেট ইমপোর্ট ও এক্সপোর্ট সমর্থন রয়েছে, যা মাইক্রোসফট অফিস অফার করে না।

বাংলা ভাষার সাথে লিব্রাঅফিস খুব ভালোভাবে কাজ করে। ইউনিকোড বা আনসি উভয়টিতে বাংলা লেখা যায়। মেজর ডেস্কটপ অফিস সফটওয়্যারগুলোর মধ্যে মাইক্রোসফট অফিস ছাড়া আর কোনটিতেই মূলত এতটা বেটার সাপোর্ট পাইনি।

লিব্রাঅফিসের ইন্টারফেস খুবই কাস্টমাইজেবল। এটা বাই ডিফল্ট স্ট্যান্ডার্ড টুলবার ইন্টারফেস ব্যবহার করে। মেনুবার, টুলবার ও সাইডবারের সমন্বয়ে ক্লাসিক লুক। যদি মাইক্রোসফট অফিসের মত রিবন লেআউট পছন্দ হয়, তাহলে ট্যাবড ইন্টারফেস ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। অবশ্য এটা মাইক্রোসফট অফিসের রিবনের পুরোপুরি অনুরূপ না, এখানেও অনেক ক্ষেত্রে সাইডবার নির্ভরতা থাকে।

উইন্ডোজে লিব্রাঅফিস বেশ সাদামাটা দেখায়। তবে লিনাক্সে লিব্রাঅফিস সিস্টেম থিমকে অনুসরণ করে, তাই এর লুক সিস্টেম কাস্টমাইজেশনের ওপর নির্ভর করে। বেশকিছু চমৎকার আইকন থিম রয়েছে এখানে। হেডার ও ফুটার এরিয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ৬টি প্র-ইনক্লুডেড থিম আছে। আগে ফায়ারফক্স থিম ব্যবহার করা যেত, ফায়ারফক্স API-তে পরিবর্তন আনার কারণে বর্তমানে এটা সম্ভব নয়।

বেসিক থেকে এডভান্সড পর্যন্ত অফিস সফটওয়্যার থেকে দরকারী ফিচারগুলো লিব্রাঅফিসে আছে। তবে মাইক্রোসফট অফিসসহ অন্যান্য অফিস সফটওয়্যারগুলোর সব ফিচার-ই যে এখানে থাকবে, বা থাকলে একইভাবে থাকবে- এরকম নয়। লিব্রাঅফিস ও মাইক্রোসফট অফিসের ডিটেইলড ফিচার কম্পারিজন দেখে নিতে পারেন এখানে। লিব্রাঅফিসে ক্লাউড সার্ভিস ইন্টিগ্রেশন ও অনলাইন কোলাবোরেশন ফিচার নেই।

রাইটার, ক্যাল্ক ও ইমপ্রেস নিয়ে আলাদাভাবে তেমন কিছু বলার নেই, নিজ নিজ কাজে বেশ ভালোমানের কিছু সফটওয়্যার। লিব্রাঅফিস ম্যাথ ইকুয়েশন ও ফর্মুলা লেখার জন্য। হ্যা, ফর্মুলা এডিটিংয়ের জন্য এখানে একটা পৃথক অ্যাপ আছে। পাশাপাশি রাইটার, ক্যাল্ক ও ইমপ্রেসেও ফর্মুলা এডিটর হিসেবে এটা ইন্টিগ্রেটেড।

লিব্রাঅফিস ড্র ফ্লোচার্ট, ডায়াগ্রাম প্রভৃতি ভেক্টর নিয়ে কাজ করার জন্য। এতে কিছুমাত্রায় পাবলিশিংয়ের কাজ করা যায় সম্ভবত। তবে এটার ইউসেজ নিয়ে একচুয়ালি খুব একটা আইডিয়া আমার নেই।

লিব্রেঅফিস বেজ ডাটাবেজ তৈরি ছাড়াও MySQL, Firebird, dBase এর ফ্রন্টএন্ড হিসেবে ব্যবহারযোগ্য।

সবশেষে, লিব্রাঅফিস সবচেয়ে ইউজার ফ্রেন্ডলি ও সবচেয়ে স্ট্যাবল নয়, তবে আমার দীর্ঘ ব্যবহারের অভিজ্ঞতায় কাজের জন্য এটাকে একটা চমৎকার সফটওয়্যার হিসেবে পেয়েছি। পূর্ণাঙ্গ একটি ফ্রি ও ওপেন সোর্স অফিস সফটওয়্যার অনুসন্ধান করলে লিব্রাঅফিস ট্রাই করে দেখতেই পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *