স্বাধীনতা এবং তারপর…

আসসালামু আলাইকুম। স্বাধীনতাকে কিছুদিন ধরে নতুনভাবে উপলদ্ধি করছি। সত্য বলতে কি, মানুষ যখন সত্য বলতে কিংবা ন্যায়ের পথে চলতে আর জালিমের ভয় পায় না, তখনই সে স্বাধীন। তাতে যদি চরম কোন পরিণতি ভোগ করতে হয়, তবু যতদিন বাঁচবো ততদিন যদি সিংহের মত বাঁচা যায়, যদি জীবনের থেকে বড় কিছুর জন্য মৃত্যুকে বরণ করা যায়, তবেই কি জীবন আর মৃত্যুর সার্থকতা না?

আলহামদুলিল্লাহ। লিখতে গিয়ে আর অজানা একটা আতঙ্ক ঘিরে ধরছে না। রাস্তায় যখন চলছি, সবার মধ্যে একটা স্বতঃস্ফুর্ত ভাব। যেন এক অদৃশ্য চাপ চলে গেছে সবার ওপর থেকে।

চিন্তা করি, প্রাণ দিয়ে যাদের এই স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয়েছে, তারাও কি স্বাধীনতার উজ্জল এক সূর্যোদয় দেখতে চাননি? নিশ্চয়ই চেয়েছিলেন, সম্ভবত আমাদের সবার চেয়ে বেশি চেয়েছিলেন, তাই প্রাণ দিয়ে তার দাম দিতে দ্বিধা করেননি। প্রার্থনা করি আল্লাহ তাদেরকে এমন শান্তির জায়গায় রাখুন, যার সাথে পৃথিবীর কোন কিছুর তুলনা হয় না।

পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অনেকে, গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন। দুয়া করি আহতদের সবাইকে আল্লাহ ধৈর্যধারণের তৌফিক দিন ও দ্রুত সুস্থ করে দিন। গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানির স্বীকার যারা হয়েছেন এবং যে যার দিক থেকে যতটুকু করেছেন, প্রত্যেককে আল্লাহ উত্তম বিনিময় দিন।

২৯ মুহাররম পতন হয়েছে শেখ হাসিনার। এই মুহাররম মাসেই পতন হয়েছিলো পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে জালিম স্বৈরশাসক, ফেরাউনের। ১০ মুহাররম, যেদিনটি আজও আশুরা হিসেবে ইসলাম ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ। একজন জালিম শাসকের পতনকে কেন এত গুরুত্ব দিয়ে স্মরণ রাখা হয়েছে, এটা বোঝাটা এখন কঠিন নয়। তবে ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নেয় না বলেই হয়ত এখনো স্বৈরাচাররা একটা সময়ে গিয়ে নিজেদের প্রায় খোদা মনে করে বসে। কিন্তু আল্লাহ ছাড় দিলেও ছেড়ে দেন না।

জালিমের পতন আবশ্যক ছিলো। এই পর্যন্ত একসাথে কাজ করতে সুবিধাভোগীরা ছাড়া জাতির সবাই এক অভূতপূর্ব ঐক্য দেখিয়েছে। জালিমের পতন হয়েছে। সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে।

তবে তার সাথে নতুন কিছু অরাজকতা তৈরি হয়েছে। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, লুটপাত। প্রশ্ন উঠছে এরকম স্বাধীনতা আমরা চেয়েছিলাম কিনা। উত্তরটা সম্ভবত প্রায় সবার জন্যই, না। জালিমের পতন ছিলো সেই স্বাধীনতার পথের প্রথম ধাপ, যে স্বাধীনতা আমরা চেয়েছি। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য আরো অনেক দূরে।

সেই লক্ষ্য কী? তার পথ কী? প্রথম ধাপ যখন সবার জন্য এক ছিলো, কিন্তু ঠিক এইখান থেকে আদর্শ ও চিন্তার পার্থক্যের কারণে আমাদের পথ আর এক থাকবে না। তবে যখন আমরা নিজের চিন্তাগুলো আলোচনা করব, অন্যের মতামত ও পরামর্শের প্রতি উদার হব, এবং নিজের চিন্তাকে আরো সমৃদ্ধ করার মানসিকতা রাখবো, তখন এই ভিন্ন চিন্তা, মত-পথ নিয়েও আমরা সুন্দর সমাজের জন্য একসাথে কাজ করতে পারবো।

আজকের লেখাটা আমার চিন্তা নিয়ে। এটা অভিজ্ঞ কারো মতামত না। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার চিন্তা। আমার কথাতে হয়ত সংশোধনের অনেক জায়গা থাকবে। আমি স্বাগত জানাবো পরামর্শ ও ভিন্ন চিন্তা নিয়ে আলোচনাকে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দল

প্রথমেই আমার কিছু কথা আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন নিয়ে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা। এটা পরিষ্কার থাকা উচিৎ, সরকারের পতন পর্যন্ত সবার লক্ষ্য এক ছিলো, যেকারণে সামনে থেকে তাদের নেতৃত্বকে আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছি এবং তারা সুযোগ্যভাবে এই আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। কিন্তু সরকার গঠনের ক্ষেত্রে তারা ছাত্রসমাজ কিংবা জনগণের প্রতিনিধি নন। প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান তাদের অবদানের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করতে পারেন, কিন্তু তাদের মতকে চূড়ান্তভাবে মেনে নিতে কারো বাধ্যবাধকতা নেই। জনগণ কিংবা ছাত্রসমাজের প্রতিনিধিত্বে সরকার গঠন হয়নি এটা পরিষ্কার থাকা উচিৎ।

এই কথাগুলো শুধু বিষয়টি পরিষ্কার রাখার জন্য, বিশেষ পরিস্থিতিতে গঠিত এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরোধিতা আমি করছি না। তবে সমন্বয়কদের মধ্য থেকে দু’জনকে রাখার ব্যাপারটি আমার কাছে ভালো লাগেনি, একজন থাকা যথেষ্ট ছিলো। যাইহোক, আমি আশা করছি, গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুযোগ্যভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন ইন শা আল্লাহ। এ বিষয়ে শেষ কথা সময় বলে দিবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক মনোভাব লালন করি না। গণতন্ত্রে একটা বড় ধরণের সমস্যা আছে। গণতন্ত্র হলো রাজনৈতিক দলের শাসন। যেকারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নির্দিষ্ট দলের থেকে আসবে এবং নির্দিষ্ট দলের অনুকূলে যাবে। নির্দলীয় সরকার গঠনে যেমন জাতির সর্বোচ্চ মেধাবী ও যোগ্যদের কাজে লাগানোর সুযোগ আছে, দলীয় সরকারের ক্ষেত্রে সেটা নেই। গণতন্ত্রের আরেকটা বড় সমস্যা হলো রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া ও ধরে রাখা। আলাদাভাবে কোন আদর্শিক ভিত্তি থাকলে ভিন্ন কথা, তবে এটা রাজনৈতিক দলের অন্তর্নিহিত কোন বৈশিষ্ট্য না।

এই কথাগুলো বলার পর, যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুন্দরভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, তবে আমি ‘চাইতাম’ তারা কিছুটা দীর্ঘমেয়াদে শাসন করুন। তবে এখানে আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, প্রতিনিধিত্বপূর্ণ সরকার না হওয়াতে এখানে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। দীর্ঘদিন থাকলে তা অনেকেই মেনে নিবে না, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো সঙ্গত কারণেই আপত্তি করতে পারে, যা সম্ভাব্য সংঘাতের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু নির্বাচন পর্যন্ত যাওয়ার আগে কিছু পরিবর্তন ও সংস্কারমূলক কাজ খুবই প্রয়োজন, যা দলীয় সরকার থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভালোভাবে করতে পারবে বলে আশা করা যায়। এখন পর্যন্ত প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এই সবদিক বিবেচনা করে আমি চাইবো ২০২৫ সালের শেষ বা ২০২৬ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকুক।

রাষ্ট্রব্যবস্থার বিষয়ে কথা বলা যাক। মুসলিম হিসেবে আমি অবশ্যই ইসলামী শাসন ও শারিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি। ইসলামী রাষ্ট্রের বিষয়ে এটা বোঝা জরুরী যে ইসলামী রাষ্ট্র অর্থ শাসন, অর্থব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি হবে ইসলামী মূলনীতির আলোকে। এর অর্থ এই না যে বিধর্মীরা এখানে তাদের ধর্ম পালন করতে পারবে না বা নিরাপত্তা পাবে না।

আইনের ক্ষেত্রে, আইন যদি মানুষ নিজের ইচ্ছামত বানাতে ও প্রয়োগ করতে পারে, তাহলে শাসক আইনকে জুলুমের অস্ত্র বানাবে। এর উদাহরণ দেয়া যায়, কাদের মোল্লা রহি.-কে যখন সরকারের তৈরি প্রহসনের আদালত তাদের বিচারব্যবস্থাতেই যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দিলো, তখন সরকার সংবিধান সংশোধন করলো যেন তাদের কাঙ্ক্ষিত রায়ের দিকে আসা যায়। এই স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্তির জন্য মানবীয় পক্ষপাতমুক্ত ঐশী সমাধান প্রয়োজন। মুসলিমরা বিশ্বাস করি সে সমাধান হলো শারঈ শাসন। যদি এটা কেউ নিজেকে মুসলিম বলা স্বত্বেও বিশ্বাস না করে, বলা যায় তার ঈমান ত্রুটিযুক্ত।

এটা বলার পর, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা পর্যন্ত আসার কর্মকৌশল কেমন হবে এখানে চিন্তার অবকাশ রয়েছে। এই মুহুর্তেই ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করতে হবে, বা অন্য কোন ধরণের শাসনব্যবস্থা আসলে আমরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করবো অথবা বর্তমান প্রেক্ষাপটের বাস্তবতাকে বিবেচনা করবো না- বিষয়টা এরকম না। জনসমর্থন ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির প্রয়োজন আছে এজন্য। বর্তমান সময়ে ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্পর্কে জানা ও জানানো, ভুল ধারণাগুলো দূর করা এবং যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হবে কর্মপদ্ধতি।

এর আগে আমি গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতাগুলো বলছিলাম। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জনমতের অনুপস্থিতি ও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাতে ঠিক এই মুহুর্তে আসার বাস্তবতা বিবেচনা করে আমি তাহলে গণতন্ত্রের বিকল্প কী প্রস্তাব করব? উত্তর- আমার কোন বাস্তবসম্মত বিকল্প জানা নেই। এখানে চিন্তার অবকাশ আছে। তবে আপাতত আমি এরপর সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন-ই প্রত্যাশা করবো।

এখানে অনেকে চাইছেন নতুন দল গঠন হওয়ার মত সময় যেন নির্বাচন হওয়ার আগে পাওয়া যায়। আগেই যেটা বলেছি, এখানে সব জায়গাতে আমরা হয়ত ঐক্যমতে আসতে পারবো না। আমি বলবো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু বিশেষ অবস্থায় সরাসরি জনগণের প্রতিনিধিত্বে আসেননি, তাই খুব দীর্ঘমেয়াদে তার থাকার সুযোগ নেই।

কাজেই এই সময়ের মধ্যে যদি নতুন দল গড়ে ওঠে তো ভালো, এবং যদি না ওঠে, তবুও আমরা সম্ভবত কিছু অপশন পাবো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ অনেকে জোট ভেঙে আলাদা আলাদা জোট গঠন করতে পারে। ইসলামী দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামের মত দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বামপন্থী বিভিন্ন দলও পৃথক হয়ে যেতে পারে। কাজেই অপশন সম্ভবত বিগত দুই নির্বাচন থেকে বেশিই থাকবে। তবে গণতন্ত্র ৫১ ভাগ জনগণের শাসন হওয়াতে বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে অন্য অপশনগুলো থেকে খুব একটা লাভ হবে কিনা এই প্রশ্ন থেকে যাবে।

তবে তারুণ্যকেন্দ্রিক নতুন দল গড়ে উঠলেই আমি সেই দলকে বেশি পছন্দ করব এরকম না। তারা কোন চিন্তাধারা ও আদর্শ লালন করছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ সামলানোর মত যোগ্য ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব আছে কিনা এরকম সবকিছু বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তবে রাজনৈতিক দল বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেই ক্ষমতায় আসুক, I hate politics থেকে রাজনীতিসচেতন হয়ে উঠতে হবে ছাত্রসমাজসহ সবাইকে। রাজনীতির নামে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্ত কন্ঠ হতে হবে। নতুন কোন দানব কিংবা নতুন কোন আয়নাঘরের গল্প যেন আর কখনো গড়ে উঠতে না দেয়া হয়। কাউকে অন্ধভাবে একতরফা বিশ্বাস বা একতরফা কোন দলের পক্ষপাতিত্বের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে

এই মুহুর্তে সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং পুলিশ-প্রশাসন থেকে দলীয় (বা নির্দলীয়) সন্ত্রাসীদের বের করা। আইন ব্যবস্থাতে বড় রকম পরিবর্তন অতিসত্ত্বর প্রয়োজন। বিনা প্রমাণে নির্দোষ মানুষকে আটকে রাখা, যাকে তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারা, বিচার হওয়ার আগেই কয়েক বছর জেলে কাটিয়ে দেয়া- এরকম ভয়ঙ্কর বিষয়গুলো কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। বিচারব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে রিফর্ম করতে হবে। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করার উদ্যোগ নিতে হবে। রিমান্ডে নিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তির চেষ্টার পরিবর্তে সত্য উদঘাটনে সুদক্ষ গোয়েন্দাবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ডিএনএ টেস্টসহ আধুনিক প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহারে জোর দিতে হবে। মৃত্যুর কারণ সুস্পষ্ট থাকতেও ময়নাতদন্ত করা বা এরকম ভোগান্তিগুলোর মধ্য দিয়ে যেন ভিকটিমকে না যেতে হয় সেটা দেখতে হবে, প্রয়োজনের ক্ষেত্রে আলাদা। যে অপরাধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, ক্যামেরাতে ফুটেজসহ সবকিছু আছে, তার বিচার যেন অত্যন্ত দ্রুত হয়, এটা নিশ্চিত করতে হবে।

বিরোধীপক্ষকে দমনের জন্য যেন আইন না হয়, আইন হয় চোর-ডাকাত-সন্ত্রাসকে দমন ও সংশোধনের জন্য। যদি অপরাধী কিছুদিন কারাগারে থেকে কিংবা কিছু টাকা দিয়ে বের হয়ে পুনরায় অপরাধে ফিরে যেতে পারে, আর নিরাপরাধী বছরের পর বছর কারাপ্রকোষ্ঠে কেঁদে মরে, তার থেকে নিকৃষ্ট কী হতে পারে? যারা নিরাপরাধী অথবা লঘু পাপে গুরুদন্ড ভোগ করছেন, তাদের মুক্তির জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।

আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আইনী পোশাকধারী ও দলীয় সন্ত্রাসী যারা হত্যাকান্ড ও নিপীড়ন করেছে, তার বিচার অবশ্যই করতে হবে। তবে যারা নিজের বা নিজের ভাইবোনদের ওপর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন, তাদের অবশ্যই কোনরকম শাস্তির মুখোমুখি করা যাবে না।

আমি সংযোজন করব স্বৈরাচারের শেষ চিহ্ন না রাখাই ভালো, এজন্য আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়, স্বৈরাচারের চিহ্ন হিসেবে তৈরি মূর্তি ও ভাস্কর্য, ফলক প্রভৃতি ভাঙচুরের জন্য শাস্তির সম্মুখীন করা হলে আমার অবস্থান এর বিরুদ্ধে থাকবে। যদিও এটা আইনী প্রক্রিয়াতে সম্ভব হলে ভালো হত, কারণ পরের প্যারার কথাগুলো সম্ভাব্য কারণ এখান থেকে শুরু হয়।

যে কারো বাসা-বাড়ি, ব্যক্তিগত সম্পদ ও উপসনালয়ে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনা অত্যন্ত প্রয়োজন। এটা ঠিক, বহুজনের বিগত বছরের অত্যাচারের পাওনা বাকি ছিলো, তবে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো এতে যখন ভুল মানুষকে জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়। পোড়া বাড়িগুলো থেকে উদ্ধার হওয়া লাশ, কিংবা আবু সাইদের খুনী পর্যন্ত অপবাদ নিয়ে বই লাভারজ পোলাপান গ্রুপের এডমিন রবিউল লিমন ভাইকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা– এগুলো কি কোনভাবে ক্ষমাযোগ্য? ‘ভুল’? ভুল করে মানুষকে এভাবে মেরে ফেলা যায়?

অযোগ্যদের দখলে

আওয়ামী লীগ ভেতর থেকে সমাজের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিগুলো করেছে তার অন্যতম হলো ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সমাজের সব স্তরে অযোগ্য লোকদের চাপিয়ে দিয়েছে। যাদের নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে তাদের শনাক্ত করে তাদের বদলে যোগ্যদের জায়গা করে দিতে হবে। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।

বিশেষ করে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই অতিদ্রুত সময়ে সংস্কার করা প্রয়োজন। অন্তত আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন এরকম না থাকে, সেটা সুনিশ্চিত করতে হবে, এতে ক্লাস শুরু হতে যদি একটু দেরিও হয়। সময় সংকট বাধা হয়ে দাঁড়ালে আপাতত পুরনো বইগুলোকে সংস্কার করে ফিরিয়ে আনা হতে পারে, পরবর্তী বছরগুলোতে পর্যায়ক্রমে যোগ্য ব্যক্তিদের কাজে লাগিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে আমূল সংস্কার করতে হবে।

আমি সংযুক্ত করব, আমরা খুব বেশি বিজ্ঞানের জয়গান করছি। এটা খারাপ। ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ভূগোল, দর্শন সবগুলো বিষয়ের ধারণা ও সাধারণ একটা জ্ঞান যেন সবার থাকে। এরপর যে যে বিষয়ে আগ্রহী তার যেন সেদিকে যাওয়ার সুযোগ থাকে। পড়াশোনা যেন আরো জীবনঘনিষ্ঠ হয়। এবং সবার উচ্চতর পড়াশোনা করতে হবে, এখানে পদ্ধতি ও মানসিকতার একটা বড় পরিবর্তন দরকার, তবে সেটা অন্য আলোচনা।

দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি ও ছাত্ররাজনীতি

ছাত্রদলের নামে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের খবর আমরা ইতোমধ্যে পাচ্ছি, এমনকি পাওয়া গেছে আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষে মৃত্যুর সংবাদ পর্যন্ত। আওয়ামী লীগের পতনের ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ইতোমধ্যে দখল নিতে শুরু করেছে। বর্তমান সংস্কৃতিতে এটা থামানোর উপায় নেই। কেননা এক দল দখল না নেয়ার অর্থ আরেক দলকে সুযোগ করে দেয়া।

কাজেই প্রথমত সন্ত্রাস কার্যক্রমগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ও সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিতে হবে। সংগঠনগুলো এই দিকটি কীভাবে এবং কতটা নিয়ন্ত্রণ করছে, তা নির্বাচনের সময়ে অবশ্যই বিবেচনার একটি বড় বিষয় হবে।

দখলদারিত্বের দিকটি বন্ধ করতে হলে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে মেরুদন্ডসম্পন্ন মানুষ থাকতে হবে। যেখানে ভার্সিটির হলের সিট, মিল কোন রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে নিয়ন্ত্রণ হবে না। জোর করে শিক্ষার্থীদের মিছিলে নেয়া, নির্যাতন প্রভৃতির বিরুদ্ধে আইনী ও সাংগঠনিক অবস্থান কঠোর হতে হবে। অন্যভাবে বললে আদর্শ পরিস্থিতিতে আমি ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে যাবো না।

প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের পরিস্থিতি আদর্শ কিনা এবং এই আদর্শ পরিস্থিতিতে এখনই উপনীত হওয়া বাস্তবসম্মত চাওয়া কিনা। যেহেতু বাস্তবতা আমরা সবাই কমবেশি জানি, তাই উত্তর হলো- না। কাজেই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে সব ধরণের রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ।

তবে মোটাদাগে সন্ত্রাসী দল না হলে, এবং নিজে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত না থাকলে ক্যাম্পাসের বাইরে কারো রাজনীতি করাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাধা থাকা উচিৎ না।

আমরা প্রত্যেকে…

আরো অনেক কথা বলার আছে। সমাজটাকে সংস্কার করতে হবে সর্বোতভাবে। তবে এই লেখার জন্য এটুকুই থাকুক। মনে রাখতে আমরা সবাই মিলেই সমাজ। জালিম থেকে যখন আল্লাহ আমাদের মুক্তি দিয়েছেন, তখন আমাদের বিনয়ী ও কৃতজ্ঞ হতে হবে। তরুণরা এই আন্দোলন শুরু করেছে এবং এই আন্দোলনের মধ্যে খুব প্রয়োজনীয় কিছু পরিবর্তন আমাদের প্রজন্ম নিজেদের মধ্যে নিয়ে এসেছে। তবে একইসাথে দুঃখজনকভাবে তৈরি হয়েছে কিছু অবাস্তব আত্ম-অহমিকা ও অকৃতজ্ঞতা।

আমাদের মনে রাখতে হবে সেই রিক্সাওয়ালার কথা, যিনি রিক্সার ওপর উঠে সম্মান জানিয়েছেন আন্দোলনকারীদের। সেই সিঙারা বা আমড়া বিক্রেতাদের কথা, যারা বিনামূল্যেই তাদের ব্যবসায়িক পণ্য বিতরণ করেছেন পাশে দাঁড়ানোর জন্য। সেই শিক্ষকদের কথা, যারা ছাত্রদের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়ে দৃঢ়ভাবে সাথে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের কথা, যারা তাদের উপার্জনের পথে বাধাকে মেনে নিয়েছেন বড় কিছুর জন্য। মা-বাবাকে কখনো না জানা সেই কিশোরটির কথা, যে আন্দোলনকারীদের রুখতে আসা পুলিশকে বাধা দিতে গিয়ে বুলেটে মৃত্যুকে বরণ করেছে। আর হ্যা, তাদের কথাও ভুলে যাওয়া যাবে না, যারা জালিমেরই সহযোগী হয়েছিলো কিছু দানাপানির জন্য।

স্বাধীনতার পর এখন সংস্কারের সময়। সে পরিবর্তনের শুরু হোক নিজের থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *