একটা সময়ে শাওমি নামটাই যেন ছিলো সর্বোচ্চ ভ্যালু ফর মানির প্রতীক। লো বাজেটে মেটাল বডি, স্ন্যাপড্রাগন চিপসেটসহ আকর্ষণীয় ফিচার নিয়ে মানুষের মনে একটা অন্যরকম জায়গা করে নিয়েছিলো শাওমি। তবে মার্কেট এখন অনেক কম্পিটিটিভ, প্রতিটা ব্র্যান্ডই গ্রাহকদের মন জয় করার চেষ্টা করে চলেছে, আর এই সময়ে এসে বিশেষ করে বাংলাদেশের বাজারে সম্ভবত শাওমি কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে।

অন্য জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর অনেকেই এখন বাংলাদেশে ফ্যাক্টরী স্থাপন করায় কম দামের মধ্যে পণ্য দিতে সক্ষম হচ্ছে। তবে শাওমি এখনও তার পরিবর্তে প্রায় ৬০% ট্যাক্স বহন করে যাওয়া অব্যহত রেখেছে, যা স্বাভাবিকভাবেই যাচ্ছে ক্রেতাদের পকেট থেকে। চীন বা ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে এসে তাদের পণ্যগুলো বেশ দামি হয়ে যাচ্ছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে সেটা অস্বাভাবিক রকমের ওভারপ্রাইসড।

এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো Redmi 9C, যার 2/32 এডিশনের দাম ১১০০০ টাকা এবং 3/64 এডিশন ১২৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিছুদিন আগে Redmi 9A ১০০০০ টাকায় রিলিজ হয়েছিলো Helio G25 চিপসেট নিয়ে। এখানে তার সাথে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর, দুইটা বাড়তি ক্যামেরা লেন্স (পরে আসছি), আর কিছুটা উন্নত চিপসেট দেওয়া হয়েছে।

এর ডিজাইন বেশ সিম্পল। ব্যাকপার্টে একটা প্যাটার্ন রয়েছে, আর পুরোটা এক কালার। যারা সিমপ্লিসিটি পছন্দ করেন তাদের ভালো লাগবে আশা করি, আমার বেশ সুন্দর লেগেছে। রিয়েলমিসহ অন্য কিছু ব্র্যান্ডও এখন লো বাজেটে আইফোনের মত ক্যামেরা মডিউল দিচ্ছে, তবে Redmi 9C এর মডিউলটি আমার তুলনামূলক বেশ ভালো লেগেছে। সব মিলিয়ে ডিজাইন আমার বেশ চমৎকার লেগেছে।

এটি একটি প্লাস্টিক বিল্ড ডিভাইস, এখন আর লো বাজেটে শাওমি মেটাল বডি দেয় না। অবশ্য মেটাল বডির ফোন এখন কোন বাজেটেই দেখা যায় না, লো বাজেট, মিড বাজেট এমনকি ফ্ল্যাগশিপেও প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি। বড়জোড় মেটাল ফ্রেম আর গ্লাস ব্যাক দেখা যায়। ফোনটি পাওয়া যাচ্ছে তিনটি কালারে Sunrise Orange, Midnight Grey ও Twilight Blue।

এখানে দেওয়া হয়েছে 6.53” ডিসপ্লে, যা একটি IPS প্যানেল এবং রেজ্যুলেশন HD+। কিছুদিন আগেও এটা হিউজ ডিসপ্লে হিসেবে গণ্য হলেও বর্তমানে 6.5″ ডিসপ্লে এত বেশি যে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। তো, এই ডিসপ্লে নিয়ে বিশেষ কিছু আসলে বলার নেই।

Redmi 9C-তে যে স্লোগান যুক্ত করা হয়েছে তা হলো তিন ক্যামেরার চ্যাম্পিয়ন। তো এখানে রেয়ারে তিনটা ক্যামেরা তো আছে, কিন্তু তার একটা হলো 2MP ডেপথ আর 2MP ম্যাক্রো। মানে কাজে দিবে আদতে একটা লেন্সই, 13MP, সেটাও আবার f/2.2। আর সামনের ক্যামেরাটি 5MP। তো তিনটি ক্যামেরা দেখে এই ক্যামেরা নেওয়াটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে সেটার ব্যাখ্যা বোধ করছি নিষ্প্রয়োজন।

এই ফোনের অসাধারণ একটি ফিচার হলো র‍্যাম-রম। ১১০০০ টাকায় শুধু এই ডিভাইসেই আপনি ২ জিবি র‍্যাম পাবেন, বাকিরা ৩ কিংবা ৪ জিবি দেয়… সাথে ইনবিল্ট স্টোরেজ আছে ৩২ জিবি। ১২৫০০ টাকায় গেলে অবশ্যি ৩ জিবি র‍্যাম আর ৬৪ জিবি ইনবিল্ট স্টোরেজ ৬৪ জিবি অপশন আছে, কিন্তু সেটাও সে দামকে জাস্টিফাই করে বলে বোধ হয় না।

