অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম: প্রথম অ্যানালগ কম্পিউটার

সময়ের সাথে মানুষ আরো সভ্য হয়েছে কিনা, এই প্রশ্নটা আপেক্ষিক হতে পারে, কিন্তু এটা ঠিক যে সময়ের সাথে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষ শিখেছে, অনেক কিছু- যা একসময় দুরুহ ছিলো, যন্ত্রসভ্যতা তাকে সহজ করেছে। তবে সেই সময়ে, যখন মানুষের কাছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলো মোটেও ছিলো না, তখনকারও এমন কিছু নিদর্শন আমরা পেয়েছি যা আমাদের বিস্মিত করে।

আমি বলছি দুই হাজার বছরেরও আগের প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজমের কথা। অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম অ্যানালগ মেকানিকাল কম্পিউটারের এখন পর্যন্ত আমাদের জানা সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন। এমন ডিভাইসকে আমরা কম্পিউটার বলে থাকি যা তথ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ, গাণিতিক ও লজিকাল প্রসেসিং ও প্রদর্শন করতে পারে। অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম একটা অরেরি (orrery)। অরেরি বলতে বোঝায় সৌরজগতের মেকানিকাল মডেল যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহাকাশীয় বস্তুর অবস্থা প্রদর্শন করতে পারে।

অ্যন্টিকেথিরা মেকানিজমের ধ্বংসাবশেষের একটি অংশ, উইকিমিডিয়া কমনস থেকে

২০ শতকের শুরুতে কারো ধারণা ছিলো না খ্রিস্টপূর্ব প্রায় একশো বছর সময়ে এই যন্ত্রের মত কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্ভব হতে পারে। ১৯০১ সালে অ্যান্টিকিথেরা দ্বীপের নিকটে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে আরো অনেক নিদর্শনের সাথে উদ্ধার হয় এই যন্ত্রের ক্ষয়প্রাপ্ত কিছু টুকরো। কিন্তু এর বিশেষত্ব প্রথম ধরা পড়ে যখন পরবর্তীতে ১৯০২ সালে এখানে গিয়ারের ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যায়।

১৯৭১ সালে যন্ত্রটির ৮২টি টুকরোর এক্স-রে ও গামা-রে স্ক্যানের মাধ্যমে যন্ত্রটির কিছু রহস্য উম্মোচিত হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে থ্রিডি এক্সরে টমোগ্রাফি ও হাই রেজ্যুলেশন স্ক্যানের মাধ্যমে প্রথমবারের মত অভ্যন্তরীণ গঠন ও এখানে লিপিবদ্ধ ক্ষয়প্রাপ্ত প্রাচীন লেখাগুলোর পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়। যদিও যন্ত্রটির বড় একটা অংশের সন্ধান পাওয়া যায়নি, তবে এর গঠন ও কর্মপদ্ধতির রহস্য আধুনিক গবেষণায় পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

অনুসন্ধান অনুুযায়ী, অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজমে ৩৭ টি ইন্টারলকিং ব্রোঞ্জ গিয়ার রয়েছে, যা এমনভাবে তৈরি যেন এটি হাতল ঘোরানোর সাথে সূর্য, চাঁদ ও সম্ভবত আরো কিছু গ্রহের অবস্থান, চাঁদের দশা ও গ্রহণের আপেক্ষিক অবস্থাকে অনুকরণ করে। এটি চাঁদের অনিয়মিত গতি, অর্থাৎ উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবী থেকে দূরত্বের সাথে চাঁদের গতির পরিবর্তন কে অনুসরণ করত। এভাবে দশক আগেই এটা গাণিতিকভাবে সূর্য, চাঁদ ও গ্রহের অবস্থা প্রদর্শনে সক্ষম ছিলো।

অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে এটা আমাদের সভ্যতা নিয়ে নতুনভাবে ভাবায়। এরকম জটিল কোন যন্ত্রের কথা পরবর্তী প্রায় দেড় সহস্র বছরের ইতিহাসে আর জানা যায় না। এটা আমাদের সামনে উন্মোচন করে যে সভ্যতার অগ্রগতি সরলরৈখিকভাবে হয়নি, বরং এখানে উত্থান হয়েছে এবং পতন হয়েছে। বহু সভ্যতার সমাপ্তি হয়েছে যুদ্ধে কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। বহু সম্ভাবনা থেমে গেছে দুর্ঘটনায়।

এমনটা ভাবা কঠিন, কোন পূর্বসূরী ছাড়াই হঠাৎই এরকম জটিল একটি যন্ত্রের উদ্ভাবন হয়েছে। কিন্তু কোন সাগরের তলদেশে আর কোন জাহাজের ধ্বংসাবশেষে আরো বিস্ময়কর ভুলে যাওয়া প্রাচীন নিদর্শনগুলো লুকিয়ে আছে তা কে জানে!

আরো জানুন: উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *