কালো পোশাকে সারা দেহ ঢাকা তারা চলতে পারে বিদ্যুৎবেগে, লাফিয়ে পার হতে পারে দালান থেকে দালান কিংবা পাহাড় থেকে পাহাড়ে, হাঁটতে পারে পানিতেও, অদৃশ্যের মত মিশে যেতে পারে আশেপাশের প্রকৃতির সাথে, অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ছুঁড়তে পারে শুরিকেন- কল্পকাহিনী, কার্টুন, কমিকস, ভিডিও গেমস, গল্পে এমনইভাবে আমরা পরিচিত হয়েছি নিনজার সাথে, তবে আজ চলুন, কল্পকাহিনীর জগৎ ছেড়ে বাস্তবের নিনজাদের জগতে ঘুরে আসি।
Table of Contents
নিনজা কি কল্পনা না বাস্তব?
হ্যা, নিনজারা নিছকই কোন গল্পের চরিত্র নয়, তারা সত্যিই ছিলো। তবে কল্পনার নিনজা থেকে বাস্তবের নিনজারা আসলে অনেকটা কিংবা পুরোপুরি আলাদা। আসলে নিনজা তাদের নাম নয়, এটা বিশ শতকে প্রচলিত হওয়া বেশ নতুন একটা শব্দ, যেটা এসেছে চীন থেকে। কিন্তু নিনজাদের বসতি ছিলো জাপানে, আর তাদের আসল পরিচিতি ছিলো শিনোবি (shinobi) হিসেবে। আর না, তারা না পানিতে হাঁটতে পারে, না অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, তবে অবশ্যই নিনজারা উচ্চ প্রশিক্ষিত।
নিনজাদের আবির্ভাব দেখা যায় জাপানের ইতিহাসের সেনগোকু পর্বে (Sengoku period) পঞ্চদশ শতকের দিক থেকে, যখন জাপানে গৃহযুদ্ধ চলছিলো। তবে ধারণা করা হয় দ্বাদশ শতকের দিকেই তাদের ইতিহাস শুরু হয়েছে। মূলত জাপানের দুটো অঞ্চল, ইগা ও কোগাতে তাদের বসতি ছিলো। প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলো আসলে তারা ছিলো সামন্তবাদী জাপানের গুপ্তচর বা ভাড়াটে সৈনিক। গুপ্তচরবৃত্তি, ধূর্ততা ও আকস্মিক আক্রমণ ছিলো তাদের বৈশিষ্ট্য।
নিনজাদের সামাজিক অবস্থান
নিনজাদের কথা বলতে গেলে সমসাময়িক আরেকদল যোদ্ধাদের কথা একটু জানা দরকার, সামুরাই। এরা ছিলো উচ্চশ্রেণীর ও সম্মানিত। সামুরাইরা বিশেষ কিছু নীতি-আদর্শ মেনে চলত, এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তারা ছিলো সম্মুখ যোদ্ধা। নিনজারা সামুরাইদের থেকে অনেকটা বিপরীত। তারা সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে ছিলো, এবং সামাজিকভাবে সামুরাইদের মত মর্যাদাবান নয়। নিনজাদের মধ্যে সংঘবদ্ধ দল যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো অনেক ফ্রিল্যান্স নিনজা, যারা সর্বোচ্চ মূল্যদাতার হয়ে কাজ করত। সামুরাইদের মত নিনজারা সম্মুখ যোদ্ধা ছিলো না, বরং তারা গুপ্তচর ও গুপ্তঘাতক হিসেবে কাজ করত। নিজেদের অস্তিত্ব ও কর্মকান্ডের গোপনীয়তা বজায় রাখা নিনজাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা
ছদ্মবেশ, শঠতা ও আকস্মিক আক্রমণে নিনজাদের পারদর্শী হতে হত। পারিবারিকভাবে নিনজার ঐতিহ্য চলমান থাকতো, শিশুকাল থেকেই এই প্রশিক্ষণ শুরু হত। প্রশিক্ষণের মধ্যে আত্মরক্ষা ও গুপ্তচরবৃত্তির বিভিন্ন দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত ছিলো, যেমন, নিঃশব্দে বিচরণ, তথ্য সংগ্রহ, গুপ্তহত্যা প্রভৃতি।বর্তমানে নিনজাদের প্রশিক্ষণের বিষয়গুলোকে ‘নিনজুৎসু’ হিসেবে বলা হয়, যদিও এই শব্দটি তখন ব্যবহার হত না। ঐতিহাসিক কিয়োশি ওয়াতাতানির মতে,
কথিত নিনজুৎসু টেকনিক হলো সংক্ষেপে শিনোবি-নো-জুৎসু ও শিনোবিজুৎসুর দক্ষতাগুলো, যার লক্ষ্য ছিলো নিশ্চিত করা প্রতিপক্ষ যেন একজনের উপস্থিতি জানতে না পারে, এবং এজন্য ছিলো বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
পাশাপাশি তারা নানাবিধ অস্ত্রেও ব্যবহার করত, যেমন বিস্ফোরক, বিষাক্ত গ্যাস, তরবারী, ছুরি, তীর প্রভৃতি। কাতানা নিনজাদের ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় তরবারী। এটি প্রত্যক্ষ যুদ্ধের বাইরে আরো কাজে আসতো। অন্ধকারে এর খাপ অনুসন্ধানের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেত, আক্রমণের আগে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেয়ার জন্য এর খাপের ঊর্ধ্বাংশে লাল মরিচ, ধুলাবালি, লৌহচূর্ণ রাখা যেত, ফলে তরবারীর আক্রমণে এই মিশ্রণ শত্রুর চোখে গিয়ে তাকে হতভম্ব করে দিত মরণ আঘাতের আগ পর্যন্ত!
হারিয়ে যাওয়া ও কিংবদন্তীর উত্থান
সপ্তদশ শতকে তোকুগাওয়া শোগুনেট (Tokugawa Shogunate, জাপানের সামরিক শাসকদের শোগুন বলা হত) শাসনকালে শান্তি ও একতা প্রতিষ্ঠিত হলে নিনজাদের প্রয়োজন ফুরোতে থাকে। ফলে এসময়ে নিনজারা হারাতে শুরু করে। আর সেই সাথে তৈরি হতে থাকে নানা কিংবদন্তী।
নিনজাদের কার্যক্রমের রহস্যময় গোপনীয়তা থেকে নানা অনুমান তৈরি হয়, মুখে মুখে প্রচলিত হয় নিনজারা অদৃশ্য হতে পারতো বা পানিতে হাঁটতে পারতো এমনই সব কথা। এমনকি তারা উড়তে পারতো বা অন্য প্রাণীর রূপ নিতে পারতো এমন কথাও কেউ কেউ বলতে থাকে। এভাবে নিনজা হয়ে ওঠে কালো পোশাকে ঢাকা এক রহস্যমানব, যা কিনা বিভিন্ন কমিকস, গেমস, ফিল্মের জন্য আদর্শ চরিত্র।
কালোতে সারাদেহ ঢাকা তাদের যে পোশাকের সাথে আমরা পরিচিত, এটারও কিন্তু বিবরণ পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, সাধারণ মানুষের সাথে মিশে থাকতে তারা সাধারণ পোশাক ব্যবহার করত, আবার প্রয়োজনে ছদ্মবেশ ধারণে সেরকম পোশাক পরিধান করতে হত। যেহেতু নিনজাদের অভিযান সাধারণত রাত্রিকালীন ছিলো, সেসময়ে কালো পোশাকের ব্যবহারও অবশ্য তাদের জন্য সম্ভবত উপযুক্ত ছিলো।
শেষ নিনজা…
নিনজার সবকিছু কিন্তু একদিনে শেষ হয়নি। পারিবারিক ঐতিহ্যে নিনজার প্রশিক্ষণগুলো কিছু কিছু পরবর্তী প্রজন্মে চলতে থাকে। নিনজাদের সাথে সরাসরি রক্তসম্পর্কিত নিনজুৎসু প্রশিক্ষণ নেয়া যার কথা সর্বশেষ জানা যায়, তিনি হলেন সেইকো ফুজিটা, যিনি ১৯৬৬ সালে মারা যান এবং তার নিনজা হওয়া নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেন।

এরপরও কয়েকজনের কথা জানা যায়, যারা নিজেদের নিনজা বলে দাবি করেছেন। এদের মধ্যে জিনিচি কাওয়াকামি নিজেকে বাকিদের থেকে আলাদা করে রেখেছেন, তার বিনয়, শিক্ষা ও নিনজুৎসু দক্ষতার দিকে। জিনিচি কাওয়াকামি নিজেকে প্রকৃত নিনজুৎসু ট্রেনিংয়ের একমাত্র উত্তরাধিকারী বলেন। তিনি এই শিক্ষা পেয়েছেন মাসাডো ইশিডা থেকে, বাল্যকাল থেকেই তিনি তার হাতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন।
তবে তিনি কাউকে নতুন করে প্রশিক্ষণ দিতে আগ্রহী নন। বিবিসি নিউজের প্রতিবেদনে তিনি বলেছেন, গৃহযুদ্ধের সময়ে বা এডো যুগে নিনজাদের গুপ্তচরবৃত্তি ও হত্যা বা ওষুধ মেশানোর দক্ষতাগুলো হয়ত উপকারি ছিলো, কিন্তু এখন আমাদের আছে বন্দুক, ইন্টারনেট এবং অনেক উন্নত ওষুধপত্র, তাই আধুনিক যুগে নিনজুৎসুর কলাকৌশলের কোন স্থান নেই।
তথ্যসূত্র
১. https://wonderopolis.org/wonder/are-ninjas-real
২. https://www.ancient.eu/Ninja
৩. https://en.wikipedia.org/wiki/Ninja
৪. https://en.wikipedia.org/wiki/Seiko_Fujita
৫. https://en.wikipedia.org/wiki/Jinichi_Kawakami
ইন্টারেস্টিং…