মমির কথা চিন্তা করলেই মনে আসে কত সহস্র বছর অতীতের মিশরের কথা। কেমন লাগবে যদি বলি একুশ শতকে এসেও এমন কিছু হচ্ছে যা যেন ঠিক মমিরই এক আধুনিক সংস্করণ? ক্রায়োনিক্সকে একুশ শতকের মমি বলাটা সম্ভবত ভুল হবে না, অথবা তার আধুনিক সংস্করণ।

ক্রায়োনিক্স কী?

ক্রায়োনিক্স এমন এক প্রযুক্তি যেখানে মৃত্যুর পর মানবদেহ কিংবা বিচ্ছিন্ন মস্তককে সংরক্ষণ করা হয় অতি নিম্ন তাপমাত্রায় এই আশার সাথে যে হয়ত ভবিষ্যতের প্রযুক্তিতে তাদের পুনরায় জীবিত করে তোলা সম্ভব হবে। একুশ শতকে এসে এমন কিছু, অদ্ভুত, সন্দেহ কী!

এক্ষেত্রে −130° সেলসিয়াসের নিম্ন তাপমাত্রায়, সাধারণত -196° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনে মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হয়। এই অতি নিম্ন তাপমাত্রায় দেহের পঁচন ঘটে না, ফলে বহুদিন ধরে লাশ অবিকৃত থাকে। একে বলা হয় ক্রায়োসংরক্ষণ বা ক্রায়োপ্রিজারভেশন।

ক্রায়োজেনিক সাসপেনশন

মৃত মানুষকে জীবিত করে তোলা কিন্তু ক্রায়োনিক্সের মূল কথা না। এখানে উদ্দেশ্য হলো দেহ যে পর্যায়ে আছে সেভাবে স্থগিত রেখে দেওয়া। একারণে ক্রায়োপ্রিজাভেশনের পরিবর্তে অনেক সময় ক্রায়োজেনিক সাসপেনশন (স্থগিত) টার্মটি ব্যবহার করা হয়। আপাতত আইনগত কারণে শুধুমাত্র মৃতদের ওপর ক্রায়োনিক্স প্রয়োগ করা যায়। ক্রায়োনিক্স ইন্সটিটিউট আশা রাখে ভবিষ্যতে মৃত্যুশয্যায় থাকা রোগীদের ওপর, যাদের বর্তমান প্রযুক্তিতে সুস্থতার আশা নেই, তাদেরও সংরক্ষণ সম্ভব হবে।

অবশ্য এখনও যাদের সংরক্ষণ করা হয়, ক্রায়োনিক্স ইন্সটিটিউট তাদেরকে মৃত বলে গণ্য করে না। তারা যে টার্মটি ব্যবহার করে তা হলো ‌’cryopreserved patient’ বা ‘ক্রায়োসংরক্ষিত রোগী’, কেননা তাদের মতে ক্রায়োনিক্সে সংরক্ষিত রোগী অনিবার্যভাবে মৃত নয়, অর্থাৎ, ক্লিনিকাল ডেড যেটাকে বলা হয়, সেটাই চূড়ান্ত মৃত্যু নয়।

মৃত্যুর পরও অধিকাংশ টিস্যু কিছু সময় একটিভ থাকে। তারা উদাহরণ দেন, অনেক সময়ই হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার পর, যাকে আইনত মৃত ধরে নেওয়া হয়, রোগী আবার বেঁচে ফিরে। বর্তমান মেডিকেল সাইন্স হৃদস্পন্দন থেমে গেলে হাল ছেড়ে দিলেও ভবিষ্যতে এখানেই হয়ত শেষ হবে না এটা তাদের আশাবাদ।

ক্রায়োবিদদের কথা হলো যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রেন বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় না, তখন পর্যন্ত প্রাকৃতিক নিয়মে ব্রেনে সংরক্ষিত ইনফর্মেশন পুনরুদ্ধারে মৌলিক কোন বাঁধা নেই। এখন না পারা গেলেও একদিন পারা যাবে এরকম একটা কনসেপ্ট আছে ক্রায়োনিক্সে। মৃত্যুর অল্প সময়ের মধ্যেই ক্রায়োনিক্সের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।

ক্রায়োনিক্স
Alcor ল্যাবে এভাবেই তরল নাইট্রোজেনে ক্রায়োপেশেন্টদের রাখা হয়, ছবিটি তাদের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

ক্রায়োনিক্সের ইতিহাস

১৯৬৬ সালে লস অ্যাঞ্জেলসের নাম না জানা একজন মহিলাকে প্রথম ফ্রিজ করে সংরক্ষণ করা হয়েছিলো, তবে মাসদুয়েক পর আত্মীয়-স্বজনরা তাকে বের করে সমাধিস্থ করেন। সত্যিকার অর্থে প্রথম যাকে ক্রায়োপ্রিজার্ভ করা হয়েছিলো ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির প্রফেসর জেমস বেডফোর্ড, যাকে ১৯৬৭ সালে ক্যান্সারে মৃত্যুর পর ক্রায়োনিকস করা হয়।

১৯৭৩ সাল পর্যন্ত সময়ে ক্রায়োপ্রিজার্ভ করা মানুষদের মধ্যে কেবলমাত্র তার দেহ-ই এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে Alcor Life Extension Foundation-এ। ক্রায়োনিক্সের একটি বড় ঘটনা হলো ১৯৭৬ সালে রবার্ট এটিনজার কর্তৃক ক্রায়োনিক্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা। মৃত্যুর পর ২০১১ সালে এটিনজারকে ক্রায়োপ্রিজার্ভ করে রাখা হয়।

২০১৪ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় প্রায় ২৫০ জনের ক্রায়োপ্রিজার্ভের তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া প্রায় ১৫০০ জনের কথা জানা যায় যারা তাদের মৃতদেহকে ক্রায়োপ্রিজার্ভ করার ব্যবস্থা নিয়েছেন। অবশ্য এখানে আইনী জটিলতা থাকায় এর বাইরে আরো থাকতে পারে।

ক্রায়োনিক্সের পদ্ধতি

সরাসরি বরফে রূপান্তর করলে আইস ক্রিস্টাল গঠনের ফলে লাশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আইস ড্যামেজ কমাতে একটি বিশেষ দ্রব্য ব্যবহৃত হয় যাকে বলা হয় ক্রায়োপ্রোটেক্টেন্ট। তুলনামূলক আধুনিক আরেকটি পদ্ধতি হলো ভিট্রিফিকেশন বা কাচীভূতকরণ, যেখানে খুবই দ্রুত তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলা হয়, ফলে ক্রিস্টালের পরিবর্তে গ্লাসের মত গঠন তৈরি হয়।

প্রসেসটি বেশ জটিল এবং এখানে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রসিজারে কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে। Alcor ল্যাবে সার্জনরা প্রথমে প্রায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার নিচের তাপমাত্রায় প্রধান রক্ত বাহিকাগুলোর একসেস নেন এবং স্টেরাইল পদ্ধতিসহ কিছু উপায়ে সাময়িক রক্ত চলাচল বন্ধ রাখা হয়।

এরপর ক্রায়োপেশেন্টকে রক্তসঞ্চালন যন্ত্রে নিয়ে রক্তকে ক্রায়োপ্রোটেক্টেন্ট দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়, যাতে ক্রিস্টাল গঠন না হয়। এরপর দক্ষ টেকনিশিয়ানদের নিয়ন্ত্রণে আরো কিছু ধাপের মধ্য দিয়ে যাওয়া হয়, তারপর আসে ভিট্রিফিকেশনের পালা। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিতভাবে বিশেষ পদ্ধতিতে জমাট না বাঁধিয়ে  -130° C তাপমাত্রায় সলিড ফর্মে নিয়ে আসা হয়। এটা আধুনিক একটি প্রযুক্তি যা ২০০৫ সালের আগে সম্ভব ছিলো না। এরপর পৃথক পৃথক অ্যালুমিনিয়াম কন্টেইনারে তাদের রাখা হয় এবং সবশেষে -196°C তাপমাত্রায় ডুবিয়ে রেখে দেওয়া হয় ।

সবসময় অবশ্য পুরো দেহ সংরক্ষণ করা হয় না, যেহেতু এটি তুলনামূলক বেশি জটিল হয়। এখানে মূল বিষয় হলো মস্তিষ্ককে সংরক্ষণ। ক্রায়োনিক্সে বিশ্বাসীদের বিশ্বাস অনুযায়ী ক্রায়োনিক্সে সংরক্ষিত মস্তিষ্কের যে ড্যামেজ হয়, সেটা সমাধান করে ভবিষ্যতে এখান থেকে ডেটা রিট্রাইভ করা যাবে অথবা রোবট বা অন্য কোনভাবে এই মস্তিষ্ককে কাজে লাগানো যাবে।

এখানে একটা কথা আমার মনে পড়লো, সম্ভবত মিশরীয়রা মমি তৈরির সময় মাথার ঘিলু তথা মস্তিষ্ক নাক দিয়ে বের করে নিত, কেননা তাদের ধারণা ছিলো মস্তিষ্ক জিনিসটা বিশেষ কাজের না… ক্রায়োনিক্স এখানে একটু আলাদা 🙄

খরচ

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্রায়োনিক্সের খরচের বিস্তর ফারাক আছে। এটা হতে পার ২ লাখ ডলার পর্যন্ত। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আলাদাভাবে নিউরোপ্রিজার্ভেশন অফার করে, যেখানে শুধু মস্তিষ্ক বা মাথা সংরক্ষিত হয়। ক্রায়োনিক্স ইন্সটিটিউটের দাবি অনুযায়ী তারাই সর্বনিম্ন রেট নিচ্ছে, ফুল বডি প্রিজারভেশনে এককালীন ২৮ হাজার ডলার তারা চার্জ করে থাকে। নিউরোপ্রিজার্ভেশনের কোন অপশন অবশ্য তাদের নেই।

সীমাবদ্ধতা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ

সীমাবদ্ধতাগুলোর একটি হলো আইনী সীমাবদ্ধতা। যেমনটা আলোচনা করা হয়েছে শুধু আইনত মৃতদেহকেই এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা যায় এবং সেখানেও জটিলতা রয়েছে। যাহোক, মৃত কিংবা জীবিত যেকোন অবস্থায় ক্রায়োনিক্স প্রয়োগ করে পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার কোন সুযোগ নেই। যদিও ছোট ছোট কিছু উদাহরণ রয়েছে, নেমাটোডা শ্রেণির প্রাণীদের ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় নিয়ে গিয়ে আবার ফেরানো সম্ভবত হয়েছে, তবে স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব না। জীবিত একটি স্তন্যপায়ীকে ক্রায়োনিক্স তাপমাত্রায় নিয়ে গেলে মৃত্যু অবধারিত।

ক্রায়োনিক্সের জন্য যে পদ্ধতিই নেওয়া হোক না কেন, এতে মৃতদেহ বা মস্তিষ্কের প্রচুর ক্ষতি হয় এবং একবার ক্রায়োপ্রিজার্ভ করলে লাশকে আর আগের অবস্থায় ফেরানোর প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত নেই। ১৯৫৭ সালেই ফ্রিজ করা স্তন্যপায়ী কোন প্রাণীকে সরাসরি ঊষ্ণ করে পূর্বাবস্থায় আনার চিন্তা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, জীবন ফিরিয়ে দেওয়া তো পরের কথা, ক্রায়োপ্রিজার্ভেশনের ড্যামেজকে সমাধান করাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

এরপর ধরা যাক যেকোনভাবে ভবিষ্যতে ক্রায়োপ্রিজার্ভড ব্যক্তিকে পূর্বাবস্থায় ফেরানো হলো। এতে কোন বিশেষ লাভ নেই, কেননা এখনও তিনি মৃত এবং তিনি যে কারণে মারা গেছিলেন সে কারণটি বিদ্যমান। অর্থাৎ পরের চ্যালেঞ্জটি হলো তিনি যে কারণে বা যে রোগে মারা গেছিলেন সে কারণটি সমাধান করা। তৃতীয়ত তার দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনা।

আমি অবশ্যই এতে বিশ্বাসী নই, শুধুমাত্র আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, কোন একদিন এই সব প্রযুক্তি মানুষ পেলো। কিন্তু তা হলেও সে দিনটি পর্যন্ত ক্রায়োপ্রিজার্ভ করে রাখা দেহগুলো সংরক্ষিত থাকবে এটা একদমই অবাস্তব ধারণা। ইতিহাস বলছে, একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির শতবর্ষ টিকে থাকার সম্ভাবনা হাজারে ১টির।

এমতাবস্থায় কোন একদিন মানুষ এত উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী হবে, ততদিন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকবে এমনটা আশা নিতান্ত অমূলক। ক্রায়োনিক্স কোম্পানির ব্যর্থতা অতীতেও দেখা গেছে। জেমস বেডফোর্ড ছাড়া ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত করা সব ক্রায়োপ্রিজার্ভড দেহ পরবর্তীতে বরফ গলিয়ে ডিসপোজ করে ফেলা হয়েছে।

ক্রায়োনিক্সের মধ্যে একটা বৈজ্ঞানিক ভাব থাকলেও মূলধারার বিজ্ঞানমহলে এটি নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে এবং একে সাধারণত ছদ্মবিজ্ঞান বা স্যুডোসায়েন্স হিসেবে দেখা হয়। এর অনুশীলনকে চিহ্নিত করা হয়েছে কোয়ার্কি বা হাতুড়ে ডাক্তারি হিসেবে।

সোর্স: উইকিপিডিয়া, ক্রায়োনিক্স ইনস্টিটিউট, Alcor Life Extension Foundation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *