নতুন মৌল পর্যায় সারণি

১১৯ তম মৌল কি সম্ভব? মৌলের শেষ কোথায়?

বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিফ যখন পারমাণবিক ভরের (বর্তমানে পারমাণবিক সংখ্যা) ভিত্তিতে তার পর্যায় সারণিটি তৈরি করেছিলেন, তখন সেখানে সবচেয়ে ভারি মৌলটি ছিলো ইউরেনিয়াম (₉₂U)। তবে তার পর্যায় সারণিতে মোট মৌল ছিলো ৬৩টি, কেননা, এর বেশি মৌলের আবিষ্কারের কথা তখনও জানা যায়নি। তবে তিনি এটা জানতেন যে পর্যায় সারণিতে এমন কিছু স্থান আছে, যেখানে নতুন মৌলের অস্তিত্ব সম্ভব, ফলে তার পর্যায় সারণিতে কিছু শূন্যস্থান ছিলো। পরবর্তীতে এই শূন্যস্থানগুলো পূরণ হয়েছে এবং ৯২ ছাড়িয়ে আরো ২৬টি নতুন মৌল আবিষ্কৃত হয়েছে।

এমনই একটি শূন্যস্থান ছিলো ৪৩ তম মৌলের স্থানে। বর্তমানে এর নাম টেকনেশিয়াম (₄₃TC)। ১৯৩৭ সালে টেকনিশিয়াম নিশ্চিতভাবে আবিষ্কৃত হয় এবং পর্যায় সারণির একটি শূন্যস্থান পূরণ হয়। এটিই ছিলো প্রথম কৃত্রিম বা সিনথেটিক মৌল, যা মানুষ আবিষ্কার করে। বাস্তবে প্রকৃতিতে এর কোন স্থায়ী আইসোটোপ নেই। তবে আবিষ্কারের পরবর্তী সময়ে এর চিহ্ন প্রকৃতিতে পাওয়া গেছে।

সাধারণভাবে প্রথম ৯২টি মৌলকে প্রাকৃতিক বিবেচনা করা হয়, যদিও তার মধ্যে কয়েকটির স্থায়ী আইসোটোপ নেই, কয়েকটি ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের তেজষ্ক্রিয় ভাঙনে সৃষ্ট। ইউরেনিয়ামই সর্বশেষ মৌল যা সাধারণভাবে প্রকৃতিতে সৃষ্টি হতে পারে। তবে ৯৩ ও ৯৪ তম মৌল নেপচুনিয়াম ও প্লুটোনিয়ামের ট্রেস বা চিহ্নও প্রথমে কৃত্রিমভাবে আবিষ্কারের পরবর্তীতে প্রকৃতিতে পাওয়া গেছে, ইউরেনিয়ামের নিউট্রন গ্রহণে ক্ষণিকের জন্য সৃষ্টি হয়। পরবর্তী মৌলগুলো গবেষণাগারের বাইরে কখনোই পাওয়া যায়নি।

নতুন মৌলের সংশ্লেষ

নতুন মৌল বলতে সেখানে থাকতে হবে এমন সংখ্যক প্রোটন, যা ইতোপূর্বে আবিষ্কৃত কোন মৌলে ছিলো না। ভারি মৌল পাওয়ার জন্য তুলনামূলক হালকা কোন মৌলের সাথে প্রোটন অথবা নিউট্রন অথবা নিউক্লিয়াসের সংঘর্ষ ঘটানো হয়। প্রোটন বা নিউক্লিয়াসের বিষয়টি বুঝতে নিশ্চয়ই সমস্যা হচ্ছে না। নিউট্রনের সাথে সংঘর্ষ কেন, সেটা একটু ব্যাখ্যা করি।

পৃথিবীতে যে মৌলগুলো পাওয়া যায়, তারা দেখা গেছে নক্ষত্রে নিউক্লিয়সংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় কিংবা উচ্চভরের মৌলের ভাঙনে সৃষ্ট। ৯৩ ও ৯৪ তম মৌলের ক্ষেত্রে ইউরেনিয়াম নিউট্রন গ্রহণ করে এবং সেখান থেকে নতুন মৌল সৃষ্টি হয়।

238U + n → 239U → 239Np → 239Pu

এখান থেকে বোঝা যায়, আরো ভারি মৌল পাওয়ার একটি পদ্ধতি হতে পারে কোন মৌলকে নিউট্রনের সাথে সংঘর্ষ ঘটানো, কেননা, নিউট্রন বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়ায় প্রোটনে পরিণত হতে পারে এবং এক্ষেত্রে নিউট্রন থেকে একটি প্রোটনের সাথে একটি ইলেকট্রন ও একটি এন্টিনিউট্রিনো মুক্ত হয়। আর একটি প্রোটন যুক্ত হলে এটি পরিণত হবে ভিন্ন একটি মৌলে।

পর্যায় সারণি কি পূর্ণতা পেয়েছে?

পর্যায় সারণিতে এখন এমন কোন দুটো মৌল নেই, যাদের মাঝে তৃতীয় একটি মৌলের অস্তিত্ব সম্ভব। মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিতে কিছু শূন্যস্থান ছিলো, এখন কোন শূন্যস্থান নেই। প্রথম ১১৮টি মৌল আমরা খুঁজে পেয়েছি। ২০১৬ সালে পর্যায় সারণির প্রথম ৭টি পর্যায় পূর্ণ হয়েছে। তারপর ৪ বছর চলে গেছে, কিন্তু এখনো নতুন কোন মৌলের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বা এরকম কোন দাবির কথা জানা যায়নি।

তাহলে এখানেই কি মৌলের সন্ধানের শেষ? সম্ভবত উত্তরটা হলো, না। বিজ্ঞানীরা সম্ভব ধরে নিয়েই আরো মৌলের সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। যদি নতুন কোন মৌল পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে রসায়নের জগতে একটি বড় ঘটনা অবশ্যই হবে। আর পর্যায় সারণিতে তখন নতুন একটি সারি যুক্ত হবে, যেহেতু প্রথম সাতটি সারি ইতোমধ্যেই পূর্ণতা পেয়েছে।

কেন ১১৯ তম মৌল এখনো পাওয়া যায়নি?

১১৮-তম মৌল ওগানেসনের পরবর্তী কোন মৌল বেশ কয়েক বছরের গবেষণায় এখনো পাওয়া সম্ভব হয়নি। এজন্য বেশ কিছু অ্যাটেম্পট নেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়েছে, তবে তা সফল হয় নি। ১১৯ তম মৌল তৈরির তুলনায় শনাক্ত করাটা আরো কঠিন চ্যালেঞ্জ। কেননা ভারি মৌলগুলো অত্যন্ত অল্প পরিমাণে তৈরি হয়, অর্ধায়ু খুবই কম বলে অত্যন্ত দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে প্রথম আবিষ্কারের সময়ে ১১৭ তম মৌল টেনেসাইনের মাত্র ৬টি পরমাণু তৈরি করতে পারা গিয়েছিলো এবং তার স্থায়িত্ব ছিলো কয়েক মিলিসেকেন্ড, পরবর্তীতেও টেনেসাইনের তৈরিকৃত পরমাণুর সংখ্যা নগণ্য-ই।

১১৮-র সীমা ছাড়ালে বিষয়টি আরো কঠিন হয়ে যায়। এরকম অতিভারিমৌল তৈরির বিভিন্নরকম প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। যে পদ্ধতিতে ১১৮ পর্যন্ত মৌলগুলো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে তা সম্ভবত এর চেয়ে ভারি মৌলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তারপরও আশা করা হচ্ছে ১২০ ও ১২৬ তম মৌলের এমন আইসোটোপ থাকতে পারে যার স্থায়িত্ব এতটুকু হবে যে অন্তত শনাক্ত করার যাবে।

শেষ কোথায়?

পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনম্যান এর মতে ১৩৭ তম মৌল হতে পারে মৌলের সীমারেখা। এর পরবর্তী মৌলগুলোর ক্ষেত্রে ইলেকট্রনকে এত দ্রুত ঘূর্ণনশীল হতে হবে যা আলোর বেগকে ছাড়িয়ে যাবে, যা সাধারণ আপেক্ষিকতার নিয়মকে ভঙ্গ করবে। অর্থাৎ, ১৩৭ তম মৌলই শেষ সীমা হতে পারে।

তবে আরো সাম্প্রতিক গবেষণা অবশ্য ইলেকট্রনকে একক কণা বিবেচনা না করে, কণার গোলক হিসেবে বিবেচনা করে হিসেব করে বলেছে সংখ্যাটা ১৭৩ এর আশেপাশে হতে পারে। তবে সত্যি কথা হলো, আমরা এখনো জানি না।

এতো গেলো মৌল আপেক্ষিকতার কথা। এখানে এটাই একমাত্র সমস্যা নয়। আমরা জানি সমধর্মী চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে আর পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে প্রোটন, যাদের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। যত বেশি প্রোটন কেন্দ্রে থাকবে, মৌল তত বেশি অস্থায়ী হবে। ফলে ইউরেনিয়াম পরবর্তী মৌলগুলোর স্থায়িত্ব কয়েক মিনিট, সেকেন্ড বা তার ভগ্নাংশ হয়।

সোর্স: ThoughtCo. উইকিপিডিয়া, Chemistry WorldSmithsonian Magazine

2 Comments

  1. বহুদিন ধরে এর উত্তর খুঁজতেছিলাম।আজকে জানতে পেরে খুব উপকৃত হলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *