অর্থ-সম্পদ-ক্ষমতা-প্রভাব-প্রতিপত্তির পেছনে নিরন্তর ছুটে চলি আমরা, কেন ছুটে চলি জানি না, শুধু একসময় মৃত্যু এসে আমাদের থামিয়ে দেয়, আর জীবনের অর্জনগুলো পড়ে থাকে পেছনেই। আমাদের জীবনে কিছু হওয়ার ইচ্ছা থাকে, যেমন শিক্ষক, গবেষক, ব্যবসায়ী, ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে চাওয়া। এটাকেই আমরা জীবনের লক্ষ্য বলে থাকি।
কিন্তু লক্ষ্য কথাটা মনে হয় শুধু কর্মজীবনে নির্দিষ্ট কিছুকে সামনে রাখার থেকে আরেকটু বড় অর্থ বহন করে। মানুষ আর সব প্রাণীর মত নয়। মানুষের সূক্ষ্মতর চিন্তাধারা আছে, আছে জটিল অনুভূতি, আছে ভালো-মন্দের বোধ আর এমন বুদ্ধিমত্তা যার সাথে আর কোন প্রাণীর তুলনা চলে না। আর তাই একটা সুন্দর লক্ষ্য বোধহয় জীবনের থাকা উচিৎ। এবং আমাদের ক্যারিয়ার ও সম্পদ হতে পারে এই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম।
একটা সুন্দর গঠনমূলক জীবনের জন্য উত্তম একটা লক্ষ্য খুবই প্রয়োজন। শুধু খাদ্য গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো, খেল-তামাশা ও তার আয়োজনের ব্যবস্থাটুকু করে জীবন কাটিয়ে দেয়া বড় আফসোসের বিষয়। আবারো, এই লক্ষ্য বলতে ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন নয়, বরং সেই ক্যারিয়ার অর্জন করতে চাওয়ার পেছনের প্রেরণা।
একটা উদাহরণ দিই, ‘জীবনের লক্ষ্য রচনায় আমরা অনেকেই লিখতাম কীভাবে শিক্ষক হয়ে নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ, চিকিৎসক হয়ে গ্রামের সামর্থ্যহীনদের বিনামূল্যে সেবা প্রদান কিংবা গবেষক হয়ে সমাজ ও মানুষের সেবার্থে কাজ কিংবা আইনের লোক হয়ে দুর্নীতিকে দমন করব। কিন্তু দিনশেষে বহুজনের শিক্ষক, চিকিৎসক বা গবেষক হওয়া হলেও পরের অংশটুকু আর হয়ে ওঠে না, বরং নিজ অবস্থান থেকে সম্পদ অর্জন কিংবা ক্ষমতা প্রদর্শনেই তারা মনোযোগী হয়ে ওঠে- যেখানে তারা অনৈতিক কিংবা অমানবিক পন্থায় যেতেও দ্বিধা করে না। আর শেষ পর্যন্ত এভাবে তাদের অর্জনের সামান্য-ই তারা উপভোগ করতে পারে, যার আগে বার্ধক্যের অক্ষমতা কিংবা মৃত্যু তাদের সামনে চলে আসে।
এর কারণ কী? কারণ এই যে একটা ক্যারিয়ার পর্যন্ত পৌঁছানো, এটাকেই আমরা চূড়ান্ত লক্ষ্য করে নিয়েছি। পরের অংশটুকু শুধু রচনার সৌন্দর্য্যবর্ধনের অংশ। আমাদের মোটিভেশন হলো এই ক্যারিয়ার পর্যন্ত পৌঁছালে অর্থ-সম্পদ কিছুর অভাব হবে না- আর যদি সে পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারি, তাহলে জীবন বৃথা, এই জীবনের আর কোন অর্থ নেই।
অথচ এমনটা না হয়ে যদি পরের অংশটুকুতে আমাদের দৃষ্টি রাখতে পারতাম- অর্থাৎ মানুষের সেবা করা কিংবা সমাজে ন্যায়ের প্রচেষ্টা কিংবা অন্য উত্তম কিছু করা আর ক্যারিয়ারকে মনে করতাম তার একটি মাধ্যম, তাহলে আমাদের পছন্দের ক্যারিয়ারে যেতে পারি বা না পারি এই উত্তম কিছুর জন্য কাজ করতে পারতাম। জীবনের একটা সত্যিকারের লক্ষ্য থাকতো।
আমাদের লক্ষ্যের দুটো অংশ থাকতে পারে- ইহকালীন ও পরকালীন। আসলে এই দুটো অংশ পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, কেননা আমাদের পরকালীন পরিণতি নির্ভর করে পৃথিবীতে আমাদের কর্মের ওপর।
একজন মুসলিমের জন্য, জীবনের লক্ষ্য হলো ঈমান এবং উত্তম কর্মের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন করা। এই উত্তম কর্মের মধ্যে আছে স্রষ্টার ইবাদত এবং তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সৃষ্টির কল্যাণের জন্য কাজ করা। আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ হওয়া উচিৎ এই বিষয়টি সামনে রেখে। আমাদের দ্বারা যেন মানবজাতি ও সৃষ্টিকূলের জন্য কল্যাণকর কিছু হয়।
পেশাগত লক্ষ্যের পেছনে যদি সুন্দর কোন চিন্তা না থাকে, তাহলে এই লক্ষ্য পূরণ থেকে কল্যাণকর কিছু আশা করা কঠিন হয়ে যায়। আবার যদি কোন সুন্দর চিন্তাধারা নিয়ে কাজ করা হয়, পেশাগত লক্ষ্য পূরণ না হলেও হতাশার কিছু থাকে না, বরং নিজের জায়গা থেকে স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা যায়। আর সে স্বপ্নও যদি বাস্তব না হয়, তবু এই সাধনা অবান্তর নয়, কারণ এই পৃথিবীর পরেও আরেকটি জগৎ আছে, যেখানে আমাদের প্রতিটি কর্মের প্রতিফল আমরা পাবো।
এই স্বপ্ন অনেকরকম হতে পারে পারিপার্শ্বিক প্রয়োজন, নিজের চাওয়া আর সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। কারো স্বপ্ন অনেক বড় হতে পারে- সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা পৃথিবীকে বদলে দিতে চাওয়ার মত। কারো স্বপ্ন হতে পারে অন্তত কিছু সৃষ্টির উপকার করা, হতে পারে অসহায় মানুষদের কিংবা হতে পারে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ক্ষুধার্থ কিংবা আহত প্রাণীগুলোর। কারো স্বপ্ন হতে পারে কোন মন্দ কিছুকে প্রতিহত করা অথবা কোন উত্তম কিছুকে প্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু স্বপ্ন থাকা উচিৎ, লক্ষ্যের পেছনে লক্ষ্য থাকা উচিৎ, নিরুদ্দেশ কোন কিছুর পেছনে ছুটে চলার থেকে বড় কোন প্রেরণা মানব জীবনে মানব জীবনে থাকা উচিৎ।