Redmi 9C-তে চিপসেট হিসেবে দেওয়া হয়েছে Helio G35। নামে G দেখে খুশি হওয়ার দরকার নেই, এটা আসলে Helio P35 এর রিব্র্যান্ড। হারিকেন দিয়ে খুঁজে যে পার্থক্যটা পেয়েছি, তা হলো নাম আর CPU ইন্সট্রাকশন সেট G35 এ ARMv8-A থেকে ARMv8.2-A তে আপডেট করা হয়েছে। মিডিয়াটেকের ভাষ্যমতে এখানে HyperEngine টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে, যা ইনহেন্সড পারফর্মেন্স দিবে।

যাহোক, P35 এর মতই এখানে থাকছে ৮টি Cortex-A53@2.3GHz Max, সাথে GPU PowerVR8320@680GHz। এটি 12nm আর্কিটেকচারে তৈরি। এটা তত একটা পাওয়ারফুল না হলেও আর সব ফিচার ভালো থাকলে ১১ হাজারে এই চিপসেট আমি মেনে নিতে পারতাম, কেননা Realme C3-এর মত Helio G70 এই দামে একটা বোনাস ছিলো, G35-থাকাটাই এই দামে স্বাভাবিক বলে আমি মনে করি।

তারপর আসে ব্যাটারী। এখানে 5000 mAh এর ব্যাটারী দেওয়া আছে, এখনকার হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড। পূর্ণ চার্জে সাধারণ ব্যবহারকারীরা দেড়-দুইদিন চালিয়ে যেতে পারবেন বলে আশা করা যায়। 10W পর্যন্ত চার্জিং সমর্থন করে এবং বক্সের চার্জারটিও 10W। পূর্ণ চার্জ দিতে ঘন্টা তিনেক লাগতে পারে।

Redmi 9C ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর দেওয়া হয়েছে, যেটা Redmi 9A-তে ছিলো না। সাথে AI Face Unlock সুবিধাও থাকছে। থাকছে 3.5mm ইয়ারফোন পোর্ট। ফোনটির ওজন দুশো গ্রামের কাছাকাছি, 196g। থিকনেসও একটু বেশি 9.0mm।

সফটওয়্যার সেকশনে এখানে থাকছে Android 10 বেজড MIUI 12। এন্ট্রি লেভেলে আমি কাস্টম ইউআই থেকে স্টক ইউআই প্রিফার করি, কেননা এমনিতেই রিসোর্স লিমিটেড, ইউআই যদি আরো খানিকটা খেয়ে নেয়, তাহলে পারফর্মেন্স আরো কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সেন্সর সেকশনের কথা তো প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম! না, এখানেও জাইরোস্কোপ অথবা কম্পাস সেন্সর দুটির কোনটি নেই। আর না, শাওমির সিগনেচার ফিচার IR Blaster ও নেই। শুধু লাইট সেন্সর, একসেলেরোমিটার, তার সাথে ডিস্টেন্স সেন্সর আছে।

তো, সবশেষে আমার মন্তব্য কি এই ফোন নিয়ে? এটা কি ওভারপ্রাইসড? আমি বলবো, না। এটা হলো ওভারপ্রাইসড ২.০। এটা কি কারো জন্য সাজেস্ট করা যায়? আমি বলবো, হ্যাঁ, যদি আপনার অরেঞ্জ কালার খুব বেশি পছন্দ হয়, ফোনটা দেখতে পারেন, এই কালারের ফোন খুব একটা দেখা যায় না 🤨 আপাতত আর কোন কারণ খুঁজে পাইনি।

অল্টারনেটিভ

আমি সবসময়ই মোবাইল নিয়ে আমার লেখাগুলোতে কম্পারিজন রাখার চেষ্টা করি, কেননা ডিসিশন মেকিংয়ের ক্ষেত্রে এটা আমার মনে হয় বেশি হেল্পফুল। তবে আজকে তার পরিবর্তে অল্টারনেটিভ সেকশন রাখছি, কেননা ১১০০০ টাকার আশেপাশের ফোনগুলোর সাথে কম্পারিজনের তুলনায় ১০০০০ এর নিচে এর অল্টারনেটিভগুলো তুলে ধরাই বেশি যৌক্তিক মনে হলো।

Redmi 9C-এর অল্টারনেটিভ হিসেবে শাওমির বড় প্রতিপক্ষ রিয়েলমির পক্ষ থেকে Realme C11 হতে পারে ৯০০০ টাকায় একটি ভালো অপশন। কেননা, ব্র্যান্ড ভ্যালুর দিক দিয়ে শাওমি, রিয়েলমি সমপর্যায়ের। এখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর, আর 2MP-র ম্যাক্রো লেন্স বাদে আর সব একইরকম প্রায়।

অন্যদিকে দেশীয় ব্র্যান্ড সিম্ফনি ১০ হাজার বাজেটে এখন বেশ ভালো অবস্থানেই মনে হচ্ছে। ৮৪০০ টাকায় তাদের Symphony Z16 ডিভাইসটিতে ব্যাটারী 1000 mAh কম এবং চিপসেট Helio A25 (4xCortex A53@1.8GHz+4xCortex A53@1.5GHz, PowerVR8320@600MHz) এই বিষয়গুলো বাদে খুব ভালো একটি অপশন হতে পারে। এখানেও তিনটি ক্যামেরা, তবে 2MP ম্যাক্রো লেন্সের বদলে রয়েছে একটি 5MP আল্ট্রাওয়াইড লেন্স। এই ফোনটি ক্যামেরা সেকশনে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। আর এর ম্যাট ফিনিশের জন্য দেখতেও সুন্দর।

তাছাড়া ৯০০০ টাকায় Symphony Z28-এ একই ফিচারের পাশাপাশি 3GB র‍্যাম অফার করা হয়েছে। সেলফি ক্যামেরা 8MP। তবে এর ব্যাকপার্টে থাকছে গ্লসি ফিনিশ, যেখানে আঙুলের ছাপ পড়ে। আরেকটু বাড়ালে ৯৮০০ টাকায় Z30 ডিভাইসটিতে 5000 mAh ব্যাটারী থাকছে। এর ব্যাকপার্ট প্লাস্টিক হলেও দেখতে গ্লাসের মত এবং আলোর রিফ্লেকশনে রঙের খেলা চলে যা এন্ট্রি লেভেল বাজেটে আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর ডিভাইস।

আরেকটি ফোনের কথা মেনশন না করলেই নয়, Infinix Hot 9 Play। ১০০০০ টাকায় এই ফোনটি Helio A25 চিপসেটের সাথে অফার করছে 6.82″ ডিসপ্লে, 4/64 আর 6000 mAh এর হিউজ ব্যাটারী। তবে ক্যামেরা কোয়ালটিতে সম্ভবত এটা সিম্ফনির ফোনগুলো থেকে পিছিয়ে থাকবে। এছাড়া UI-তে বিজ্ঞাপনও রয়েছে।

Itel Vision 1 Plus-ও একটি অপশন হতে পারে ৮৫০০ টাকায় ২/৩২ ও ৯৫০০ টাকায় ৩/৩২ ভার্সন, ব্যাটারী 5000 mAh এবং চিপসেট Unisoc SC9863A(4xCortex A55@1.6GHz+4xCortex A55@1.2GHz, PowerVR8322)। এখানেও আইফোন স্টাইল ক্যামেরা বাম্প রয়েছে, থাকছে ম্যাট ফিনিশ। যদিও বাকি ফোনগুলোর থেকে এটি কম ইমপ্রেসিভ মনে হয়েছে।

এরপর ওয়ালটনের দুটো ফোন মেনশন করতে চাই, Primo HM5 (3/64, ৮৬০০ টাকা) ও Primo H9 Pro (4/64, ৯৫০০ টাকা)। অল্প দামে বেশি র‍্যাম-রম চাইলে দেখতে পারেন, যদিও এদের চিপসেট বেশ উইক Helio A20 (4xCortex A53@1.8GHz, PowerVR8300@550MHz) আর ডিসপ্লে 6.1″। এছাড়া এদের ক্যামেরা অন্যান্য দিকে ঠিক থাকলেও পোর্ট্রেট মোড একদমই চলনসই নয়। H9 Pro তে 5MP আল্ট্রাওয়াইড লেন্স দেওয়া হয়েছে।

যাদের কাছে ব্র্যান্ড ভ্যালু বেশি গুরুত্ব রাখে, তারা Samsung Galaxy A01 দেখতে পারেন, যদিও পার্সোনালি এটা আমার একদমই ভালো লাগেনি। ১০০০০ টাকায় 5.7″ TFT ডিসপ্লে, 2/16, SD439 (8xCortexA53@2.0GHz Max, Adreno 505@450MHz) দেওয়া হয়েছে এখানে। এখানে র‍্যাম LPDDR3, যার ফ্রিকোয়েন্সি অনেক কম। ব্যাটারী মাত্র 3000 mAh। ম্যাক্রো লেন্স বাদে ক্যামেরা সেটআপ Redmi 9C-এর মতই।

তথ্য ও ছবি সোর্স

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *