কী হবে যদি সাপ না থাকে? যে দেশগুলোতে সাপ নেই…

সাপ, অনেকের কাছেই এ যেন এক জ্বলজ্যান্ত আতঙ্কের নাম। কোমল ত্বক, খন্ডিত জিহ্বা, জ্বলজ্বলে চোখ আর বিষাক্ত বিষের অধিকারী এই প্রাণী স্নায়ুতে যে শিহরণ বইয়ে দেয়, অন্য কোন প্রাণীর সাথে তার তুলনা চলে না। সাপের প্রতি এই আতঙ্ক অমূলক নয়, কারণ সাপের প্রজাতিগুলোর একটি বড় অংশ বিষধর, যে বিষ হতে পারে আপনার মৃত্যুর কারণ, এবং এমনকি কোন সাপ আপনাকে গিলে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে সাপের ভীতি যদি অস্বাভাবিক রূপ নেয়, হয়ত আপনি উঠতে, বসতে, ঘুমাতে কিংবা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও যদি সাপের ভয় আপনাকে তাড়া করে বেড়ায়, তবে তা ফোবিয়াতে রূপ নেয়, যাকে বলে ophidiophobia।

আরো দেখুন: কয়েকটি মজার ফোবিয়া: আপনার কোনগুলো আছে?

সাপের কথা বললে সাপের ভয় কিংবা আতঙ্কের কথা যখন সবার আগে চলে আসে, তখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কী হত, যদি সাপ না থাকতো? আপনি যদি বাস্তুতন্ত্রের ধারণা রাখেন, তাহলে একটা কথা আপনি হয়ত অনুমান করতে পারছেন, এটার পরিণতি খুব ভালো হবে না। কিন্তু কয়েকটি দেশ কিন্তু আছে যেখানে সত্যিই সাপ নেই! যেমন সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হিসেবে বলতে পারেন আয়ারল্যান্ডের কথা, এবং আসলে আরো কয়েকটি দেশ- নিউজিল্যান্ড, আইসল্যান্ড, হাওয়াই, গ্রিনল্যান্ডেও ন্যাটিভ কোন সাপ পাওয়া যায় না। এছাড়া বলতে পারেন এন্টার্কটিকার কথা, যেখানে সাপ নেই।

কিংবদন্তী অনুযায়ী সেন্ট প্যাট্রিক আয়ারল্যান্ড থেকে সাপ দূর করেছিলেন, যেটার আসলে কোন বাস্তবতা নেই। প্রকৃতপক্ষে, আয়ারল্যান্ডের জলবায়ু, বিশেষ করে বরফ যুগের জন্য কোনকালেই এখানে সাপ ছিলো না, এবং সাপ না থাকা অন্য দেশগুলোর কারণটাও মোটামুটি একই ধরণের।

আসলে সাপ শীতল রক্তের প্রাণী, অর্থাৎ, পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে রক্তের তাপমাত্রা ওঠানামা করে। তাই সবরকম পরিবেশে সাপ থাকতে পারে না। বাংলাদেশেও যখন শীতকাল আসে, তখন সাপেরা কিন্তু তাদের গর্তে শীতনিদ্রায় যায়, তাই শীতকালে খুব বেশি সাপ দেখা যায় না। আপনি যখন মানচিত্রে সাপের আবাসভূমি দেখবেন, তখন বিষয়টা পরিষ্কার হবে।

ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস | পাবলিক ডোমেইন

যাইহোক, যে দেশগুলোতে সাপ নেই, সেখানেও সবকিছু কিন্তু একটা ভারসাম্যের মধ্যেই আছে এবং এভাবেই যুগের পর যুগ চলছে। তাহলে অন্য দেশগুলো থেকে যদি সাপ নামক আতঙ্ককে দূর করা যায়, তাহলে়ও কী সব ঠিক থাকবে? উত্তর হলো: না। অনেকগুলো কারণ আছে, অন্য দেশগুলোর খাদ্যশৃঙ্খল ওভাবেই গড়ে উঠেছে, তাই আপনি যদি ophidiophobia-কে দূর করতে চান, তাহলে musophobia অনেক বেড়ে যাবে।

আরো দেখুন: কুয়োকাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী প্রাণী, কিন্তু আসলেই কি?

Ophidiophobia তো আগেই বলা হলো, সাপের ফোবিয়া, আর musophobia হলো ইঁদুর নিয়ে ফোবিয়া। সাপের খাদ্যতালিকায় ইঁদুর যেহেতু অন্যতম, কাজেই সাপ না থাকল ইঁদুরের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে, কেননা ইঁদুরের বংশবৃদ্ধি কিন্তু খুব দ্রুত হয়। আবার সাপও আছে কিছু প্রাণীর শিকারের তালিকায়, যাদের কয়েকটি আমাদের আশেপাশেই থাকে, এর মধ্যে আছে বিড়াল, বেজি, কয়োটি এমনকি বড় সাপও কখনো ছোট সাপকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। আর অনেকের জন্য অস্বস্তিকর হলেও মানুষের মধ্যেও কারো কারো কাছে সাপ ও সাপের ডিম জনপ্রিয় খাবার।

সাপের প্রয়োজনীয়তা কিন্তু বাস্তুতন্ত্র বা খাদ্যশৃঙ্খলের ভারসাম্য রক্ষাতেই শেষ নয়, আমরা জানি সাপ এবং অন্যান্য বিষধর প্রাণীগুলোর বিষ বিভিন্ন রোগের ওষুধের তৈরিতে দরকার হয়। ডায়াবেটিস, হৃদরোগের ওষুধ আসে সাপের বিষয় থেকে; অটোইমিউন রোগ, ক্যান্সার, ব্যাথার ওষুধেও রয়েছে এর ব্যবহার।

কাজেই বড় আকারে যদি সাপের সংখ্যা কোনভাবে কমানো হয় বা কমে যায়, তাহলে পরিণতি খুব ভালো হবে না। এমনকি বিভিন্ন সময়ে, যখন কোন সমস্যার সমাধানে মানুষ কতৃক কোন প্রাণী ব্যাপকহারে নিধন করা হয়েছে, তার ফলশ্রুতিতে বেশ বড় রকম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার উদাহরণ আছে।

ফেসবুকে যুক্ত হোন নিয়নবাতির সাথে

সাপ নিধনের একটা উদাহরণ এক্ষেত্রে দেয়া যেতে পারে, যদিও ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে পারছি না, এটা ছোটবেলায় কেনা অংক বিষয়ক একটা অনুবাদ বই, “অংক নিয়ে মজার খেলা ও ধাঁধা”-তে উল্লেখ ছিলো, তবে অনলাইনে সার্চ করে এরকম কিছু পাইনি। যাইহোক, জ্যামাইকা-তে প্রচুর বিষধর সাপ থাকায় তাদের ধ্বংস করার জন্য কেরানি পাখি (secretary bird) আনা হয়। কেরানি পাখি আফ্রিকার এন্ডেমিক (অর্থাৎ শুধু আফ্রিকাতেই পাওয়া যায়) একটি শক্তিশালী সাপ-শিকারী পাখি। ফলশ্রতিতে সাপের সংখ্যা কমে যায় ঠিকই, কিন্তু ফসল ধ্বংসকারী মেঠো ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে এবং আখখেতগুলোতে তারা ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এমন অবস্থায় চারজোড়া ভারতীয় বেজি আনা হয় এবং এদের অবাধে বংশবৃদ্ধি করতে দেয়া হয়, যার ফলে অল্পকালেই দ্বীপটি বেজিতে পূর্ণ হয়ে যায়। বছর দশেকের মধ্যে এই বেজিগুলো প্রায় সমস্ত ইঁদুর ধ্বংস করে ফেলে, এবংএরপর তারা মানবশিশু, কুকুরছানা, শুয়োরছানা, মুরগিছানাদের আক্রমণ করতে থাকে এবং ডিম ধ্বংস করতে থাকে। বেজিগুলো সংখ্যায় আরো বেড়ে আখের খেত, গমের খেত, ফুলের বাগান সবখানে ছেয়ে যায়। কাজেই জ্যামাইকার দীপবাসীদের এবার এদের রুখে দাঁড়াতে হয়, তবে প্রকৃতপক্ষে এই ক্ষতি রোধে তারা শুধু আংশিক সাফল্য অর্জন করতে পারে।

সত্যতা নিয়ে নিশ্চয়তা না পেলেও বাস্তবে আসলে এরকমটা খুবই সম্ভব। কাজেই বিষধর সাপ থেকে সাবধান থাকা, লোকালয়ে সাপের আগমন থেকে সতর্ক থাকা ও সাপের শিকারে যেন পরিণত হতে না হয় সেজন্য সতর্কতামূলক পদক্ষেপ রাখা এবং ক্ষতি করার সম্ভাবনা থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া অবশ্যই জরুরী, তবে সম্পূর্ণরূপে বা বড় আকারে সাপ কিংবা অন্য কোন প্রাণী নির্মুল করার চিন্তা করলে তার পরিণতি ভালো না হওয়ার সম্ভাবনাই যথেষ্ট বেশি।

সহায়তা
কৃতজ্ঞতা: মোশাররফ হোসেন ভাই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *